“এই ছেলে তুমি আমার খাতা দেখে লিখছ কেন?” হঠ্যাৎ চিৎকার শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় শ্রাবণ। মেয়েটার ননস্টপ বকবকানিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই পায় না সে। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে পুরো ক্লাস ওর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে এমনকি গার্ড এ থাকা ভাইয়াটা পর্যন্ত !!! সবার এমন ভাব যেন পৃথিবীতে সেই প্রথম ব্যক্তি যে অন্যের খাতা দেখে দেখে লিখছিল । আর এই মেয়ে যে বকবক শুরু করসে এর কোনো থামাথামি নাই টেপ রেকর্ডার এর মত চলছে , পুরাই অসহ্য। আগে জানলে শ্রাবণ ভুলেও এই মেয়ের খাতার দিকে তাকাতই না।
এই মেয়েটা হচ্ছে তিতলি । বাইরে থেকে খুব রাগি আর অহংকারী মনে হলেও আসলে তিতলি খুবি ইমশোনাল আর ভালো একটা মেয়ে,এই গোপন তথ্যটা অবশ্য তিতলির মা ছাড়া আর কেউ জানে না। সেদিন সকাল থেকেই ওর খুব মেজাজ খারাপ ছিল তারপর ক্লাস এ অই ছেলেটাকে হা করে ওর খাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আর নিজেকে একদমই কন্ট্রোল করতে পারে নি ,সারাদিন এর সমস্ত রাগ অই ছেলের উপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু বাসায় আসার পর থেকেই তিতলির মনে হতে লাগলো কাজটা একদমই ঠিক হয় নি ,একটা সামান্য কাজের জন্য এত কথা শুনানোর কোন দরকার ছিল না। বেচারা কেমন মাথা নিচু করে ওর সব কথা শুনে যাচ্ছিলো এসব মনে হতেই কেমন খারাপ লাগতে শুরু করল ওর। পরদিন খুব সকাল সকাল কোচিং এ চলে আসলো তিতলি যদি ছেলেটাকে পাওয়া যায় । কোচিং এর ভিতর যেতেই দেখে ছেলেটা মাথা নিচু করে সিঁড়িতে বসে আছে। ওকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে তিতলির খুব মায়া লাগে ,সেও আস্তে করে ওর পাশে গিয়ে বসে তারপর হঠ্যাৎ করেই বলে উঠে -“সরি” ,চমকে উঠে শ্রাবণ তাকিয়ে দেখে কালকের ওই বদরাগী মেয়েটা বসে আছে, সরি কি ওই বললো নাকি? অবাক করা ব্যাপার এই মেয়ে আবার সরি বলতে পারে নাকি? এদিকে তিতলি কথা বলেই যাচ্ছে “ আসলে কাল আমার ওইভাবে বলাটা উচিৎ হয় নাই , কাল আমার মেজাজটা খুব খারাপ ছিল তো তাই এইভাবে বলে ফেলসিলাম, কিছু মনে করো না। তুমি কথা বলছ না কেন?” প্রশ্ন শুনে ধ্যান ভাঙ্গে শ্রাবণের। এতক্ষণ হা করে তিতলির কথা শুনছিল ও। -“না না ঠিক আছে আমি তেমন কিছু মনে করি নি । আর দোষটা তো আমারই। আসলে আমি কেমিস্ট্রি একটু কম পারি তাই কিছু ইকুয়েশন সিওর হয়ে নিচ্ছিলাম।”
-“আগে বলবা তো, আমাকে বললেই আমি নিজেই দেখাতাম। যাই হক আমি আবার কেমিস্ট্রি খুবি ভাল পারি। এরপর থেকে আমি তোমাকে হেল্প করব কেমিস্ট্রি বুঝতে।”
এইভাবেই কথা শুরু হয় শ্রাবণ আর তিতলির, অল্প কথা থেকে একসময় ভাল ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায় ২ জনের মধ্যে। একসময় দেখা যায় একজনকে ছাড়া আর একজনের চলছে না। শ্রাবণের সকাল শুরু হয় তিতলির গুড মর্নিং দিয়ে এর তিতলি রাত এ ঘুমাতে যায় শ্রাবণের গুড নাইট শুনে আর সারাদিন কথার রেলগাড়ি তো চলছেই , কোনো সময় কোচিং এ আর কোচিং শেষ হলে মোবাইল এ। ওদের কথা আর ঘুরে বেড়ানোর যন্ত্রণাই শুধু কোচিং সেন্টার না পুরা ফার্মগেট এলাকাই বিরক্ত হয়ে গেল।
একদিন ক্লাস শেষ করে বাসায় যাওয়ার সময় ওরা বাসের জন্য ওয়েট করছে ,একটার পর একটা বাস চলে যাচ্ছে অথচ কোনটাতেই উঠতে পারছে না ওরা ,মেজাজ এমনি গরম হয়ে আছে শ্রাবণের এই সময় তিতলি ওকে দেয় এক ধাক্কা-
-“দেখ দেখ কি সুন্দর রংধনু!!!!!”
