জন্মের পরপরই ছেলের সাথে আমার চেহারার বিন্দু-বিসর্গ মিল না পেয়ে অবাক হয়ে সাথীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কই আমার তো কিছুই পেল না সে। তোমার নাক পেয়েছে। হাতের আঙুলগুলোও তোমার মতো। ছেলে বুঝি আমার মতো হবে না?
প্রবোধ দিয়ে সাথী বলেছিল, হবে নিশ্চয়ই। কয়েক মাস পরেই সবাই বলবে একেবারে বাপকা ব্যাটা। চিন্তা কর না।
তারপর থেকে চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম প্রায়।
কিন্তু সেদিন সকাল বেলা পাশের বাড়ীর রায়হান সাহেবের সাথে পরিচয় হবার পর চিন্তাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। রায়হান সাহেবকে দেখা মাত্রই মনে হল লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছি। কথাটা তাকে জানাতেই তিনি বললেন, দেখেছেন হয়তোবা। আমি তো আপনাদের পাড়ায় এসেছি প্রায় এক বছর হয়ে গেল।
সাথীর কাছে অসংখ্যবার রায়হান সাহেবের নাম শুনেছি, তার গানের গলার খুব প্রশংসাও শুনেছি, এমনকি এটাও জেনেছি যে সাথী মাঝে মাঝে বিপত্নিক রায়হান সাহেবের কাছে গান শিখতে যায়। হতে পারে। আটটা-সাতটা অফিস জীবনে এক বছর ধওর পাশাপাশি থাকা একটা লোকের সাথে সামনাসামনি পরচিয় না হলেও, দূর থেকে এক ঝলকের দেখা হতেই পারে। তখনই হয়তো চেহারাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। মনকে প্রবোধ দিয়ে বাসায় ফিরে ছ’ মাস বয়েসি বাবুটার দিকে তাকিয়েই নিশ্চিত হলাম, আমি রায়হান সাহেবকে আগে দেখিনি, দেখেছি বাবুকে। বাবুর সাথে রায়হান সাহেবের চেহারার এতো মিল দেখে বুকের ভেতরটা কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। সাথে সাথে সাথীকে ডাকলাম।
-আচ্ছা সাথী, রায়হান সাহেব কবে জানি এ পাড়ায় এসেছেন?
-তা তো প্রায় বছর হতে চলল।
-তোমার সাথে পরিচয় কবে থেকে?
-প্রথম দিনই তো আমাদের বাসায় এসে তার পরিচয় দিয়ে দিয়াশলাই কাঠি চাইলেন।
- তারপর থেকে তোমার সাথে আর ক’বার দেখা হয়েছে?
-অনেক বার। এটা সেটা চাইতে তো প্রায়ই আসতেন তিনি বাসায়। আর তাছাড়া যখন জানলাম উনি গানের টিচার, তখন থেকে তো তার কাছে ব্যাচে গান শিখতে যেতাম সপ্তায় তিনদিন। তুমি তো জানো এসব। আজ হঠাৎ এ প্রসঙ্গ?
