আমি পৃথিবীর সবচে শ্রেষ্ঠ মা’য়ের সবচে কুপুত্র, নিঃসন্দেহে। সেই সাথে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের একজন অপদার্থ প্রেমিক এবং পথচারী মেয়েদের মাঝে সুশীল পথচারী। দেশনেত্রী, জননেত্রী আর ব্লগমাতা - আমার ক্ষুদ্র গন্ডিতে আপাতত নারী বলতে এরাই।
ও, কিছু বান্ধবীও ছিল, সেগুলো সব বিয়েশাদী হয়ে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে হেজেপেজে গেছে। রাস্তা ঘাটে হঠাত দেখা হয় বিরাট সংসার সমেত। শপিং এর ব্যাগ হাতে অথবা একটা দুটো গ্যান্দা কোলে করুন মুখে তাকিয়ে থাকা জামাই আর পরতে পরতে সুখ জমে ইয়া মুটকী হয়ে যাওয়া প্রিয় মুখ গুলো, যাদের দেখলে দোস্ত না, খালাম্মা ডাকতে মন চায়; যারা চোখ বড় বড় করে সুর টেনে বলে, “কিরে এখনো বিয়া করস নাই ?? সমেস্যা কি তর ?? মাইয়া দেখুম?” কিম্বা পুরোনো ক্রাশের সাথে দেখা হয়ে গেলে তো আরো বিপদ !! সতীন জামাই, আর ন্যাড়া মাথার পিচ্চি; “বাবুসোনা, এ তুমার আঙ্কেল হয়, সালাম দাও তো দেখি”! আমি কাষ্ঠহাসি দেই, মনে মনে আফসোস করি, “ডাকনের কথা আসিল বাপ, আর ডাকিস আঙ্কেল !! হায় কপাল !!”
বান্ধবী গুলো তাই গোণার বাইরে।
মা? নারী? ধুর !! মা তো মা’ই !!
বাসায় বাবা, ভাই মিলে আমরা চারজন পুরুষ, আম্মা একলাই নারী। তাও লিখতে গিয়ে মনে পড়লো! হয়তো সে নিজেও ভুলে গেছে। আমরা বডি স্প্রে কিনি, জেল কিনি, মায়ের চুলের তেল শেষ হয়ে যায় কবে জানিই না। দায় সারি মা দিবস কিম্বা জন্মদিনে একজোড়া কানের দুল অথবা চুড়ি কিনে দিয়ে। ঈদের সময় আমার শ্যামলা মায়ের জন্য কিনে নেই কালো শাড়ি, তাঁর সোনার অঙ্গে মানাবে কিনা এত ভাবার সময় কই?
যত শরীর খারাপই হোক, রান্না ঘরে হাড়ি ঠেলতে যেতে তাঁকে হবেই, আর আমরা নবাবজাদা’রা পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে শুয়ে মুভি দেখি, পেপার পড়ি, অথবা আড্ডা মারি। নজর দেয়ার সময় কই, এটাতো তাঁর দায়িত্ব, তাইনা? একবার জ্বরের ঘোরে রান্না করতে গিয়ে আঙ্গুল পুড়িয়ে ফেললো আমার আম্মা। আমরা দৌড়ে গিয়ে কেউ তাঁর আঙ্গুলে পানি ঢালি, কেউ মলম লাগিয়ে দেই, আর সে মুচকি হাসে! যন্ত্রণা চেপে হাসি মুখে বলে, “কি আমার সুপুত্ররা রে!! আঙ্গুল পুড়লো বাম হাতে, আর মলম লাগায় ডান হাতে !!”
ছোটবেলায় বিরাট কোন বদমাইশি করে ফেললে আম্মা ডাইল ঘুটনি কিম্বা ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ানি দিত। ধরা পড়ার পর উড়াধুরা দুই চাইরটা থাবড়া খেয়ে ত্রাহি চিৎকার দিতাম “ওরে মা রেএএএএ” !! মায়ের হাতে মার খেয়ে মা’কেই ডাকতাম !! নাইন টেন’এ উঠার আগ পর্যন্ত তিন ভাই’ই আম্মার কাছে পড়েছি আর মার খেয়েছি। এখন এত লম্বা হয়েছি আর আমার মা সেই ছোট্টটিই রয়ে গিয়েছে যে আর নাগাল পায়না আমাদের কান’এর কিম্বা গালের।
সারা জীবনভর নিজের সব শখ,আহলাদ, সুখ, স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমার মা, শুধু আমাদের মানুষ করার জন্য চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ভালোত্ব নিংড়ে নির্যাস পুরে দিতে চেয়েছে আমাদের মাঝে। আমরা হজম করতে পারিনি তা শুধু আমাদেরই ব্যার্থতা।
‘অতি’নারী প্রেমিকা !!
