নীরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
টেবিলে গোছাতে গিয়ে আরিফের লেখা একটি চিঠি পেয়েছে নীরা। নীলক্ষেত থেকে কেনা ২৫ টাকা দামের একটি খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে কিছু কথা। চিঠিটা পড়ার পর থেকেই নীরার দমবন্ধ লাগছে। অনেক দিন পর আরিফের কথা মনে পড়ছে। ছেলেটা খুব একটা গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু লেখায় বেশ গোছানো একটা ভাব আছে।
আরিফ মিডফোর্ড মেডিকেলে পড়তো। মিডফোর্ডের কথা উঠলেই ও নাক-মুখ কুঁচকে ফেলতো।
‘জায়গাটা এত নোংরা, বুঝলে ? আমার না মাঝে মাঝে গা ঘিনঘিন করে। হাসপাতাল হবে ছবির মতো সুন্দর। সামনে একটা বাগান থাকবে আর বাগান ভর্তি থাকবে হরেক রকম ফুল। ক্যান্সার পেশেন্ট মৃত্যুর অপেক্ষা আর যন্ত্রনায় বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে যখন অধৈয্য হয়ে পড়বেন, তখন চলে যাবেন সেই বাগানে। মনের সুখ মিটিয়ে ফুলের গন্ধ নেবেন, গায়ে মেখে ঘুঁরে বেড়াবেন পুরো বাগান জুড়ে। ফুল ছেঁড়ার অধিকারও তার থাকবে। আমাদের মিডফোর্ডে তো এখানে সেখানে ময়লা পড়ে থাকে। বাগান আর বানাবে কোথায়? তবে আমাদের হলগুলো খারাপ না। চলে আর কি। আসলে চার বছর ধরে আছি তো, তাই মায়া পড়ে গেছে।’
নীরা চশমা পড়ে, কালো রংয়ের একটা ফ্রেম আর চুল সিঁথি করে বামপাশে। তার চোখ খুব একটা সুন্দর না হলেও চোখ ভর্তি মায়া ছিলো। নীরা হাসলে আরিফ অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকতো। আরিফ সবসময় বলতো কারো হাসি যে এতো সুন্দর হতে পারে, নীরার সাথে দেখা না হলে নাকি ওর জানাই হতো না।
নীরা আবার প্রথম থেকে চিঠিটা পড়া শুরু করলো। চোখ ভিজে আসছে। আসুক। মাঝে মাঝে কষ্টগুলোকে জল হয়ে বেরুতে দিতে হয়। চিঠিতে কোনো সম্বোধন নেই। যেন হঠাৎ শুরু হয়েছে। আরিফ হয়তো মনে মনে ভাবছিলো। ভাবনার কোনো এক জায়গা থেকেই লেখা শুরু করেছে।
“তোমাকে নিয়ে ২৪ ঘন্টা ভাবতে চাই। জানো, যখনই ভাবি, অদ্ভুত এক কষ্ট অনুভব করি। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়। অনিশ্চয়তা। তবু্ও, কষ্টের মাঝে আমি সুখ খুঁজে পাই। অনেক সুখ আছে। তোমায় নিয়ে ভাবতে ভালোই লাগে। বিশ্বাস করো, প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূত যেন তোমার সাথেই থাকি। ভাবনার জগৎটা যেন তোমাতেই সীমিত। অথচ, তুমি ফোন করলে ধরতে ইচ্ছে করে না। মে বি ট্রায়িং টু বি প্রিপেয়ারড ফর ফিউচার।
তবু্ও….তবু্ও….বুঝে নিও…তোমাকে অনেক অনুভব করেই দূরে থাকবো।
কথাগুলো খুব হাস্যকর শোনাচ্ছে, তাই না? আমি না জীবনেও গুছিয়ে লেখা শিখলাম না। ডাক্তাররা একটু বোরিং হয়..এমনই হয়।
শোনো মেয়ে, সবসময় অনেক ভালো থাকবা…...