হ্যা, আমি জানতাম। আমিই সাথীকে বলেছিলাম তোমার একা একা যখন সময় কাটে না তখন গানটা আবার চর্চা করলেই পার। এখন বুঝতে পারছি সবার সাথে বিশেষ করে নিজের বউয়ের সাথে অতোটা উদার হতে নেই।
আশীষকে কল দিলাম।
-দোস্ত তোর সাথে কথা ছিল। ঝটপট দুলাল স্টোরে চলে আয় ।
দুলালের চায়ের দোকান হল আমাদের আড্ডা দেয়ার জায়গা। ওখানে বসে আমরা বন্ধুরা মিলে সুখ-দুঃখের আলাপ করি।
আশীষকে বাবুর সাথে রায়হান সাহেবের চেহারার মিলের কথা জানালে সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল রায়হান সাহেবের ফিগার আকর্ষণীয় কি না। রায়হান সাহেবের সাথে দেখা হবার সময় ব্যাপারটা অতোটা খেয়াল না করলেও এখন চোখের সামনে তার যে ছবি ভেসে উঠল তাতে তাকে রীতিমতো একজন বডি বিল্ডার বলে মনে হল আমার। ব্যাপারটা আশীষকে জানালে সে আমার স্বাস্থ্য বিষয়ক অসচেনতার কথা বলে যথেষ্ট খোঁচা দিল এবং জানালো জগতে খাওয়া দাওয়াই না কি সব কথা নয়, আসল হল শরীরটাকে ফিট রাখা। আমার মতো একটা বুদ্ধু নাকি সে এ জন্মে আগে কখনো দেখেনি। সে লেকচার থামালে তার নিজের ওভারওয়েইটের কথা জানিয়ে তাকে সতর্ক করে দিয়ে নির্দেশ দিলাম অন্যদের চরকায় হাত দেয়ার আগে সে যেন নিজের চরকায় তেল দেয়। তখন সে খুব চটে গেল। আমার উপর না, রায়হান সাহেবের উপর। রায়হানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে তাকে এ তল্লাটে থেকে চিরতরে বিদায় করার সিদ্ধান্তের কথা জানাল। তখনই আামাদের ত্রিরত্নের অপর রত্ন যার ওভার ওয়েইটের কারনে সবাই তার পিতৃপ্রদত্ত রাসেল নাম ভুলে গিয়ে আড়ালে গোলআলু নামে ডাকে এসেই ধপ করে পাশের খালি চেয়ারটাতে বসে পড়ল। তার এমন হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়া দেখে আমরা দুজন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তার দিকে তাকালাম। সে জানাল ফেন্সির সাথে নাকি তার ব্রেক-আপ হয়ে গেছে। ফেন্সি তার গার্লফ্রেন্ড এবং তাদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারটা প্রায় পাকাপাকিই হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ এমন একটা খবরে দুজনেই আকাশ থেকে পড়লাম। কারন জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, ফেন্সি তার প্রতিবেশি রাকিব নামের একটা ছেলেকে ভালবেসে ফেলেছে। শুধু তাই না, সে রাসেলকে জানিয়েছে রাসেলের মতো মোটা কোন মানুষকে বিয়ে করার চাইতে সারাজীবন অবিবাহিত থাকাই নাকি শ্রেয়তর। ফেন্সির এমন কথা শুনে আমি আর আশীষ- দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের মনে পড়ল ফেন্সির সাথে দেখা হবার সময় একখানা ফিগার ছিল বটে রাসেলের! নিয়মিত জিম করত এবং মাপা ডায়েটের খাবার খেত সে। অন্যদিকে ফেন্সির ছিল রান্নাবান্নার খুব শখ। অন্যকে মজার মজার খাবার খাইয়ে সে খুব আনন্দ পেত। রাসেল ফেন্সিকে খুশি করার জন্যই প্রতিদিন ফেন্সিদের বাসায় গিয়ে তার তৈরী করা নতুন নতুন খাবার খেত। তাইতো আজ ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি রাসেলের ওজন ৮৫ কেজি। যে ফেন্সির জন্য আজ রাসেলের এ অবস্থা হল সেই ফেন্সিই রাসেলের মোটা শরীরের দোহাই দিয়ে কেটে পড়ল। মেয়েরা বুঝি এমনই হয়! ফেন্সির কথা আর কিইবা বলব। আমার সাথী যে তার থেকেও ভয়াবহ অন্যায় করেছে। রাসেলকে কি বলে সান্ত্বনা দেব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিজের দুঃখ যে মোচন করতে পারে না, তার আবার পরেরটা নিয়ে মাথা ব্যথা কিসের?
