প্রকাশ: ঘুড়ি, লিটল ম্যাগাজিন, গল্পসংখ্যা, ২০০৭।
বিশাল ও কিনারাহীন পুকুরটার ঠিক মাঝখানে ধোঁয়াগুলা কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠতে চাইছিল। ফটফট একটা শব্দ হয় আর পানির ভেতর কি যেন ভীষন নড়ে। জলের এই অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ে। আর কী আশ্চর্য, বিশাল পুকুরের বাদবাকি জলে একটুও নড়চড় নাই। কোন পয়গম্বরের দূত কি জলে জায়নামাজ বিছিয়ে ঝিরিয়ে নেবে? পানির ভেতরে কীই বা এমন নড়ে! এতবড় পুকুরে আর কাউকে দেখা যায় না। তাই এই বিভ্রমের কোন সুরাহা কেউ দিতে পারে না।
দীর্ঘ বিশ্রামের পর দীর্ঘ চুল ও শ্মশ্র“তে পুরা শরীর ঢাকা যুবকের ঘুম ভাঙে। চোখে ঝিমানি ও ফিনফিনে দেহের লেশমাত্র ওজন নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে। সারা গায়ে কোন কাপড় নাই। হাতদুটা ঝুলছে শূণ্যে। দীর্ঘ কেশরাশি বাতাসে ওড়ে। পুকুরে এমন ধোঁয়া ওঠে কি করে? এই বিভ্রমের সমাধান যুবকের কাছে চাইব কি? কিন্তু কেউ যদি তাকে এই প্রশ্ন করে নিশ্চিতভাবেই কোন সহজ উত্তর পাওয়া যাবে না। তখন যুবক আমাদের যাছাই করবে একাধিক সংশয় ও বিভ্রমের মায়াজালে এবং যে নতুন সত্যের পথ আমাদের বাতলে দেয়, সে পথ ধরেই এই সংশয়ের সমাধান মিলবে। যুবকের দৃঢ় বিশ্বাস সে একটি নতুন সত্য উসকে দেবে এবং যাদের নিরাপদ ভবিষ্যত নিজের ভেতর বয়ে নিচ্ছে কেবল তারাই এই সত্যকে ঝিইয়ে রাখবে। অসংখ্য যুবতির গর্ভে এ সত্য ছড়িয়ে পড়বে শহরতলির আনাচেকানাচে।
মাত্র সাতমাস বয়সে মাকে সে দেখেছিল পেলব স্তনদুটা দুহাতে উঁচা করে ধরে রাস্তায় রাস্তায় ছুটতে । তাকে অভুক্ত রেখে মা তার বুকটা চাটতে দিত সেসব চোখ না ফোটা কুকুরছানাদের যাদের মা বিয়ানো মাত্রই গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তার মনে হয়েছিল অনাথরাই বুঝি পৃথিবীর সুস্থ শিশুদের অধিকারকে চেটেপুটে নেয়। দিনের পর দিন অভুক্ত থেকেও তরতর করে সে বেড়ে ওঠে। ভীষন ভয় ও অসহায়ত্ব ঝেঁকে বসে তার কোমল হৃৎপিণ্ডে। তারপরও সে কাটিয়ে ওঠে এই শূণ্যতা। যখন সে হামবুড়া দিতে শেখে তখন থেকে রপ্ত করে অনাথ কুকুরছানার আকুতি। তাদের মতই চাটতে শেখে অসংখ্য উঁচা স্তনঅলা যুবতির বাঁট। তার অনাড়ম্বর বেড়ে ওঠার আর কোন তাৎপর্য ছিলনা, যতদিন না সে লায়েক হয়ে ওঠে। শরীর ঢাকার কায়দা তার জানা ছিল না, ফলত আগাগোড়া দিগম্বর বেড়ে ওঠার ফাঁকে সে নতুন সময়ের জন্ম দেয়। কী নীপুন গড়ে ওঠা দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। শহরের স্কুল-কলেজ ফেরত বালিকা ও যুবতিরা এই প্রথম জানতে শুরু