আমি ছিলাম বর । বিবাহ সম্বন্ধে আমার মত যাচাই করাটা কেউ প্রয়োজন বলে মনে করিলো না । ডিগ্রী পরীক্ষায় টানা তিন বারের প্রচেষ্টায় আমি পাশ করিতে পারিনি । সুতরাং এমন গৃহপালিত গর্দভকে অতি শীঘ্রই বিবাহ দেওয়ার আয়োজন করা হইলো । অবশ্যি , মনে মনে বিবাহের জন্য অনেক আগে থেকেই আমার আগ্রহ ছিলো । ইতিমধ্যে borbodhu.com সহ বেশ কয়েকটি বিবাহ বিষয়ক ওয়েবসাইটে আমি আমার জীবনবৃত্তান্ত পেশ করিয়াছি । যদিও আমার মতো গর্দভকে বিবাহ করিতে কেহ আগ্রহ প্রকাশ করে নাই। ফলে পারিবারিক ভাবে নির্ধারিত বিবাহের প্রস্তাবে আমাকে সম্মত হইতেই হইল ।
আমার সাথে যাহার বিবাহ হইয়াছিলো আমি তাহার সত্য নামটি দিবনা । কারন উহার নাম প্রকাশ করিলে আপনারা ফেসবুকে সার্চ মারিয়া খুজিয়া লইতে পারেন ।
তবে, আমার এ লেখায় তাহার যেমন হোক একটা নাম চাই। তাহার নাম আমি দিলাম ‘ গুগলি ’ । কারন গুগলের মতো জগতের তাবৎ বিষয়ে ছিল তাঁর অসীম জ্ঞান । ছেলেদেরকে কেমন করে ‘লেবেঞ্ছুশ ’ বানানো যায় সে বিষয়ে ছিল তাঁর বিস্তর প্রতিভা।
তবু এইরকম একটা ‘প্রেমসম্রাজ্ঞী’ মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারন , মেয়ের চরিত্রের আকার ছোট বলিয়াই যৌতুকের পরিমান বড় ছিল । গুগলি আমার শশুরের একমাত্র মেয়ে । বাবার বিশ্বাস ছিল , কন্যার পিতার সমস্ত সম্পত্তি টাকা আমার ভবিষ্যতের কপাল খুলিয়া দিতেছে ।
আমার শশুর এই বিবাহ লইয়া অত্যান্ত আগ্রহি ছিলেন । তিনি ছিলেন শেয়ারমার্কেটের একজন উচু লেভেলের প্রতিষ্ঠিত বিনিয়োগকারী । ১৯৯৬ সালে তিনি একবার হার্ট এটাক করেন । স্বামীর হার্ট এটাক দেখিয়া স্ত্রীও হার্ট এটাক করেন । তবে তিনি টিকলেও তাঁর স্ত্রী টিকেন নাই। গুগলির মা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ মারা যান । মা মরা এই মেয়েটি প্রতি বৎসর অন্তর অন্তর একটু একটু করিয়া কু-চরিত্রের অধিকারী হইতে লাগিলো তাহা আমার শশুরের চোখেই পড়ে নাই ।
গুগলির বয়স যথাক্রমে ১৯ হইলো । কিন্তু ততদিনে তাহার প্রায় অর্ধশতাধিক প্রেমের অভিজ্ঞতা অর্জন হইয়া গিয়াছিলো । মোবাইল ফোনে আলাপ করিতে করিতে তাহার কর্ণছত্র বিবর্ণ হইবার উপক্রম হইয়া গিয়াছিল ।
তবে আমার বয়স আমি বলিবোনা ! আধবুড়া বয়সে আমার বিবাহ হইলো । ইতিমধ্যে আমার এক জুলফিতে হাল্কা পাক ধরিয়াছে । ইহার জন্য প্রতি সপ্তাহে কলপের অর্থ সংস্থান করিতে আমার বেশ বেগ পাহিতে হইতেছে ।
যা হউক, এক কুক্ষনে আসিয়া আমার বিবাহের দিন ঠেকিলো। যে দিনের জন্য আমার পরবর্তী জীবন ইভা রহমানের গানের মতো ‘বেসুরা’ ও সাহারা খাতুনের মুখের মতো ‘অন্ধকার’ হইয়া পড়িল ! তবে বিবাহ নামক এই অনুষ্ঠানের দিন আমি ইহার কিঞ্চিৎও টের পাই নাই । টের পাইলে আমি কভু এই ভুল করিতাম না। বিবাহের আসরেই বিষ খাইতাম !
বিবাহ সভার চারিদিকে হট্টগোল; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল । আমার মন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল , ‘পাইছি রে মামা , পাইছি , আর ছারুম না । ’ তখন পর্যন্ত আমি বিবাহের ব্যাপারে অত্যান্ত আনন্দিত ছিলেম ...... হায় !
আমার শশুরের নাম গৌরীশঙ্কর । বিবাহ শেষে কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে তিনি আমাকে ডাকিয়া বলিলেন ‘ বাবা তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলিয়া দিয়া আজিকে রাত্রে একটা খাসা শান্তির ঘুম দিবো । যে ধন আমি তোমাকে দিলাম , তাহার মুল্য বুঝিতে বুঝিতেই তোমার জীবনের ইতি ঘটিয়া যাইতে পারে।’
যাইতে যাইতে তিনি কহিলেন ‘ আমার মেয়েটির মাঝে মাঝে ড্রিঙ্কস করিবার বড়ই শখ হয় ! এবং মাঝে মাঝে বান্ধবীদের খাওয়াইতেও ভালবাসে ।এ জন্য তোমাদের বিরক্ত করিতে চাহিনা । বলিয়া তিনি আমার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক তুলিয়া দিলেন । এরপর হাসিমুখে গৃহত্যাগ করিলেন ।
আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম । মনে মনে বুঝিলাম ‘ইহারা অন্য জাতের মানুষ!’
