খুব সাধারন এই সিনেমাটার গল্প একজোড়া প্রাণোচ্ছল তরুণ তরুণী আর তাদের ছোট্ট একটি সন্তান কে নিয়ে।
হুমম…তাহলে এই গল্প আমার গল্প হয় কিভাবে?
মানুষের জীবনে একটা পর্যায়ে পেছন ফিরে তাকালে কিছু কিছু স্মৃতির তরঙ্গ; সেলুলয়েডের সাদাকালো ফিতার মত মনে হয়। এই সিনেমাটা দেখতে দেখতে আমার নিজের কিছু স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছিল; যেন অনেক আগে দেখা কোন প্রিয় সিনেমার টুকরো টুকরো ফ্রেমের নস্টালজিয়া। তাই, এই লেখাটি আসলে একটি সিনেমা’র গল্প; অথবা আমার গল্প!
Declaration of War
নাইট ক্লাবে হাই বিট মিউজিক আর উদ্দাম নাচ, হঠাত চোখাচোখি, বাস্তবের (সিনেমা’র) রোমিও – জুলিয়েট। প্রথম দেখাতেই পাগলের মত প্রেম; আর প্রথম প্রশ্ন – “আমাদের ভাগ্যও কি রোমিও জুলিয়েটের মত ভয়াবহ?” কে জানে আর কেই বা কেয়ার করে? ভাগ্যের কথা চিন্তা করে প্রেমে পড়েছে কে কবে? উদ্দাম প্রেম আর তরুন প্রাণের উচ্ছাসে পাগলপারা ভালবাসা। যেন ৯ নাম্বার মেঘে চড়ে সপ্তম স্বর্গে আরোহন।
আচ্ছা; এই মুভির নাম এমন কেন?
রোমিও জুলিয়েট দম্পতির বাস্তবতার জমিনে পদার্পন; যখন জুলিয়েটের কোল জুড়ে এল ভালবাসার স্মারক; ছোট্ট এডাম। হিমসিম খেতে লাগলো দুই তরুণ তরুনী যখন তারা নিজেদের আবিস্কার করলো মা বাবা’র ভূমিকায়! ধীরে ধীরে সন্তান মানুষ করার এই মহা দায়িত্বের সাথে মানিয়ে নিল তারা আর বড় হতে লাগল এডাম। কিন্তু তাদের ভ্রু কুচকে উঠতে লাগল এডামের নিয়মিত কিছু অসুস্থতায় আর তখনো হাটতে না পাড়ার অক্ষমতায়। ডাক্তারও চিন্তিত হয়ে পড়লেন যখন দেখলেন এডামের মুখের একপাশ পার্সিয়াল প্যারালাইজড। ঠিক আমার বাবার মত। যিনি প্রায়ই অফিসে যাবার সময় কিম্বা সিড়ী দিয়ে নামার সময় ব্যালান্স হারিয়ে ফেলতেন।আর মাথার পেছন অনুভব করতেন কেমন একটা অবশ ভাব। এডামের ডাক্তার সাথে সাথে তাকে রেফার করলেন নিউরোসার্জন এর কাছে।
তখন ২০০১। আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার টেস্ট সামনেই। বাবাকে অনেক ডাক্তার দেখান হল, অনেক ওষুধও খাওয়ানো হল।কিন্তু অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে লাগল। কোন ডাক্তারই এর কারন বের করতে পারলেন না, এমন কি অন্য স্পেশালিস্টের কাছে রেফারও করলেন না!পরে এক আত্বীয়ের পরামর্শে নিউরোসার্জনকে দেখান হল। করানো হল সিটি স্ক্যান এবং ধরা পড়ল খুব ক্রিটীক্যাল পজিশনে একটি টিউমার; ব্রেন টিউমার! শিরদাড়া বেয়ে নেমে যাওয়া ঠান্ডা সেই অনুভূতিটা আজো অনুভব করতে পারি। রোমিও জুলিয়েট আর তাদের পরিবার, বন্ধুদের এই আকস্মিক দু;সংবাদের বুলেটের মত আঘাত আর অদম্য আবেগের নাটুকে বহি;প্রকাশ আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়নি মোটেও। দু;সময়ে সামনে এসে দাড়ায় দায়িত্ববোধ, ঠিক করা হয় কর্মপন্থা। ঘোষণা দেয়া হয় যুদ্ধের। ঠিক যেমনি দিয়েছিল আমাদের পরিবার। যে যুদ্ধে একবিন্দুও ছাড় দেয়া হবেনা মৃত্যুকে।
অপারেশন দেশে হবে নাকি বাইরে, সবচেয়ে দক্ষ সার্জনের সিরিয়ালের দীর্ঘ অপেক্ষা, সর্বাধুনিক চিকিতসা আর সামর্থের অসহায় অসঙ্গতি – এইসব কত টেনশন !! তর্ক বিতর্ক শেষে আর আর্থিক দিক চিন্তা করে; পরম করুনাময়ের উপর ভরসা করে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রাখা হোল ঢাকা পিজি হাসপাতালের আধুনিক আই.সি.ইউ আর প্রতিভাবান কিন্তু পাগলা ডাক্তার ড; রশীদউদ্দিনের উপর।
