চলমান টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইন্ডিয়া; পাকিস্তান’কে হারানোর পর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসঃ
Yesssss........We did it again !!!! The history remains unchanged........
& this is our pride !!!
Once again we fucked bloody, porki fuckistan into every of its holes as usual !!!
Thanks to Team India for this awesome win !!
Jay Hind !!!!
ভাবছেন, এই জয়োচ্ছ্বাস কোন টিপিকাল মহান ভারত মাতার সন্তান দ্বারা প্রসূত হয়েছে? না পাঠক, আপনার ভাবনা ভুল।
আচ্ছা বলুন তো, গ্রীক কিম্বা ঈজীপশিয়ান মিথের মতো হিন্দু মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রীতিও কি মিথ? মানুষের কল্পনায় বিমুর্ত হওয়া মিথলজীর মত; রাজনৈতিক বিষবাষ্পে এই সম্প্রীতিও কি এখন রূপকথা?
‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোঁড়ে বাণ,
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন এক হিন্দু পরিবার। ওই আঙ্কেলের বাবা’কে ডাকতাম দাদু; আর মা’কে দিদিমা। কি যে আদর করতেন আমাদের তিন ভাই কে! আমার মাকে দেখতেন নিজের মেয়ের মত। বিপদে আপদে চোখ বন্ধ করে আমরা তাদের ওপর ভরসা করতাম, তারা ছিলেন যেমন বিনয়ী তেমনি হৃদয়বান মানুষ। সারা বছর খুব লোভ নিয়ে অপেক্ষা করতাম কবে পূজা আসবে আর কবে চেখে দেখবো দিদিমার হাতের অসাধারন সেই লাড্ডু, তিলের নাড়ু, নারিকেলের বরফি আর ঘন করে জ্বাল দেয়া দুধ দিয়ে বানানো ক্ষীরের পায়েস!! দাদু হঠাত করেই মারা গেলে নিজের দাদা’কে হারানোর কষ্ট পেয়েছিলাম। ভাস্কর, ঐ বাড়ির ছেলে, আমাদের বাসার করিডোরে ক্রিকেট খেলার সাথী। স্কুল শেষ করেই চলে আসত আমাদের বাসায়; আর ছুটির দিনগুলোতে সারাদিন; একসাথে হৈচৈ আর খেলাধূলা। ওর ছোট বোন আর পিচ্চি মামাতো বোনগুলো বড় হয়েছে আমাদের কোলে কোলে। দুই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা থাকতো সারাদিন। আধুনিক নগরের নাগরিক জীবনে এরকম আপন এমন প্রতিবেশী পাওয়া আমাদের জন্য ছিল স্বস্তির আর সৌভাগ্যের। ১০ বছর পাশাপাশি থেকেছি আমরা।
তারপর একদিন হঠাত করেই ভাস্করের পিচ্চি বোনগুলো নাই হয়ে গেল। কোথায় গেল তারা? তাদের ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে ভারতের কোন এক বিখ্যাত স্কুলের বোর্ডিংএ। যাওয়ার আগে একবার আদর করে দিতে পারলাম না দেবশিশুর মতো দেখতে সেই পিচ্চিগুলোকে। মন খারাপ হয়েছিল খুব। তার বছর খানেক পরে এই প্রিয় প্রতিবেশীরা বাসা চেঞ্জ করে চলে গেল অন্য জায়গায়। যোগাযোগ কমে গেল। খুব মিস করতাম দিদিমা’র হাতের স্বর্গীয় প্রসাদ গুলো আর ভাস্কর’কে। শুনেছিলাম সেও ভারতেই ভর্তি হয়েছে।
কলেজে উঠে পদার্থবিজ্ঞান পড়তাম বিজন স্যারের কাছে। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছাপিয়ে তার পরিবারের সাথে গড়ে উঠেছিল পারিবারিক সম্পর্ক। হিন্দু’দের ফেরেশতার মত মানুষ বলা যায় কিনা জানি না, কিন্তু স্যার ছিলেন তাই। আমার আব্বা’র পর এরকম সৎ এবং নীতিবান মানুষ দেখেছি খুব কম। তার মতো শ্রদ্ধা জীবনে অন্য কোন শিক্ষক’কে করেছি কিনা মনে পড়েনা।
আমার প্রিয় বন্ধু শেখরের বাবা সমরেন্দ্র সরকার। পরিশ্রমী এবং তার গ্রামের প্রভাবশালী একজন মানুষ। কিন্তু জীবনে কেউ কখনো শোনেনি তাকে উচু গলায় রাগত স্বরে কথা বলতে। ভদ্রলোক এবং ভাল মানুষ বলতে তার মত মানুষকেই বোঝায়। আমাকে যেবার পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, সেসময় গভীর রাতে এই আঙ্কেলই সবার আগে হাজতে গিয়েছিলেন আমাকে ছাড়িয়ে আনতে।
