শেষ বিকেলের শেষ ক্ষণ। অবস্য সেই সূর্য মামার দেখা দুপুর হতেই নেই। মধ্য ইউরোপের এই দেশ টা তে এই সময়ে বিকেল টা খুব তাড়াতাড়ি আসে। দুপুর ২ টার পর হতে মোটামুটি শেষ বিকেলের কালচে আভাটা চোখে পড়ে। নরমালি এই সময়টা তে এই দেশ গুলো তে প্রচুর পরিমানে স্নো পড়ার কথা , কিন্তু বিশ্ব আবহাওয়ার পট পরিবর্তনের সাথে এই দেশ টার আবহাওয়া খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। মধ্য জানুয়ারী অথচ নাই বরফের দেখা , এমন কি ঠান্ডা র পরিমান টাও হাড় কাপানো নয়। গত কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার নিম্ন তাপমাত্রার তুলনায় এখানকার তাপমাত্রা এখনো যথেষ্ট বেশি।
তিন তলার বেলকনি, এই পাস টা পুরো খোলামেলা। শহরের প্রাণ কেন্দ্র ঘেসে সাকিব দের থাকার ফ্লাটটি। গায়ে সুয়েটার চেপে হাতে এক মগ র টি নিয়ে বেলকনির এক পাশে এসে দাড়ালো সাকিব। এই সময়টা তে সাকিব বাসায় একাই থাকে, অন্যরা তখন যার যার জব নিয়ে ব্যাস্ত। সাকিব এর ও এই সময়ে বাসায় থাকার কথা ছিলনা। কিন্তু ওই যে অনেকে বলে ইউরোপে নাকি তিন ডব্লিও এর বিশ্বাস নাই। এক ডব্লিও এর বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নাই সাকিবের , কিন্তু দুই ডব্লিও এর অভিজ্ঞতা যথেষ্ট পরিমান হয়ে গেছে। একটি ওয়েদার, আরেক টি ওয়ার্ক গত এক মাস আগে হঠাত করে জবের জায়গা থেকে অ নিদিষ্ট কালের জন্য বেতন বিহীন ছুটি। জানেনা কখন কাজ আবার শুরু হবে। এদিকে সাকিবের এখনো এই দেশে বৈধ ভাবে থাকার ও কাজের পেপার নাই। তার উপর যদি থাকা কাজ চলে যায় , সেক্ষেত্রে আরেক টি কাজ যোগার করা কত কঠিন তা মাত্র এর ভুক্তভোগীরাই জানে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে আর শুন্য মগ্ন দৃষ্টি নিয়ে বেলকনির বাইরে তাকিয়ে আছে সাকিব। মাঝে মাঝে সাকিবের মগ্ন দৃষ্টির মাঝে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে দাডাস সাপের মত লম্বা ট্রেন গুলোর বিকট আওয়াজে। সাকিবের বাসার পাশ দিয়ে চলে গেছে এই শহরের সবচেয়ে বড় ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন লাইনটি। প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের কত হাজার ও মানুষ এই শহরে ডুকছে আর বের হচ্ছে। সাকিবের শুন্য দৃষ্টি মাটি ছেড়ে আকাশের নীল দিগন্তে ছুটে যায়, রাজ্যের জায়গা জুড়ে বিমান গুলো ছুটে চলছে দেশ হতে দেশান্তরে। চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে জাপসা হয়ে উঠে কি এক অপ্রাপ্তির বেদনায়।