করে বাবা আদমের আদি শরীরের কারুকাজ। বিষ্ময়ে ও কৌতূহলে তাকে পরখ করে দেখত চৌরাস্তার মোড়ে, তিনরাস্তার কিনারে, নির্জন দুপুরে, কোলাহল ও ভিড়ে। এই অদম্য শারীরিক গতি রপ্ত করতে শুরু করে শিশু-কিশোর ও তারই মত বাদবাকি যুবকের দল। আহ কী অদ্ভূত; শহর কেবল ভরে ওঠে আপোষহীন দিগম্বর মানুষের কোলাহলে। তারপর থেকে মানুষ জানতে শুরু করে আড়াল ও অন্ধকারের ফাঁকি। আর শহরের বালিকারা, যারা যুবতিদের সংশয়কে বালিচাপা দিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তারাও যখন নির্দ্বিধায় বন্য ও সভ্য হয়ে উঠে একে একে সব আড়াল খুলে ফেলে তখন আরো এক নতুন বিষ্ময় জমা হয় শহরতলির বুকে। শহরের পর্দানশীল অভিভাবকেরা ােভ ও অপমানে ফোলে ওঠে। এই প্রথম তারা জানতে পারে মেয়েদের পর্দা খসে পড়ার আর দেরী নাই। তারা মেয়েদের কাপড়ে শতশত ালপিন লাগিয়ে দিয়ে কোণঠাসা করতে চাইল। মেয়েদের ওড়না ও সেলোয়ার আলপিনের ভারে ভীষন ভারী হয়ে ওঠে। তারা হাঁপিয়ে ওঠে। আর বাদবাকি সভ্য ও সুন্দরী যুবতিরা তাদের পুষ্ট নিতম্ব, স্তনজোড়া, এমনকি জঙ্গার উপর-নিচে বিশুদ্ধ বাতাস লাগিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পর্দানশীল বালিকা ও যুবতিদের চোখে পড়লে তাদের জন্য করুনা ও কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু এরই ফাঁকে পর্দানশীল মেয়েদের জন নতুন বিপত্তি হাজির হয়। যে বিপর্যয় অভিভাবকেরা ঠেকাতে চাইল শতশত ওজনদার আলপিন তাদের শরীরে বিদ্ধ করে তা উল্টা আরো বেশি আফসোসের কারন হয়ে দাঁড়ায়। যুবতিরা যখন প্রায় কুঁজো হয়ে রাস্তার কিনার ঘেঁষে বুকে বই কি ব্যাগ চেপে ধরে হেঁটে যায় তখন তাদের সেলোয়ার কিংবা ওড়নায় আটকে থাকা ধাতব খণ্ডগুলার ভারে কাপড়গুলা টুকরা টুকরা হয়ে ছিঁড়ে যেতে থাকে। আর হয় কী, তাতে মেয়েরা ঘরে ফেরার আগেই তাদের দেহের মূল্যবান অংশগুলার আড়াল হারাতে থাকে। হাতের বই ফেলে, কলেজের ব্যাগ ফেলে তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে দেহের আব্র“ রা কতে। কিন্তু সেকাজে তাদের খুব একটা উৎসাহী হতে দেখা যায় না। তারা বুকের কাছে ছিঁড়ে যাওয়া জামার জোড়া দিতে পাছার উপর থেকে কাপড় ছিঁড়ে নেয়, আর তাতে পেলব পাছার চামড়াটা তাদের ইচ্ছার কিছুটা আড়াল খুলে দেয়। বাদবকি পর্দানশীল মেয়েদেরও এই দৃশ্য মনে ধরে। তারাও নিজেদের এভাবে খুলে দিতে উৎসাহী হয়। যখন তারা বড়ি ফিরে যায় রনশীল রমনীরা সন্তানদের বেহায়া ও বেআব্র“ বেশবাশ দেখে ফোঁসে ওঠে। তারা দেখে তাদের সুরতি মেয়েরা নিজেদের রা করতে পারে নি। যা বাদবাকি মেয়েরা অনায়াসে করে তাদের মেয়েরাও সে পথ নির্দ্বিধায় মাড়ায়। আলপিনের ভারে ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়ের অংশগুলা তখন মেয়েদের নাগালে না পেয়ে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। নিজেদের আব্র“ ঠিকঠাক করে সেসব ছেঁড়া টুকরা খুঁজতে বেড়িয়ে পড়ে।