১৯৭১ সাল। পাক বাহিনীর অত্যাচারে নারায়ণগঞ্জের অনেক হিন্দু পরিবার তখনো নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেনি। আমার নানা সরকারী চাকুরে হওয়ায় তার উপর নজরদারী ছিল কম। এই সুবাদে নিজের ও নিজের পরিবারের জীবনের ঝুকি নিয়ে তিনি তার বাড়ীর গুদামে আশ্রয় দিয়েছিলেন বেশ কিছু হিন্দু পরিবারকে। যুদ্ধকালীন সেই সময়টাতে আমার নানা তাদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতায় অনেক হিন্দু নারী তার পা ছুয়ে বলেছিলেন, আজ থেকে আপনি আমার বাবা।
তোদেরি আঘাতে টুটেছে তোদের মন্দির মসজিদ,
পরাধীনদের কলুষিত ক’রে উঠেছিল যার ভিত।
বহুদিন পরে ফেসবুকের কল্যাণে যোগাযোগ হোল ভাস্করের সাথে! সেই পুরোন উচ্ছ্বাস, পুরোন স্মৃতি! ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। কমেন্টস, মেসেজ, লাইক আদান প্রদান। কিছু কিছু স্ট্যাটাসে ভ্রু কুচকে উঠলেও ইগনোর করে গেছি নিঃশ্বঙ্ক চিত্তে।
উপরের এফবি স্ট্যাটাসটি ভাস্করের। আমি খুব অবাক হয়ে নিচে কমেন্ট করলাম,
“ “WE” ?? পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা- ঠিক আছে, তাই বলে “জয় হিন্দ”? আমিও ইংল্যান্ডকে ঘৃণা করি আমাদের ২০০ বছরের দাসত্বের জন্য, পাকি’দের ঘৃণা করি ৭১’এর কাপুরুষতার জন্য, আমার ভাইয়ের রক্ত আর বোনের সম্মানের আজো উপযুক্ত মূল্য না দেয়ার জন্য; এবং এখন তারচেয়েও বেশি ঘৃণা করি ইন্ডিয়াকে; বর্ডারে কুকুরের মত আমাদের মেরে ফেলার জন্য, পানি বন্ধ করে দেশকে কারবালায় পরিণত করার জন্য আর অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশকে শোষণ করে পঙ্গু করে দেবার চক্রান্তের জন্য। কিন্তু এদের কাউকে কেউ হারালে “We did it” বলি না! Nationality change করে ফেল্লা নাকি ভাস্কর?”
“ইন্ডিয়া বাংলাদেশের জন্মদাত্রী মা”
তারপর মেসেজ বক্সে যে বিশাল উত্তর টা পেলাম, তার জন্য আমি তৈরী ছিলাম না।
“শোনেন, ইন্ডিয়া না থাকলে বাংলাতে আর চ্যাট করা লাগতো না। এই যে বাংলাতে আপনি ন্যাশনালিটী নিয়ে এত বড় বড় ডায়লগ দিচ্ছেন, তা আর দিতে হোতনা, ভাইয়া। ইন্ডিয়া যদি সাহায্য না করতো, বাংলাদেশের জন্মই হোতনা কোনদিন। সেইজন্যই আমাদের ইন্ডিয়ার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
ইন্ডিয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জন্মদাত্রী মায়ের মতো! We did it- তো আপনারা আগে বলতেন যখন পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ জিততো! তখন লজ্জা লাগতো না? মাদার চোদ’দের জন্য যখন গলা ফাটিয়ে চিতকার করতেন! এই বেজাত যদি ভাই হয় আপনার, তাহলে ইন্ডিয়া অনেক ভাল।
আপনার বেজাত ভাইয়েরা হেরেছে দেখেই আজকে আপনার মধ্যে জাতীয়তা জেগে উঠেছে। পাকিস্তানের চেয়ে ইন্ডিয়া অনেক ভাল। একদিক থেকেই ইন্ডিয়াকে খারাপ লাগতে পারে আপনার, তা হোল; ইন্ডিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। Not that brutal Islamism like ur brotherhood fuckistan! শান্তির ধর্ম ইসলামের কাভারে ইন্ডিয়া গণতন্ত্র ধ্বংস করেনা।”
অগ্রজপ্রতিম আমার প্রতি এই ঘৃণা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! পাকি’দের সাপোর্ট না করেও বেজাত গালি শুনলাম শুধু মুসলিম বলেই?