বিবাহের দিনই বুঝিয়া গেলাম বড়োলোকের এই কন্যাকে বিবাহ করিয়া আমার কপাল খুলিয়া গিয়াছে । শশুরের টাকায় আমার বাকি জীবন কাটিয়া যাইবে চিন্তা করিতেই আমার তীব্র আনন্দ হইতে লাগিলো । সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয় , সে আমার সম্পদ রুপে আবির্ভূত হল ।
গুগলি... না, এ নামটা আমার আর ব্যাবহার করা চলিলনা । লোকে জানিলে জানুক, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাইলে পাঠাক; ইহাতে এখন আমার আর কী আসে যায় ? তাহার নাম ছিল ‘হৈমন্তী’ । আর ফেসবুকে তাহার নাম ছিল ‘PRINCES HOIMONTI’ ।তাহার ফেসবুকে ফ্রেন্ড ছিল ৪০০০ জনের আধিক । ফলে অনেকেই ইহাকে ফেইক আইডি মনে করিয়া ভুল ভাবিত।
আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে, লেখাপড়া জানা আধুনিক ঘরের মেয়ে, তাহার সাথে তাল মিলাইয়া চলিতে আমার কষ্ট হইবে । ঘটিলও তাই , এঞ্জেলিনা জোলির সামনে আমি শাকিব খান হিসাবে গণ্য হইলাম । নগণ্য হইলাম !!
এতো গেলো একদিকের কথা । আবার অন্য দিকও ছিল , সেটা বিস্তারিত বলার সময় আসিয়াছে।
আমার শ্বশুর শেয়ার বাজারে বিস্তর লস করিয়া দেউলিয়া হইবার উপক্রম ধরিলেন । ইহাতে তাহার টাকা পাঠাইবার ক্ষমতা শেষ হইয়া গেলো । ফলে হৈমন্তীরও ড্রিঙ্কস করিবার পথ বন্ধ হইয়া গেলো । এবং সাথে সাথে সংসারে অশান্তির আগুন ধরিয়া গেলো । ইহাতে সে ক্ষুব্দ হইয়া বলিলো ‘তোমাকে বিয়ে না করিয়া আমি যদি এক খানা কাঁঠাল গাছ কে বিয়ে করিতাম তাহলে ভাল হইতো, উহার কাঁঠাল বেচিয়া আমি ড্রিঙ্কস করিতে পারিতাম।’ এ সময় পাশে দাঁড়ান ছিলেন আমার বাবা। বাবার ছিল বহুমুত্র (ডায়বেটিক্স) ও উচ্চ রক্তচাপ (হাই প্রেশার) । ইহা শুনিতে পাহিয়া বাবার উচ্চ রক্তচাপ ‘নিম্নচাপে’ পরিনিত হইয়া তাহার অন্তরে প্রবল ঝড় তুলিল। বহুমুত্র মারাত্মক রুপে বাড়িয়া উঠিলো এবং আমরা ইন্সুলিন খোঁজারও সময় পাহিলাম না। ইহার পূর্বেই বাবা গত হইলেন ।
এদিকে টাকা না পাহিয়া হৈমন্তী পাগলের মতো আচরন করিতে লাগিল । সেলবাজারের মাধ্যমে সে আমাদের ঘরের আসবাবপত্র বিক্রয় করিয়া ড্রিঙ্কস করা শুরু করিলো ,ঘরের সবকিছু বেচিতে বেচিতে শুধু এক খানা পালঙ্ক ও টেলিভিশন বাদ রাখিলো । পালংকের অভাবে আমার মা মাটিতেই ঘুমাইতে লাগিলেন আর ফ্রিজের অভাবে তাহার সংসার জীবন দুঃসহ হইয়া উঠিল । তাহার পরেও মা কিছু বলিলেন না । কারন এত ঝামেলার পরও সন্ধ্যা পরে তিনি আরাম করে কলকাতার সিরিয়াল দেখিতে পারিতেন । তাই সব মুখ বুজিয়া সহ্য করিয়া গেলেন !
অবশেষে হৈমন্তী আর কিছু না পাইয়া টেলিভিশন খানাও বিক্রয় করিয়া ফেলিলো। ইহাতে আর আমার মা চুপ থাকিতে পারিলেন না। কারন আমার মার ‘স্টার জলসা’ ও ‘জি বাংলার’ সিরিয়াল দেখা বন্ধ হয়ে গেলো । তিনি তেলে-বেগুনে জলিয়া জীবন্ত ‘বেগুনিতে’ পরিনিত হইলেন !! ফলস্বরূপ আমার নিজ গৃহেই ‘কলকাতার সিরিয়াল’ শুরু হইয়া পড়িল । ইহা টিভিতে দেখিলে তবু সহ্য করা যায় , কিন্তু, বাস্তবে সহ্য করা যায়না । যাহার ফলে আমার বাঁচিবার সাধ মিটিয়া গেলো । এবং এক বিকালে আমি পৃথিবী হইতে লগ আউট করিবার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
আমার মৃত্যুর এখনও বিশ দিনও পার হয় নাই । কিন্তু শুনিয়াছি হৈমন্তী ইতিমধ্যে পাত্রের সন্ধানে বাহির হইয়াছে । ফেসবুকের মাধ্যমে সে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন কে সিলেক্ট করিয়া ফেলিয়াছে । থাক এসব বলে আমার আর লাভ কি । তবে আপনারা উহার ব্যাপারে সাবধান থাকিবেন । বিদায় ।
সহযোগিতায়ঃ নাদিম হক ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৫:৪১