রমনীদের এই গৃহত্যাগ হয়ে উঠে বিপত্তি ও সংগ্রামের লড়াই। তাদের জন্য সেসব কাঁপড় খুঁজেপেতে নেয়া রীতিমত অসম্ভবই। কেননা তাদের মেয়েরা কাপড়গুলা ভাগাভাগি করত উঠতি বয়সী তরুনদের সাথে যাদের প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে দিগম্বর যুবকের শীষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। সেসব যুবকদের খুঁজে পাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। তারা প্রায় একজোট হয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন গন্তব্য ঠিক করে এবং যে যার মত করে নিজেদের মিশন নিয়ে পুরা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তারা কেবল সেসব মেয়েদের আশীর্বাদ করত যারা সাহসী, সভ্য ও নগ্ন হয়ে উঠতে পেরেছে। লজ্জাবতী ও রনশীল মেয়েদের জন্য তাদের দুয়ার কেবল তখনই খোলা থাকে যখণ তাদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক মেয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। দিগম্ভর যুবকের শীষ্যরা এসব হতাশ ও অতুপ্ত মেয়েদের ওছিলায় অন্যান্য রণশীল মেয়েদেরও আশীর্বাদ করে গেলে তারা নিজেদের নিঃশ্বাস লম্বা ও দীর্ঘ করার সুযোগ পায়। তাদের এই দীর্ঘশ্বাসকে সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ভেবে আশ্বস্থ হয়। ততদিনে তাদের শরীরে আর কোন কাপড়ই অবশিষ্ট থাকে না। রনশীল মায়েরা তাদের স্কুল ও কলেজফেরত মেয়েদের একই পথ মাড়ানোর আগেই এই বিষয়ে সচেতন হলেও তারা বিষয়টার পূর্ণ ফয়সালা করতে পারে না। যেসব যুবকের হাতে মেয়েদের পোশাকের ছেঁড়া অংশগুলা পৌঁছে গিয়েছিল তাদের নাগাল পাওয়া রীতিমত দুরহ ছিল। কারণ যুবকেরা এসব মায়েদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখত। মেয়েদের রা করার সবগুলা পথ বন্ধ হয়ে পড়তে দেখে তারা ভীত হয়ে পড়ে। সম্ভাব্য ভবিষ্যত কল্পনা করে ভীষন মুষড়ে পড়ে। তারা পরিপূর্ণ হতাশায় নিজেরা নিজেদের চুল ছিঁড়ে ফেলে। সবগুলা চুল ছিঁড়ে ফেলার পর আর কোন চুল অবশিষ্ট না থাকলে শরীরের অনাবৃত অংশের লোমগুলা এক এক করে ছিঁড়তে শুরু করে। হাত, পা, ও মুখের সবকটি লোম কিংবা ভ্র“ পর্যন্ত ছেঁড়া হয়ে গেলে তারা নিজেদের অজান্তেই শরীরের গোপন অংশে হাত