গভীর রাতে এলোমেলো ভাবনায় ঘুম আসল না যখন তখন সিদ্ধান্ত নিলাম সাথীকে ক্ষমা করে দেয়া যাক এবার। ক্ষমাই পরম ধর্ম। তাছাড়া সাথীকে এতোটা ভালবাসি, তার সাথে না থাকার কথা কল্পনাই করতে পারি না যখন তখন ক্ষমা ছাড়া আর কিইবা করার আছে আমার। ভাবলাম বিষয়টা ভুলে যাওয়া যাক এবার। সাথীকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। না, কাল থেকে নিয়মিত জিম করার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। সাথী হাসল। হেসে জানালো সিদ্ধান্তটা খুব ভাল তবে সে আমাকে এমন নাদুস-নুদুস দেখতেই পছন্দ করে।
ভুলতে গিয়েও পরদিন আরো বেশি করে রায়হানের কথা মনে পড়ে। ঘেন্না ধরে যায় নিজের প্রতি। এতো বড় একটা অবিচার আমি মাথা পেতে নিচ্ছি কেন? কেন এবং কবে এতটা কাপুরুষ হয়ে গেলাম? সাথীকে ডাকলাম। বাবু তখন আমার কোলে। দাঁতে দাঁত চেপে সাথীকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবুটা দেখতে কার মতো হয়েছে।
সাথী অনেক ভেবে বলল, তোমার যে একটা চাচা ছিল বলেছিলে, ঐ যে তোমার দাদা ত্যাজ্য করেছিল যাকে আমার তো মনে হয় বাবু তার মতোই হয়েছে।
রহিম চাচার কথা আমি একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। বিধর্মী একটা মেয়েকে বিয়ে করায় দাদা তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। শুনেছিলাম তিনি নাকি ভারতে চলে গেছেন। তারপর থেকে তার আর কোন খবর আমরা জানি না। তাই রহিম চাচার কথা সাথীর মুখে শুনে আশ্চর্য হলাম।
-রহিম চাচার মতো? নাহ! আমার মনে হয় না। আর কারো মতো হবে।
-সেদিন তোমাদের পারিবারিক অ্যালবামটা দেখছিলাম তো। হঠাৎ রহিম চাচার ছবিটা চোখে পড়ায় মনে হল আমাদের বাবুটা তার চেহারা অনেকখানি পেয়েছে।
-নাহ! কী যে বল!
মনে মনে সাথীর নিখুত অভিনয় দেখে মুগ্ধ আর অবাক হচ্ছিলাম। এতো নিখুঁত অভিনয় করে কিভাবে সে? তার মনে কি বিবেকবোধ বা নীতি বলতে কিছু নেই?
না থাক। আমার তো আছে। আমি সাথীকে ভালবাসি। তাকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারব না আমি।
আরেকদিনের কথা। বাবুকে নিয়ে খেলছিলাম তখন। এমন সময় সাথী এক থাল পিয়াজু হাতে নিয়ে আসল।
-একটা কাজ করতে পারবে?
-কী কাজ?
-রায়হান স্যার না পিয়াজু খুব পছন্দ করেন। উনার বাসায় এটা দিয়ে আসতে পারবে। উনার সাথে কখনো তোমার দেখা হয়নি। এই সুযোগে দুজনার দেখা হয়ে যাবে।
-দেখা হয়নি কে বলল? দেখা হয়েছে তো। দেখা হওয়াটাই পাপ হয়েছে।
-কি বললে! দেখা হয়েছে? সাথীকে যথেষ্ট উত্তেজিত ও খুশি মনে হল।
-হু, কয়েকদিন আগে রাস্তায় দেখা হয়েছে।
-তাহলে তো ভালই হল। এগুলো দিয়ে আসো না প্লিজ!