এমনিতে বেশ কয়েকদিন ধরে মনটা খারাপ সাকিবের। আজ সকালে মায়ের সাথে কথা বলে মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। মায়ের একই কথা বাবা কখন দেশে আসবি ? বয়স তো আর কম হলনা বিয়ে সাদী তো করতে হবে। বেশ কিছু দিন যাবত তো শুধু মাকে বলেই যাচ্ছে , এইত মা আর মাত্র কিছুদিন কাগজ পত্র সব জমা দিয়াছি , ইনসাল্লাহ এইবার পেপার হাতে পাব। সময় যায়, মাস যায় , বছর ও চলে গেল বেশ কয়েকটি। কিন্তু সাকিবের প্রতিক্ষার প্রহর আর শেষ হয়না।
ইদানিং সাকিবের মায়ের তাড়াহুড়ার কারণ হচ্ছে তার ছোট ভাই এর বিয়ের আদর্শ সময় হয়ে গেছে।
বড় ভাই বিয়ে না করলে তার ছোট ভাই বিয়ে করতে নারাজ। কিন্তু এই নারাজি এক সময় অভিযোগ হয়ে উঠবে সেটি সাকিব জানে। তাই আগ হতে সাকিব মাকে বলে দিয়াছে , আমার জন্য অপক্ষা না করে ছোট কে বিয়ে করিয়ে দাও। ওর ছোট ভাই টি যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। ভার্সিটি হতে ভালো রেজাল্ট নিয়ে ,এখন দেশে একটি ইউরোপিয়ান এম্বাসির ফাস্ট ক্লাস অফিসার। তাই তার বিয়ের জন্য মোটামুটি লাইন দিয়ে আছে পাত্রী পক্ষরা। কিন্তু ওই যে বাংলাদেশের সামাজিকতার প্রশ্ন, বড় ভাই এর আগে ছোট ভাই এর বিয়ে। সাকিবদের পরিবারের আলাদা একটা মর্যাদা আছে গ্রামের মানুষদের কাছে। সাকিবও দেশে থাকতে ভার্সিটি হতে সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়ে বের হয়েছিল। ইউরোপে ও এসেছিল আরো আরো বেশি উচ্চ শিক্ষা নিতে। কিন্তু জীবনের এক চরম ভুল করেছিল মাঝ পথে পড়ালিখা ছেড়ে দিয়ে ইউরো কমানোর ধান্দায় নেমে।
সেই থেকে সাকিবের পিছে পড়ার গল্পের শুরু।
কখন যে সাকিবের মগের চা ফুরিয়ে হয় টের ও পায়নি। মগ টা এক পাশে রেখে দিয়ে দু হাত বেলকনির রেলিং এর উপর ছড়িয়ে দিল। পুরোপরি অন্ধকার চেয়ে গেল চারপাশ। খানিক পরপর দ্রুতগতির ট্রেনগুলোর হেড লাইটের আলোয় ভরিয়ে যাচ্ছিল তার বেলকনির আশপাশ টা।
দূর দিগন্তের মেঘ যুক্ত আকাশের পানে চোখের দৃষ্টি ছুটে যায় সাকিবের। শত শত আলোক বর্ষ মাইল দূর হতে একটি অতি উজ্জল নক্ষত্রের আলোর আভা পৃথিবীর কোলে আসার কি দুরন্ত চেষ্টা। কিন্তু কিন্তু কিছু কিছু মেঘের দলা বার বার নক্ষত্রের আলোর পথে বাধা হয়ে আসছে। সাকিব মিলিয়ে নেয় তার জীবনের সাথে নক্ষত্রের আলোর। কিছু ছোট ছোট ভুল জীবনের আলোর পথে বারবার
বাধার দেয়াল হয়ে দাড়ায় তার ।
কোনো একজন কবির একটি কবিতার কিছু ভাবার্থ মনে পড়ে সাকিবের। আমি বাহির হতে দরজা খুলতে খুলতে ক্লান্ত , আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য ভেতর হতে দরজা খুলে দেবে , নরম বিছানায় বসতে দিবে , খেতে দিবে , পান্তা ভাতের সাথে আরো একটি পোড়া মরিচ লাগবে কিনা জিগ্গেস করবে।
কিন্তু হায় কোথায়।................ .