সমরেন্দ্র আঙ্কেল; বিপদে আপদে তার কাছেই সমাধানের জন্য আসে সবাই, তিনি এলাকার গন্যমান্য মানুষ বলে। তার গ্রামে মসজিদের জন্য বিনা শর্তে ছেড়ে দিলেন নিজের জায়গা। এখন সেই মসজিদের ইমাম সাহেবই তার বিরুদ্ধে বিষেদগার করেন যখন তিনি মহা সমারোহে পূজা’র আয়োজন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে যখন ধীরে ধীরে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে বেড়ানো পরিবার গুলো ফিরতে শুরু করলো নিজের ফেলে যাওয়া বাড়ীতে, তখন অনেকেই আবিষ্কার করলো; লুট হয়ে গেছে সবকিছু। আমাদের পরিচিত এক হিন্দু পরিবারকে আপ্যায়িত করা হোল তাদের কাপেই চা, আর তাদের গ্লাসেই পানি দিয়ে! ওই লুটেরা মুসলমান পরিবারটির কি লজ্জা ছিলনা একবিন্দুও?
উঠেছে কাফের, উঠেছে যবন;
উঠিবে এবার সত্য হিন্দু-মুসলিম মহাবল।
জেগেছিস তোরা, জেগেছে বিধাতা, ন’ড়েছে খোদার কল।
বিজন স্যার জায়গামত তোষামদ করেননি বলে অবসরের আগ মুহূর্তে তাকে যেতে হয় নানা হয়রানির ভেতর দিয়ে। ভারতে থাকা সব আত্মীয় স্বজন সেখানে হাজার বার চলে আসতে বললেও স্যার যাননি। এমন কি দেশে ভুল চিকিতসায় একমাত্র ছেলেটি মরে যাবার পরেও না।
শেখরের বিয়ের আশীর্বাদ; লাইলাতুল কদরের পরদিন দুপুরে। ঢাক ঢোল, সানাই আর কাসা নিয়ে ব্যান্ড পার্টি’র হুলুস্থুল। কিন্তু ওর বাবা সমরেন্দ্র সরকার থামিয়ে দিলেন সব বাজনা। কারণ, সারা রাত ইবাদাত করে এখন এই দুপুরে মুসলিমরা ঘুমুচ্ছে, তাদের কষ্ট হবে আওয়াজে। আমার শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল।
আব্বার অপারেশনের সময় রক্ত লাগবে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। টেনশনে আমাদের মাথা খারাপ অবস্থা। পাগলের মত ছোটাছুটি করছে সবাই। রক্ত নেই! রক্ত নেই! কি করবো? বিপদে ত্রাতা হিসেবে আল্লাহ পাঠালেন দুইজন হিন্দু ভদ্রলোককে। কার পরিচয়ে, কত দূরের, অপরিচিত দুজন মানুষ আত্মীয়তার বেড়া ডিঙ্গিয়ে রক্তের বন্ধনে জড়িয়ে গেলেন!
কে কাহারে মারে, ঘোচেনি ধন্দ, টুটেনি অন্ধকার,
জানে না আঁধারে শত্রু ভাবিয়া আত্মীয়ে হানে মার!
আরেক অনুজপ্রতিম মেডিকেল পড়ুয়া অঞ্জন। সে বলছে, ভাই, ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দেব; ভয় লাগে। আমাকে যদি কেউ ইসলাম বিরোধী ছবিতে ট্যাগ করে, আর সবাই ভুল বুঝে যদি আমাকেই মারে?
আমার কিছু বলার ছিল না।
আমরা হিন্দু মুসলিম সবাই; অজান্তেই মৌলবাদী হয়ে যাচ্ছি। আমাদের ধর্মবোধ প্রবল কিন্তু আমাদের ধর্মশিক্ষা নেই। আমরা ধ্বংসাত্বক টাইম বোমার মত ঘৃণা বহন করে চলছি আজ; আমাদের অজ্ঞাতেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১২ সকাল ১০:৪৪