-ওকে যাচ্ছি। বাবুকে কোলে নাও; মনে হয় ঘুমিয়ে পড়বে।
বাবুকে সাথীর কোলে দিয়ে রায়হান হারামজাদাটার বাসায় গেলাম। এমন পোড়া কপাল আমার! যাকে ঘুণা করি, যে আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে তাকে নিজ হাতে পিয়াজু খাইয়ে দিচ্ছি! কলিং বেল চাপার বেশ খানিক্ষণ পরে রায়হান দরজা খুলল।
-স্যরি। গোসলে ছিলাম তো, তাই দরজা খুলতে দেরী হল। আসুন সুমন সাহেব। ভেতরে আসুন।
-সাথী আপনার জন্য এটা পাঠিয়েছিল।
-সাথী কেন যে এসব পাগলামি করে বুঝি না। দিন। বসুন। আমি থালটা ফেরত দিচ্ছি।
থাল নিয়ে রায়হান ভেতর রুমে চলে গেল। আমি বসে বসে তার পরিপাটি করে সাজানো ড্রয়িং রুমটা দেখতে থাকলাম। হঠাৎ ভেতর থেকে মোবাইলের রিংটোন শোনা গেল। আমি পা টিপে টিপে ভেতর দরজার দিকে এগুলাম।
-হাই, সাথী ডার্লিং!
সাথী? ডার্লিং! মেজাজ আমার মুহুর্তে সপ্তমে চড়ে গেল। তবু মেজাজ হারালাম না। কি কথা হয় শুনার জন্য ভাল করে আড়ি পাতলাম।
-কি, এখনই দেখা করতে হবে?
-কোথায়? আগ্রা চাইনিজে? ওকে নো প্রবলেম। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে চলে আসছি সোনা।
রায়হান ফিরে আসছে। আমি আবার জায়গায় গিয়ে বসলাম।
-কিছু মনে করবেন না সুমন সাহেব। আমাকে একটু বেরুতে হবে। নয়তো বা আপানাকে চা খাওয়াতে পারতাম।
-না না। ঠিক আছে। আমার নিজেরও একটু তাড়া আছে।
আমি বের হয়ে আসলাম। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে দেখি, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। সাথী ও বাইরে যাবার জন্য তৈরী।
-কোথাও যাবে নাকি?
-হু। রানী কল করেছিল। ওর নাকি কী একটা কাজে আমাকে খুব দরকার। বেশি সময় নেবো না। তাড়াতাড়ি চলে আসব। বাবু ঘুমিয়েছে। ওকে দেখে রেখো।
রানী, না ছাই? আমি তো ঠিকই বুঝতে পেরেছি। তুমি রায়হান সাহেবের সাথে দেখা করতে যাবে।
বললাম, না গেলে হয় না আজ?
-না, রানী রাগ করবে। খুব দরকার। ওর সাথে দেখা করতেই হবে। বাবুর ফিডারটা টেবিলের উপর রাখা আছে। ঘুম ভাঙলে খাইয়ে দিও।
সাথী চলে গেল। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। ভালই হয়েছে। ছেলেদের চোখের জল কখনও মেয়েদের দেখাতে নেই। এতে তারা আরো মাথায় চড়ে বসে। সাথী অবশ্য ইতিমধ্যেই মাথায় চড়ে বসেছে। তাকে শীঘ্রই নামাতে হবে। মাথা থেকে নামিয়ে একেবারে পায়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আজই তার উপযুক্ত সময়। দেরী না করে আশীষকে কল দিয়ে বললাম তার গাড়ীটা নিয়ে আসতে।
আশীষ যথাসময়ে আসল। ঘুমন্ত বাবুকে কোলে নিয়েই গাড়িতে চেপে বসলাম। আশীষকে পুরো কাহিনী বলে সাথীকে আজ হাতে-নাতে ধরার অভিপ্রায় জানালাম। সে এই জাটিল কাজে তাকে নেয়ার দুরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার জায়গায় রাসেলকে সাজেস্ট করল। প্রত্যুত্তরে জানালাম তাকে শুধু ঘটনাটার সাক্ষী থাকার জন্য ডাকা হয়েছে, এর চেয়ে বেশি কোন কাজ নাই তার।
আগ্রায় পৌছুতে দেরী হল না। আশীষকে বাবুকে কোলে নিয়ে গাড়ীতে বসে থাকতে বললাম। জানালাম বিশেষ প্রয়োজনে কল দিলে যেন ভেতরে যায় সে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে রায়হান আর সাথীকে খুঁজে পেতে দেরী হল না। খুব হেসে হেসে দুজন গল্প করছে, আর খাচ্ছে। হায় ইশ্বর! এমন দৃশ্য দেখার আগে আমার মরন হল না কেন? মাথায় রক্ত চড়ে গেল মুহুর্তে। কোন কিছু না ভেবেই তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
-বাহ! বাহ! বাহ! দুজনে মিলে বেশ জমেছে তাহলে!