মনে পড়ে সাকিবের যখন দেশে থাকত,তার বড় অবিবাহিত ভাইদের সাথে কোথায় ও বেড়াতে গেলে , মানুষ জন জিজ্গেস করত ওরা বিয়ে করছ কিনা , বা কখন করবে। কিংবা অনেকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসত তার বাবা , মার কাছে, ভালো মেয়ে, উচ্চ শিক্ষা , বংশ ভালো। অনেকে আড়ালে আবডালে দূর হতে দেখাত , ওই যে ছেলেটা খুব ই ভদ্র। তখন সাকিব লক্ষ্য করত তার ভাইদের লজ্জায় আরক্ত পুলকিত চেহারা গুলো। তখন সাকিব ভাবত ইস কখন যে ভাইদের বিয়ে হবে , আর আমাকে নিয়ে মানুষ জন দূর হতে কিংবা কাছ হতে বলবে ওই যে ছেলেটা , ভদ্র , নম্র , ভালো চাকুরিজীবি। ................হায় প্রবাস !.
এখন তো আর তার সামনে বিয়ের বাধা হয়ে কেউ দাড়িয়ে নাই। কিন্তু নিয়তি আজ তার বাধা।
গায়ে হালকা ঠান্ডা অনুভুত হচ্ছে সাকিবের। রাতের বেলায় নরমালি ঠান্ডা ২/৩ ডিগ্রিতে নেমে আসে। কিন্তু অন্ধকারে এই বেলকনিতে দাড়িয়ে তার অতীত সৃতির রোমন্থন কিছুটা আবেগী করে তুলেছে সাকিব কে। তাই এই ঠান্ডার অনুভুতির বোধ টাও কেমন জানি ম্রিয়মান তার কাছে।
সাকিবের খুব ই ছোট বেলার কথা। প্রাইমারির বার্ষিক পরীক্ষা গুলো শেষ হলে আনন্দের সীমা থাকতনা। নানার বাড়িতে লম্বা সময়ের জন্য বেড়াতে যেত ওরা। সব মামাত খালাত ভাই বোনেরা একসাথে হত তখন। ওর বড় একটা খালাত বোন ছিল রিয়া নামে। উনি তখন ভার্সিটি তে পড়তেন, সবাই ছুটি তে বেড়াতে আসলে তিনি ও আসতেন। ছোট দের নিয়ে খুব মজা করতেন তিনি। বিকেল বেলায় সবাই কে নিয়ে বাড়ির উঠোনে বসতেন , আর সাকিব দের হাতের তালু দেখে দেখে বলতেন , বাবু বড় হলে বিয়ে করবে ২ টি , মিঠু ১ টি। সাকিব জিগ্যেস করতাম আপু কিভাবে বললে কে কয়টি বিয়ে করবে ? আপু মুচকি হেসে বলতেন কেন তোমাদের হাতের ভিতরে রেখা বলে কে কয়টি বিয়ে করবে। কেমন জানি বিশ্বাস করত সাকিব তার আপুর কথায়। কারণ তিনি তো তখন অনেক বড় ক্লাসে এবং বড় ইস্কুলে পরতেন। চুপি চুপি আপুর দিকে হাত তা বাড়িয়ে দিত সাকিব , দেখতো আপু আমার কয়টা। .................. লজ্জা পেত সে । আপু হাসতো, আর সাকিবের হাত টা ধরে ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের নিচে ছোট্ট দুটি রেখা দেখে আপু চিত্কার করে বলত , আমাদের সাকিবের দুটো বিয়ে হবে। লজ্জায় আপুর হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে দুরে পালিয়ে যেত সাকিব। সাকিবের সেই আপু আজ বেছে নাই।
সম্ভবত ঘরের রুমে কেউ আসলো। দরজায় তালা খোলার আওয়াজ। সাকিব কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। অন্ধকারের ম্রিয়মান আলোয় তার ডান হাতের তালুটা কে চোখের সামনে নিয়ে আসলো।
এখনো কনিষ্ঠ আঙ্গুলের নিছে দুটো ছোট্ট রেখা সুন্দর ভাবে ফুটে আছে। সাকিবের মুখ দিয়ে এক চিলেতে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বুক হতে এক দলা চাপা নিশ্বাস বের হয়ে এলো। উদাস নেত্রে তাকালো আকাশের দিকে। একি , সাকিব এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি , কিছুক্ষণ আগের অন্ধকার মেঘযুক্ত আকাশ কেমন আলোয় ঝলমল করছে , দূর নক্ষত্র আর চাদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে , তার দাড়িয়ে থাকা বেলকনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ৮:০৯