একবেলা ফোন না দিলে কি টেনশন !! “কিছু হোল না তো মেয়েটার? ধরা খেল না তো দজ্জাল মায়ের কাছে? নাকি বদরাগী বাপ সিজ করেছে মোবাইল?” অথবা গাল ফোলানো অভিমান! “ফোন দিলানা ক্যান? আমাকে আর মনে পড়েনা, তাইনা? আমি তো তোমার কেউ না !!”
দিনরাত, প্রতি মুহূর্ত, প্রতিক্ষণ একটা মানুষ কিভাবে আরেকটা মানুষের পুরোটা স্বত্তা দখল করে রাখতে পারে? কিভাবে পারে মানুষের সব স্বপ্ন, সব ভাবনা, সব কল্পনা শুধু তাকে ঘিরেই আবর্তন করাতে? প্রেমিকারা পারে। কিভাবে পারে কে জানে? আবার হুট করে চলেও যেতে পারে। এই আছে, এই নেই !! কল্পনার সব রং সব রং ডিসকালার করে দিতে পারে মুহূর্তেই। ওরা সব পারে। অসাধ্য নেই কিছু? উহু !!
প্রেমিকারা অতিনারী। সুপার ওম্যান!! তাদের সিক্রেট সুপার পাওয়ার গুলো একেকটা ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র !! পূর্ণ চোখে তাকিয়ে তারা মিস করিয়ে দিতে পারে যেকোন হার্টবিট!! ঠোটের কোনে এক চিলতে দূর্বোধ্য হাসি দিয়ে লুটিয়ে দিতে পারে অহঙ্কারী ছেলের ইগো !! একটু মিষ্টি কথায় ঘায়েল হয়ে যেতে পারে অতি জ্ঞানী’দের আত্মবিশ্বাস !! একটু ভালবাসার ছোঁয়া কোথায় ভাসিয়ে দেয় মৌন তপস্যা !!
অল্প দামে বিক্রি করে দেই হৃদয়, হাঁটু গেড়ে হাতে তুলে দিয়ে বলি, “ম্যাডাম, এই যে লন আমার হার্ট। এর দুই নিলয়, দুই অলিন্দই আপনার উদ্দেশ্যে বরাদ্দকৃত। ইহাতে বাস করিয়া আপনি আমায় ধন্য করেন ম্যাডাম!!” সহৃদয় রূপবতী প্রেমিকারা উহা গ্রহন করেন, উল্টায়া পাল্টায়া দেখেন, মর্জি হইলে গৃহপ্রবেশ করেন, অন্যথায় ফুটবলের লাহান কিক মারেন !! তখন বেচারা প্রেমিক হৃদয় হারাইয়া রাস্তায় রাস্তায় এতিমের মত ঘোরেন অথবা পান করে লিভার লাল করে ফেলেন !! টিকটিকির ল্যাজের মতো নতুন হৃদয় না গজানো পর্যন্ত এই দূর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করাই নিয়তি।
কিরে পিচ্চি, তুই’ও নাকি নারী?
আমার যখন ২ নাম্বার ভাইটার জন্ম হয়, তখন আমার বয়স ৫ !! খেলার উঠানে পিচ্চি নারীদের সহিংসতা দেখে আমি চেয়েছি আমার যেন ভাই’ই হয়, কারণ মেয়েগুলা হিংসুটে !! আর খামচি মারে রেগে গেলে !! এরপর আরেকটু বড় হতে হতে কিছু ভদ্র গোছের মেয়েলী স্বভাবের মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ায়; একটা বোনের প্রতি আগ্রহ জাগল। তাই চেয়েছিলাম বোন, কিন্তু এবারও পেলাম পিচ্চি একটা ভাই !! এরপর যত বড় হয়েছি, আর দেখেছি বোন’দের দৌরাত্ব আর ভাইদের প্রতি তাদের হৃদয় উপচানো ভালবাসা; ততই আফসোস করেছি, অভাববোধ করেছি একটা মমতাময়ী বোনের। এক বন্ধুকে তার বড় দুই বোন এখনো ভাত মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, দেখে আমার হিংসায় পেট কামড়ানো শুরু করে!!