-আরে সুমন! তুমি চলে এসেছো? বাবু কোথায়? সাথীর চোখে বিষ্ময়!
-এসে বুঝি ভুল করে ফেলেছি? কি ভেবেছো আমাকে? অমি কিছু টের পাব না?
- কী আজে বাজে কথা বলছো বুঝতে পারছি না। গলা নামিয়ে কথা বল। সবাই তোমার দিকে তাকাচ্ছে।
-গলা নামিয়ে কথা বলব? কেন বলব? তোমাদের মান-সম্মান যাবে? কোথায়, তোমার রানী কোথায়? আমাকে কি সুন্দর করে বলে আসলে, রানী আসবে। হাহ! এতো চমৎকার অভিনয় করলে কিভাবে তুমি? এই ডাঁহা মিথ্যে কথা বলতে একবারও গলা কাঁপল না তোমার?
সাথীর চোখে জলের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে ততোক্ষনে।
-হাহ! এখন কান্না আসে কেন? আমাকে ধোঁকা দেয়ার সময় কান্না আসেনি? কত ভালবেসেছি তোমাকে। আর তুমি এভাবে আমাকে ধোঁকা দিলে! আই হেইট ইউ। হেইট ইউ।
-সুমন সাহেব আপনি ভুল করছেন। রায়হান ধমক দিয়ে বলে উঠল।
-ভুল আমি করছি না মি. রায়হান। ভুল করছিস তুই। মহা ভুল। এর মাশুল তোকে দিতেই হবে। আই উইল কিল ই্উ।
ঠাস করে একটা চড় লাগালাম রায়হানের গালে। ওমন দশাসই চড়ের জন্য রায়হান তৈরী ছিল না। মেঝেতে পড়ে গেল সে। সাথী আমাকে জাপটে ধরে থামতে বলল। মাগীটার দেখি রায়হানের জন্য এতো দরদ। আমি সাথীকে ছাড়িয়ে দৌড়ে বের হয়ে এলাম। আশীষকে বললাম গাড়ী ছাড়তে। আমার হাউ মাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। সাথী এমন কান্ড কিভাবে করল্। কিভাবে করল। মানুষ এতো বড় ধোঁকাবাজ কিভাবে হতে পারে? পুরোটা রাস্তা আশীষের সাথে কোন কথা বললাম না। আশিষও বোধ করি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল। সেও কোনকিছু জিজ্ঞেস করল না। বাসায় ফিরে আশিষকে বিদায় দিয়ে বাবুকে কোলে নিয়ে বসলাম। অনেক ভাবলাম তখন। পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই সাথী বাসায় ফিরল। ভেজা চোখে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। জানি এখন সে ক্ষমা চাইবে হয়তোবা। তাই তাকে সুযোগ না দিয়েই বললাম, বাবুকে নিয়ে তুমি চলে যেতে পার। এভাবে মনের বিরূদ্ধে গিয়ে আমার সাথে তোমাকে আর ঘর করতে হবে না ।
তুমি বললেই বুঝি চলে যাব? তুমি ভুল বুঝেছো আমাকে।
দুজনকে নিজ চোখে দেখে আসলাম আর বলছো ভুল বুঝেছি? আমার হিসহিস গলা আমি নিজেও চিনতে পারছিলাম না তখন। আসলে ঘৃনায় আমার মনটা তখণ সাপের মতোই বিষিয়ে উঠেছিল।
তুমি ভুল বুঝছো সুমন। আমি আসলে রানীর সাথেই দেখা করেত গিয়েছিলাম। সে খুব বিপদে আছে তার লাভারকে নিয়ে। তাই তাড়াতাড়ি চলে গেল।
আবার মিথ্যা! থাক। ওতো মিথ্য কথা বলতে হবে না তোমাকে। তুমি আমার সাথে থাকলে আরো মিথ্যে বলতে হবে। আমি তোমাকে এই মিথ্যে জীবন থেকে মুক্তি দিলাম।
না সুমন। আমি তোমাকে ভালবাসি। কোনকিছুই মিথ্যে না। সাথীর গলা এখন যথেষ্ট স্বাভাবিক।
ভালবাস? তবে রায়হানের সাথে যে তোমাকে নিজ চোখে দেখলাম। বলো, ওটাও ভুল ছিল?