লাগায়। তাতে ছোট বড় যেসব কাপড় দিয়ে তারা দেহের আব্র“ রা করেছে সবগুলা খসে পড়ে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, এসব বিগতযৌবনা ও মধ্যবয়স্কা রমনীদের শরীরের গোপন ও মহার্ঘ্য স্থানসমূহে কোন লোম খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের নাভির নিচে তলপেট ঘেঁষা ত্রিকোণ অন্ধকার গহ্বরটার আশপাশ পর্যন্ত এতবেশি মসৃন ও তেলতেলে যে সবাই তাদের ব্যাপারে সংশয়ে পড়ে। শহরের লোকেরা প্রথমে খানিকটা দোনামনায় পড়লেও পরে নিশ্চিত হত যে মূলত অনেক আগেই তারা কাপড়ের আড়ালের সবগুলা লোম ছিঁড়ে ফেলেছে, সম্ভবত তাদের অতৃপ্তির জ্বালা নিভিয়েছে। সবগুলা চুল ছিঁড়ে ফেললে তাদেরকে ন্যাড়া মাথার যুবতি ভেবে সবাই ভুল করে। মূলত তারা নিজেদের আড়ালকে ঢাল বানিয়েছিল ভেবে কেউ কেউ বিষ্মিত হয়। কিন্তু এর বেশিকিছু তারা জানতে পারে না। বস্তুত তাদের বিষয়ে কাউকে খুব বেশি আগ্রহী হতে দেখা যায় না।
ইত্যবসরে রনশীল মায়েরা ল্য করে তারা দিগম্বর যুবকের শীষ্যদের সাাত লাভের যোগ্য হয়ে উঠেছে। আপন কন্যাদের আব্র“ খসে পড়ার সম্ভাব্য আশংকায় তাদের ভেতর যে তীব্র হতাশা ভিড় করেছিল তাতে নিজেদের অজান্তেই সব আড়াল তুলে নেয় বিধায় এই সুযোগ তৈরী হয়ে যায়। ভরাডুবির মুষ্টিলাভ ভেবে তারা সান্ত্বনা পায় এবং সভ্য ও নগ্ন তরুনীদের বেশে নেমে পড়ে দিগম্বর যুবকের শীষ্যদের খোঁজে। যেই না তারা একে একে পথে নামতে শুরু করে আদিম পোশাকে, তাদের ভেতর ঘটতে থাকে অদ্ভূত সব পরিবর্তন। তাদের অনাবৃত পদযুগল রাস্তার শক্ত ও তেলতেলে আস্তরন সহ্য করতে পারে না। তীব্র তাপে কালো আস্তরনের যে সব জায়গা নরম হয়ে ফোলে ওঠে সেখানে পা আটকে যায়। সামনে এগোনোর পথে এভাবে বারবার তারা আটকে পড়ে। সন্তানদের আব্র“ রার শেষ চেষ্টায় বেশিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়াতে ঘর থেকে বের হবার উপযুক্ত সময় বেঁচে নিতে তারা ভুল করে। তারা ভাবে যদি মধ্যদুপুরের কাঁঠালপাকা রোদের তেজ এড়ানোর চেষ্টা করত তবে হয়ত এই বিপত্তি ঘটত না। যদি তারা বিকেলের শান্ত রোদে এরাবিয়ান কিংবা শরীফ ছাতা মাথায় দিয়ে বের হত, এই উঠকো ঝামেলা থেকে রেহায় পেত। সবচাইতে উপযুক্ত সময় সন্ধ্যার আধাঁরকে কাজে লাগাতে না পারায়ও তাদের অনুশোচনা হয়। পা আলগিয়ে, অতি সতর্ক পায়ে হাঁটতে যেয়ে তাদেরকে বারবার নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে চোখ নিচে নামিয়ে পথ চলতে হয়। সামনের বাদবাকি দৃশ্যাবলী, মানুষজন, কোলাহল ও গাড়ির হর্ন, কিংবা সাঁ করে চলে যাওয়া দ্রুতগামী বাস কোনকিছুই