-“হুম একটু আগে বৃষ্টি হইসে তাই”।
-“আরে তুই এত বেরসিক কেন? কই এত সুন্দর একটা জিনিস দেখে খুশি হবি তা না। দেখ আকাশটাকে কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে , ইস! আমি যদি ওইটা ধরতে পারতাম তাহলে কিছু রঙ নিয়ে গায়ে মাখতাম”।
রংধনু দেখে এত খুশি হওয়ার কি আছে তা শ্রাবণ বুঝে উঠতে পারে না কিন্তু পাগলিটার রংধনু ছোঁয়ার চেষ্টা দেখে ওর খুব ভাল লাগে।
-“আরে এভাবে লাফাস না, হাত পা ভাঙ্গবে , রংধনু কি ছোঁয়া যায় রে বোকা , বাস এসে পরছে বাসায় চল।”
ইদানিং শ্রাবণের মনে খুব অচেনা এক অনুভূতি হয় ,কই আগেও তো ও অনেক মেয়ের সাথে মিশেছে কিন্তু তিতলির জন্য যা হচ্ছে এইরকম আর কারো জন্য তো কোনোদিন ও তো হয় নি। এখন শ্রাবণের সারাদিন কেবল এটাই মনে হয় তিতলি না থাকলে ওর জীবনে আর ভোর হবে না বিকেল আসবে না রাত ও নামবে না। কিন্তু এগুলা তো নিজের মধ্যে নিয়ে বসে থাকলে হবে না তিতলিকে জানাতে হবে। কিন্তু কিভাবে?? এই চিন্তাই সারাদিন ঘুরপাক খায় শ্রাবণের মাথায় । একদিন নিউমার্কেট এ গিয়ে ওর মাথায় অদ্ভুত এক চিন্তা আসে তিতলি কে যদি রংধনুর সাত রঙের চুড়ি কিনে দেয়া যায় তাহলে ও হয়ত অনেক খুশি হবে , রংধনু না এনে দিতে পারলেও ব্যাপারটা কিছু একটা হবে, যা হবে হইতবা ভালই হবে। সারদিন ধরে নিউমার্কেট পুরাটা চার বার চক্কর দিয়ে সে সাত রঙের সাতটা চুড়ি খুজে বের করে, আর কল্পনাতে দেখতে থাকে এইগুলা পরলে তিতলির হাতকে রংধনুর মতই ভাল লাগবে আর মেয়েটা খুব খুশি হবে , কল্পনাতেই তিতলির হাসি মুখ দেখে খুব ভাল লাগে শ্রাবণের। পরদিন ক্লাস শেষ করে ধানমণ্ডি লেক এ যায় ওরা। শ্রাবণ ঠিক করে আসছে আজ যা হক কিছু একটা করতেই হবে এইভাবে আর চলা যায় না। আজ তিতলিকে নিজের হাতে চুড়ি পরিয়ে দিয়ে বলবে “আমার আকাশটা খুব ধুসর রে ,তুই আমার আকাশে রংধনু হবি?? যে রংধনু শুধু বছরে একবার উঠে না বরং সারাজীবন আকাশটাকে রাঙ্গিয়ে রাখে।”
-“শ্রাবণ দেখতো আমার জ্বর আসছে কিনা?” তিতলির কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠে শ্রাবণ।
-“তোর তো বেশ জ্বর, শরীর একদম পুড়ে যাচ্ছে। চল এখুনি বাসায় চল।”
তিতলিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল শ্রাবণের ।ধুর আজো বলা হোল না, চুড়ি গুলা পকেটেই থেকে গেল। এদিকে শ্রাবণ জানতেও পারলো না তিতলি গতকাল সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছে ইচ্ছা করে জ্বর আনার জন্য,মনে করেছিল অনেক জ্বর আসলে জ্বরের ঘোরে শ্রাবণকে বলতে পারবে ওর ভালবাসার কথাটা। এমনি অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু বলতে পারে নি,আর ছেলেটাও এত বোকা ওর চোখের দিকে তাকিয়েও বুঝতে পারে না যে কি প্রচণ্ড ভালবাসা নিয়ে তিতলি ওর জন্য অপেক্ষা করছে শুধু ওর মুখে একটিবার ভালবাসি শুনার জন্য।