আর ...থাক না কিছু কথা না বলাই থাক...সব কথা মুখে বলতে নেই"
নীরা বড় একটা দীঘশ্বাস ফেললো। আরিফকে নিয়ে ভাবনার দরজাটা বন্ধ করা প্রয়োজন। অবশ্য সে দরজা নীরা অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। আরিফের সাথে সম্পর্কছেদের দু’বছর পার হয়ে গেছে। দু’বছর একটি মানুষকে ভোলার জন্য যথেষ্ট। তবে হঠাৎ হঠাৎ যে আরিফের কথা মনে পড়ে না, তা নয়। কিন্তু যতবারই নীরা আরিফকে নিয়ে স্মৃতির বাক্স খুলেছে, সুখ স্মৃতির সাথে ঝড়ের মতো ধেয়ে এসেছে গাদাখানেক কষ্ট।
নীরা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। ১১টা বেজে গেছে। আজ ওর ছুটি, তাই কোনো তাড়া নেই। কিন্তু নীতু বলেছে একটার মধ্যে নিউমার্কেট থাকতে হবে। টুকটাক কি সব নাকি কিনতে হবে। নীতু কিছু কিনলে নীরার সাথে যেতে হয়। ওর কিছু পছন্দ হয় না। নীরার পছন্দই তার পছন্দ।
নীরা রেডি হওয়া শুরু করল। আরিফের ব্যাপারটা ভুলতে হবে। মনের এসব অপ্রয়োজনীয় আবেগকে প্রশয় দিতে নেই। অর্নাস কমপ্লিট করা এক মেয়ে কেন তার পুরনো প্রেমের কথা ভেবে কাঁদবে? ছেলেমানুষির একটা সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত। এসব করবে ইন্টার পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা। তাছাড়া আরিফের মাস ছয়েক হলো বিয়ে হয়েছে। মেয়ে আমেরিকার সিটিজেন। আরিফকেও ওখানে নিয়ে যাওয়ার কথা। আরিফের সারা জীবনের স্বপ্নই ছিল দেশের বাইরে যাওয়ার... তাই এটাই সবচেয়ে সহজ আর ভাল উপায় মনে করেছিল ও।
‘শোনো মেয়ে, সবসময় অনেক ভালো থাকবা…’ – চিঠিতে লেখা আরিফের কথাগুলো এখন বড় বেখাপ্পা লাগছে। নীরা আবারো দীঘশ্বাস ফেললো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনই নীতুর সাথে পরিচয় হয়েছিলো নীরার। সামান্য পরিচয় থেকে একসময় গাঢ় বন্ধুত্ব। নীতুকে এক সময় বন্ধু কম বোন বলেই বেশি ভেবেছে নীরা। নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির সাথে আরিফের পরিচয় করিয়ে দেয়াটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো। অথচ, সেই নীতুর প্রেমেই হাবুডুবু খেতে থাকলো আরিফ!
নীতুকে আরিফ বলেছিলো, ‘শুধুমাত্র তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ড বলেই কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে তুমি?’
নীতু শান্তস্বরে বলেছিলো, ‘আমার একটা রিলেশন আছে, জানো নিশ্চয়ই? আচ্ছা ধরে নিলাম নীরা নামে আমার কোনো বন্ধু নেই্। ধরে নিলাম আমি কোনো সম্পর্কেও জড়িয়ে নেই। তুমিও একা, আমিও একা। তাহলে কি হতো? এরপরও তোমাকে না বলতাম। বিকস ইউ আর নট মাই টাইপ।’
নীতুর মুখে এ ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো নীরা। ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না কি বলা উচিত। চোখ থেকে শুধু ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিলো ,দেখে নীতু এক রাম ঝাঁড়ি দিয়েছে।
‘এত পুতু পুতু হলে তো সমস্যারে । এ ধরনের ছেলেরা শুধু ঝামেলাই পাকায়। আমি বিষয়টা নিয়ে মোটেও টেনসড না। আমি তোকে নিয়ে টেনসড। তুই অল্পতেই খুব ভেঙ্গে পড়িস। মনটাকে শক্ত কর। এর চেয়ে ঢের ভালো ছেলে তোর কপালে আছে। আমি ভাই ক্লিয়ার-কাট কথা পছন্দ করি। এইসব উল্টা পাল্টা ঝামেলার জন্য আমার-তোর মাঝে যেন কোনো ঝামেলা না হয়। আশা করবো, তুই আমার ওপর ভরসা রাখবি। অন্যের জীবনে ঝামেলা পাকিয়ে ওরা ভালো থাকে।’
নীরা মোবাইল বের করলো। রিং বাজছে।
Look into my eyes - you will see
What you mean to me
Search your heart - search your soul
And when you find me there you'll search no more ...
নীরার খুব প্রিয় একটি গান...যখনই ওর মন খারাপ হত আরিফ গিটার বাজিয়ে এটা গেয়ে শোনাত... খুব ভাল গিটার বাজাতে পারতো ছেলেটা।
ওপাশ থেকে নীতুর গলা শোনা যাচ্ছে। নীরা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘তুই ঠিকই বলেছিলি। আরিফের মতো ছেলেরা কখনো খারাপ থাকে না।’
‘থাবড়ায়ে তোর দাঁত ফেলে দেব অভদ্র মেয়ে। আমি নিউ মার্কেটে দাঁড়ায়ে আছি। আর তুই পুরনো প্রেম কপচাচ্ছিস্ ফাজিল। এখুনি বের হ।’
নীরা হেসে ফেললো। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। নিউমার্কেট যেতে মিনিট বিশেক সময় তো লাগবেই। ব্যাগের সাথে খাতা আরিফের চিঠিটা ছিঁড়ে ব্যাগে এ পুরলো নীরা। যা্ওয়ার সময় চিঠিটা ফেলে দিতে হবে। সব পিছুটান ধরে রাখতে নেই....
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:১৮