তারা নজরে আনতে পারে না। তারা কেবল রাস্তার পাশের বিশাল বিশাল ড্রেনগুলা দেখে স্বভাববশত নাকে শাড়ির আঁচল গুঁজতে যেয়ে হাতটা বুকের কাছে নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরিয়ে আনে। দু’চার জনের অধিক মানুষের ঝটলা দেখে কেউ কেউ যদিও বা এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেরাতে চায় তাতে ফল হয় উল্টা। তারা জেনেছে দিগম্বর যুবকেরা হ্যামিলনের বাঁশিঅলার মত সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় আর পিছু পিছু সদ্য আশীর্বাদ প্রাপ্ত মেয়েরা চোখেমুখে রাজ্যের তৃপ্তি নিয়ে তাদের অনুসরন করে। মাঝেমধ্যে যুবকেরা কান্তি সারতে বিশ্রাম নিতে কোথাও থামলে সেখানেও সৃষ্টি হয় ঝটলা। যেসব রণশীল মায়েরা যুবকদের খোঁজে পিচ ডালা পথ থেকে ঝটলার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চায় তারা পা ফসকে, উল্টা, খোলা ম্যানহোলে কিংবা নালায় আচড়ে পড়ে। শহরতলিতে এমন দৃশ্য খুববেশি দেখা যায় না। তাই সবার দৃষ্টিই তাদের দিকে ফিরে আসে। সারাগায়ে দুর্গন্ধযুক্ত আলকাতরার মাখামাখিতে সেসব নারীদের বেশবাশ সবাইকে নির্মর হাসির খোরাক যোগায়। তাদের সুউচ্চ বুক, পুষ্ট পাছা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা। এই দৃশ্য দেখে বাদবাকি রণশীল মায়েরাই কেবল শংকিত হয়। তারা নিজেদের পরিণতিও একই রকম হবার আগাম সম্ভবনা কল্পনা করে আরও বেশি সতর্ক হবার চেষ্টা করে। ফলে তারা যুবকের সাাত লাভের অনেকগুলা সুবর্ণ সুযোগ একের পর এক হারাতে থাকে। তাদের সম্ভাব্য গন্তব্য হয়ে ওঠে অনেক দীর্ঘ। যে পথ স্কুল-কলেজ ফেরতা মেয়েরা অনায়াসে পার হয় দশকুড়ি মিনিটে, সেই পথও তাদের জন্য দশকুড়ি মাইল দীর্ঘ হয়ে যায়। যে পথের পিচ ডালা মসৃন গা মেয়েদের নবযৌবনপ্রাপ্ত পায়ের ঘষায় আবেশে চোখ বোজে ফেলে সে পথ তাদের মায়েদের পায়ের তলার প্রচণ্ড তাপে গলে গিয়ে ফোলে ওঠে। শংকিত রমনীরা তখন ভাবে এভাবে যুবকের খোঁজে কোলাহলে চোখ রাখতে চাইলে তাদেরও হয়ত একই পরিণতি হবে। তাদের দৃষ্টি বারবার দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার খোঁজে খোলা নালা কিংবা ম্যানহোলে ফিরে ফিরে যায়। যুবকের খোঁজে তাদের দ্বিধা ও জড়তা এভাবে তারা টেনে নিয়ে যায় বছরের পর বছর। ফলে তারা ছিটকে পড়ে দৌড় থেকে।