রায়হান তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সে না আসায় সেখানে একা বসেছিল। আমাকে বের হয়ে আসার সময় দেখতে পেয়ে ডাক দিল।
ও, তাই বুঝি? তারপর? তোমার বানানো স্টোরি শেষ কর আগে।
স্টোরি না সুমন, এটা সত্যি।
তাহলে বল, আমাদের বাবুটা কি রায়হানের মতো দেখতে না? তাকাও বাবুর দিকে। ভাল করে তাকাও। দেখো, কি অদ্ভুত মিল দুজনের!
তুমি ঠিকই ধরেছো। তুমি রেস্টুরেন্ট থেকে আসার পরেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। তুমি মনে করে দেখো, আমি একদিন তোমাকে বলেছিলাম বাবু দেখতে অনেকটা রহিম চাচার মতো হয়েছে।
বলেছিলে। কিন্তু সে দেখতে রায়হানের মতো।
ঠিক। সে দেখতে রায়হানের মতোই হয়েছে। কারন রায়হান রহিম চাচার ছেলে।
রায়হান রহিম চাচার ছেলে?
হ্যা, ব্যাপারটা একটু আগেই জানতে পারলাম।
কি বলো। এটাও তোমার বানানো কোন গল্প না তো?
না এটাই সত্যি। আমার একটা গল্পও বানানো না সুমন। কখনো তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলিনি।
আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম রোবটের মতো। কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
দাও, বাবুকে কোলে দাও। সাথীর তীক্ষ কন্ঠে সম্বিত ফিরে পেলাম।
কেন? আমার কোলে শুয়েছে। শুয়ে থাকুক।
না। ওকে কোলে নেয়ার কোন অধিকার তোমার নাই। যার মাকে ঘিরে তুমি এমন বিশ্রী চিন্তা করতে পার, তাকে কোলে নেয়ার অধিকার তোমার থাকতে পারে না। ওকে দাও । আমি চলে যাব।
সাথী এটা কী বললো! সাথীকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে। ওকে যে বড্ড ভালবাসি!
আমাকে ক্ষমা করো সাথী। আমার বিরাট ভুল হয়েছে। তুমি যেও না আমাকে ছেড়ে।
না। এমন নিচু মানসিকতার কারো সাথে আমি থাকতে পারব না। অনেক হয়েছে। আর না।
কোথায় যাওয়া হচ্ছে সাথী? হঠাৎ গমগমে আওয়াজ শুনে দুজনই বাইরের দরজার দিকে তাকালাম। রায়হান, সাথে একটা মেয়ে।
রাগ করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে নেই সাথী। সময় নাও । চলে গেলে পরেও যেতে পারবে।
সুমন সাহেব, পরিচিত হোন। এর নাম সাথী। আমরা ঠিক করেছি আগামী মাসে আমরা বিয়ে করবো। রেস্টুরেন্টে আমি তার সাখে দেখা করতেই গিয়েছিলাম।
দ্বিতীয় সাথীকে সালাম দিয়ে রায়হানের দিকে তাকালাম। রহিম চাচার ছেলে অনেকটা তার বাবার মতোই হয়েছে। বিচিত্র এ পৃথিবী। বিচিত্র এর লীলা।