-“কিরে জ্বর কমসে? “ রাত এ কল করে জিজ্ঞেস করে শ্রাবণ।
-“হুম নাই এখন” -তাহলে কণ্ঠ এরকম শুনাচ্ছে কেন? মন খারাপ? দাঁড়া আমি এখুনি তোর মন ভাল করে দিচ্ছি।” এই বলে গীটার নিয়ে গান শুরু করে শ্রাবণ
- “মুখটা তুলে আকাশটাতে দেখ আরেকবার
তোমার সাথে আছি আমি যে চিরকাল
জোছনার আলো যখন তোমার গায়ে পড়ে
আমি তখন থাকি তোমারই পাশে পাশে”
ফোনের অইপাশে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তিতলি মনে মনে বলে তুই যদি আমাকে এভাবে গান শুনাস তাহলে সারাজীবন আমি মন খারাপ করে থাকতে রাজি আছি"
-“কি রে তুই কি কাঁদছিস”
-“কই না তো” দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ।কেউ কোন কথা বলছে না কিন্তু দুজনেরেই অনেক কিছুই বলার আছে,,,,,, তবুও কিসের যেন একটা বাধা।
“ঘুমিয়ে পর, অনেক রাত হয়েছে।”
“হুম। শোন কাল আমি রাজশাহী যাচ্ছি, মামার বিয়ে।এক সপ্তাহ পরে ফিরব।”
“সাবধানে যাস আর পৌঁছে ফোন দিস।”
পরদিন রাজশাহি চলে যায় তিতলি। অইখানে ওদের বাড়িটা একদম পদ্মার পাড়ে। এখানে আসার পর থেকে তিতলির শ্রাবণের কথা আর বেশি করে মনে পরতে থাকে। ইস!!এখন যদি শ্রাবণ আমার পাশে থাকতো !!!!!!! গতকাল সারাদিন সারারাত ধরে তিতলির ফোন এ চেষ্টা করে যাছে শ্রাবণ, কিন্তু বারবার বন্ধ পাচ্ছে। ধুর মেয়েটা যে কি করে না। মামার বিয়ে নিয়ে হয়ত বিজি, নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় ও।
শ্রাবণ খবরের কাগজ খুব একটা পরে না। আজ কি মনে করে যেন সকাল বেলায় পেপার নিয়ে বসলো ও। “পদ্মায় নৌকা থেকে পরে পানিতে ডুবে এক মেয়ের মৃত্যু” খবরটা পরেই পুরা কেপে উঠে শ্রাবন।ভিতরের নিউজ পরার মত শক্তি নিজের ভেতর পায় না। তিতলিও ত সাঁতার জানে না। তবে কি,,,,,,,,,,,,,, আর ভাবতে পারে না শ্রাবণ , মাথা ঘুরে পরে যায়। পরে ঠিক হলে জানতে পারে তিতলিরা সব কাজিন মিলে নৌকায় ঘুরতে বের হয়, নৌকাটা কাঁত হয়ে গেলে পড়ে যায় তিতলি , নদীতে অনেক স্রোত থাকার কারনে দূরে চলে যায় , যখন ওকে খুজে পাওয়া যায় তখন আর ওর দেহে প্রান নেই। সেইদিন এর পর থেকে আর বাসা থেকে বের হয় না শ্রাবণ কারো সাথে কথাও বলে না। ওর মত এরকম এত উচ্ছল ছেলেকে এইভাবে বদলে যাওয়ার কারনটা কেউ ঠিক বুঝতে পারে না। শ্রাবণ এখন বেশির ভাগ সময়ই অই চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে আর অদেরকেই তিতলি মনে করে নিজের মনেই কথা বলে। আজ একবছর পর বাসা থেকে বের হয়েছে শ্রাবণ, তিতলির কাছে যাচ্ছে ও ,পকেটে সেই চুড়িগুলো,,,, আজ যে তিতলির মৃতু্বার্ষিকী । সময়ের সাথে সাথে হয়ত ঠিক হয়ে যাবে শ্রাবণ, কিন্তু না কষ্টটা একদমই কমবে না বরং সময়ের সাথে সাথে বাড়বে এমন কিছু কষ্ট থাকে যা মানুষ ইচ্ছা করে মনে রাখতে চায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:২২