বহু কষ্টে পাওয়া গেল একটা কেবিন। তারপর অপারেশনের সিরিয়ালের জন্য পথ চেয়ে থাকা।আমি আর আম্মা কতদিন, কতসময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম ডাক্তারদের আসা যাওয়ার পথে টেস্ট রিপোর্ট গুলো একনজর দেখানোর জন্য! ব্যস্ত ডাক্তাররা হেটে যেতেন, আমি আর আম্মা তাদের পেছন পেছন ছুটতাম। তারা আশার বাণী শোনাতেন,”পেয়ে যাবেন সিরিয়াল, ধৈর্য ধরেন।” মিটার বাড়তে থাকে কেবিন বিলের, টেনশন আরো জাকিয়ে বসতে থাকে।দুপর আর রাতে ক্যান্টিনের লম্বা ডাল, সবজি আর ভাত, মাঝে মাঝে মাছ; যা বেশিরভাগ সময় আম্মা তুলে দিতেন আমার পাতে, অথবা আত্বীয় স্বজনদের নিয়ে আসা খাবার। কতদিন সন্ধ্যায় মৌলি রেস্তরার সামনে দাড়াতাম, আর শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতাম, থাক, আরেকদিন খাবো। বাকী ছোট দুই ভাই কয়দিন এই আত্বীয়ের কয়দিন ওই আত্বিয়ের বাসায়। পুরো পরিবার ছন্নছাড়া। আমার সময় কাটতো শাহবাগের ওভারব্রীজের উপর চলমান মানুষ আর গাড়ীর স্রোত দেখে। ওখানে খুজলে হয়ত এখনো পাওয়া যাবে আমার ফেলে দেয়া গোল্ডলিফের শেষাংস! রোমিও আর জুলিয়েটও যেন তাদের অলস বিষন্নতাকে ঢেকে দিতে চাইত ধোয়ার আবরণে।
এডামের অপারেশনের ডেট দ্রুতই পাওয়া গেলেও আমরা পেলাম প্রায় ২ মাস পর। রোগীকে প্রস্তুত করা হল অপারেশনের জন্য। চুল ফেলে দেয়া হল। আমার বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না তার সাধের গোফ জোড়া ফেলতে! সবুজ পোষাক পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে, এক অনিশ্চিত যাত্রায়। ওই তরুন দম্পতির মত আমরাও যানতাম না তাদের এডামের মত আমার বাবাও আবার ফিরে আসবেন কিনা ৯ ঘন্টার ম্যারাথন অপারেশনের পর। সব আত্বীয় স্বজন একসাথে তসবিহ পড়া, জড়িয়ে ধরে সাহস দেয়া আর আমার প্রায় ২০ জন বন্ধু; সবাই আমার সাথে। টেনশন দূরে সরিয়ে রাখতে নানা কথা, পত্রিকা আর মন মরা হাসাহাসি, সিগারেট।
একসময় অপারেশন শেষ হয়। কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যত, কারন ব্রেনের মত সংবেদনশীল স্থানে ছুরি চালানো অনেক বড় একটা ঝুকি। কোন নিশ্চয়তা নেই, তার আবার আগের মত কাজ করার, পুরোপুরি সুস্থ হবার। অপারেশনের পরো প্রায় ১ মাস আমাদের থাকতে হল হাসপাতালে অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কায়।
পরম দয়াময়ের অসীম করুণায় মিরাকল ঘটীয়ে আমার বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হলেও এডামের ভাগ্য ততটা প্রসন্ন হয়না।ক্যনসার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্রেনের অন্যান্য জায়গায়। আবার শুরু করতে হয় সুদীর্ঘ আর কষ্টদায়ক কেমোথেরাপী। পৃথিবীর আনাচে কানাচে এডামের মত কত অসংখ্য ছোট্ট ছোট্ট এঞ্জেল গুলো ক্যান্সারের করাল থাবায় কষ্ট পাচ্ছে আর তাদের হতভাগ্য বাবা মা কি পরম আদরেই না তাদের আমৃত্যু আগলে রাখছে! কি সংগ্রামের ভেতর দিয়েই না তাদের দিনগুলো পার হচ্ছে প্রাণপ্রিয় সন্তান কে বাচিয়ে রাখতে!
এ ছবিতে স্পয়লার এলার্ট বলে কিছু নেই। ছবির শুরুতেই আমরা দেখতে পারি সেই ছোট্ট এডাম এখন বালক, যার সমস্ত নেশা গেম খেলায়। দীর্ঘ ৫ বছরের চিকিতসা শেষে গর্বিত ডাক্তার ঘোষনা করে, বহুদিন আগে তরুন বাবা মা রোমিও, জুলিয়েট আর ছোট্ট এডাম যে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে তাতে তারা জয়ী। তাদের মুখে ক্লান্ত হাসি, কিন্তু যুদ্ধ জয়ের গর্ব; আর বুকে মুক্তির ঘ্রান মাখা বাতাসে নি;শ্বাস।
পাঠক, খুব সাদামাটা এই সিনেমা আপনি দেখবেন শুধুমাত্র একটি গল্প শোনার জন্য। যে গল্প, বাস্তবতার বিপরীতে ভালবাসাকে বাজি রাখার গল্প। সাধারন মানুষের গল্প, আমাদের গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১২ দুপুর ২:১৯