আমার বোনের সেই অভাব পূরণ হয়েছে আমার কাজিন’দের পেয়ে। খালাতো বোন আর চাচাতো বোন। কি ভালবাসাটাই না বাসে ওরা আমাকে! সংসারের প্রতি চরম উদাসীন এই আমি কোনদিন খবর নেইনা, কিরে, কেমন আছিস বইন? অথচ ওরা ঠিকই ফোন করে, এফবিতে নক করে আমাকে মনে করিয়ে দেয় বোনের মমতার কথা। সত্যি বলছি, এখন আর মিস করিনা আমার না থাকা আপনা বোনকে।
সেদিনের সেই পিচ্চি বোনগুলো একের পর এক সব বড় হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে হয়ে চলে যাচ্ছে দূরে। বোন, মুখ ফুটে কোনদিন বলিনি তোদের ভালবাসি, কিন্তু নিশ্চই তোরা এই অপদার্থ বড়ভাই’য়ের ভালবাসাটা অনুভব করতে পারিস; পারিস না?
সব সৌন্দর্য্য রাস্তায় !!
পিপড়ার ঢিবির মধ্যে পাড়া পড়লে যেমন দুনিয়ার পিপড়া প্রতিবাদ করতে বেড়িয়ে আসে, তেমনি যেকোন পূজা পার্বনে, উতসবে কিম্বা মেলায় অজানা উৎস থেকে ডানাকাটা সব সুন্দরীরা কলকল করতে করতে দল বেধে বেড়িয়ে আসে রাস্তায়। আমরা হতভাগারা অপার বিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি !! এরা সারা বছর কই থাকে?
বাসে এক সিটে বসে, আরেক সিট দখল করে রাখি ব্যাগ দিয়ে, সুন্দরী কোন প্যাসেঞ্জার উঠলে হালকা করে সরিয়ে নেই ব্যাগ। কিন্তু সুন্দরীর পেছন পেছন উঠে ষন্ডামার্কা প্রেমিক, অহেতুক বড়ভাই, কিম্বা বাতিকগ্রস্থ পিতা !! আর একা থাকা সুন্দরীরা আমার মত সন্দেহজনক চেহারার মানুষের পাশে বসার চাইতে কোন উটকো বুড়োর পাশে বসাই নিরাপদ মনে করে !!
মাঝে মাঝে কোন মুরুব্বী রিকশাওয়ালার পাল্লায় পড়ি। রিকশা চলতে থাকে গজগামিনী গতিতে, বসে থাকি গালে হাত দিয়ে, আর পাশ কাটিয়ে রকেটের গতিতে উড়ে যায় কোন রিকশা সুন্দরী কোন তরুনীকে নিয়ে। গাল ছুয়ে যায় তরুনীর উড়তে থাকা ওড়না !! মনে মনে গেয়ে উঠি, “আপনি যদি আমার হইতেন রেএএএ...আমি হইতাম আপনের! পাশের সিটে বসাইয়া আপনেরে...”
রাস্তাঘাটে সব সৌন্দর্য্য, আর এত বড় বিছানার মশারি আমার একলা টাঙ্গাইতে হয় এই কষ্টে বুক উথাল পাথাল করে !! তাকিয়ে থাকি সুন্দরীর ছায়া রাস্তার দিগন্তে মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত। ইচ্ছা হয় কাছে গিয়ে শুধাই, “কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি! মুপাইল নাম্বারটা দিবেন আপামনি?”
ইচ্ছাগুলো বস্তাবন্দী হয়েই থাকে। কি দরকার সুন্দরীকে বিব্রত করে? আমার না হোক, কারো তো বোন। আমার বোন হলে তো উটকো রোমিও গুলোকে হোমিওপ্যাথির গুল্লি বানিয়ে গিলে ফেলতাম হাতের কাছে পেলেই!!
তাই শুধু স্বপ্নই দেখি।
স্বপ্ন দেখি ঘোড়ায় চড়ে কোনদিন এক রূপকথার রাজকণ্যা আসবে, আর আমাকে মশারি টাঙ্গানোর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবে, চুলে বিলি কেটে দেবে আর আমার সাথে বসে সারাদিন মুভি দেখবে!
হে নারী
"কেও যদি তার চারপাশের নারীদের রাণী'র মত সম্মান করে, তাহলে বুঝতে হবে সেও নিশ্চই কোন রাণী'র কাছেই লালিত পালিত হয়েছে।"
- আমার খুব প্রিয় একটি কোটেশন।
মমতাময়ী নারী; আমার মা; যার কাছেই আমার সব আশ্রয়। আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া নারী, দুঃখ দিয়ে যাওয়া নারী, সুখচ্ছবি আঁকতে শেখানো নারী; সব নারীর জন্যই আমার অকৃত্তিম শ্রদ্ধা, ভালবাসা।
আজ, নারীর রাজ্যেই আমার পৃথিবী পদ্যময়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৫