ময়লার পুকুরে ডুব দেয়া মহিলারা তখন বিমর্ষ হবার বদলে তেজী হয়ে ওঠে। সেসব মহিলা হাতের তালুতে, চরম তৃপ্তি নিয়ে, ময়লাগুলা ঘাটতে থাকে। তারা নিশ্চিত হয় তাদের আর হারানোর কিছু নাই। যে সম্ভ্রম টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের কোন কিছু বিলানো বাকি না রাখার পরও যখন শেষরা হয় নি, তখন নরকবাসের প্রকৃত সত্য উন্মোচন করতে তাদের বড় শখ হয়। আর কী আশ্চর্য, এই প্রথম তাদের ভেতরের যাবতীয় জড়তা ও হীনমন্যতা এক ঝটকায় ময়লায় সাথে টপটপ করে পিচ ডালা রাস্তায় ঝরে পড়তে থাকে। প্রচণ্ড তাপে ফোলে ওঠা রাস্তার কালো পাথরগুলার উপর গায়ের ঘাম ও ময়লাপানি জমা হয়। পায়ের তলায় আটকে থাকা পাথরগুলাও আস্তে আস্তে সরে যায়। কার্পাসতুলার মত হালকা ও ভারহীন হয়ে ওঠে একেকটি রমনী। কী শুভ্র আর তুলতুলে লাগে নিজেদের! তাদের উঠতি বয়সী যুবতি মেয়েদের মত যে চঞ্চলতা নিজেদের ভেতর জমতে শুরু করে তারা তা দমিয়ে রাখতে পারে না। এক অদ্ভূত মায়াময় তাড়না তাদের ভেতর আলোড়ন তোলে। তারা নিশ্চিত হয় দ্বিগম্বর যুবকের খোঁজ তারা খুব সহজেই এবার পেয়ে যাবে। কোলাহল ও জটলার প্রতি তাদের আগ্রহ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কোলাহলের ফাঁকি তাদের কাছে পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা জেনে যায় সেসব যুবকরাই মূলত হ্যামিলনের বাঁশি নিয়ে পূর্ববর্তী ব্যর্থতার প্রায়শ্চিত্য করে যায় যারা ইতোপূর্বে দিগম্বর যুবকের শীষ্যত্ব গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করতে পারে নি। এইসব শিানবিশ যুবকের কাছে মেয়েদের আব্র“ রার মিনতি তাদের কাছে অরণ্যরোদন বলে মনে হয়। যে সকল যুবক পূর্ণ কেরামতি লাভে সমর্থ্য হয়েছে তাদের খোঁজে পুনরায় নতুন পথচলা শুরু হয়। নগরের শানশওকতময় রাস্তাগুলা তারা এড়িয়ে চলতে শুরু করে। কাদা ও কচি ঘাসে ঢাকা যেসব রাস্তায় শতশত বছর ধরে মানুষের পায়ের চাপ পড়েনি সেসব রাস্তার খোঁজে তারা একের পর এক নগরী মাড়িয়ে যায়। গাছ ও পশুপাখিবিহীন কোন কোন নগরী তাদের নজরে পড়লে অল্পসময় বিশ্রামের আশায় সেখানে থামে। কারণ দীর্ঘ বেড়ে ওঠায় কখনো গাছের শীতল ছায়া কিংবা বাবুইসহ অসংখ্য পাখির কলরব তাদের তন্দ্রায় আবেশ ছড়ায় নি। ফলত শ্যামল ও শীতল নগরিগুলাকে নিজেদের বিশ্রামের জন্য তারা বেঁচে নিতে পারে না। নগরীগুলাকে নিজেদের বিশ্রামের জন্য তারা বেঁচে নিতে পারে না। অথচ সিদ্ধিপাওয়া যুবকের সম্ভাব্য আস্তানা যেসব নগরীতে বলে তারা জানতে পারে সেখানে পৌঁছানোর রাস্তাগুলা শ্যামল ও শীতল নগরীগুলারই কোন কোন মনুষ্য চলাচলবিহীন অঞ্চলে। উপরন্তু যেসব প্রায়শ্চিত্যকারী যুবক শহরগুলাতে সভ্যতা ও আলোর ফুলকি ছিটাচ্ছে, সিদ্ধিলাভের পর তারাও আত্মগোপন করবে কিনা সে ব্যাপারে নিঃসংশয় হতে পারে না। যদি তারাও আত্মগোপন করে তবে নতুন আলোর যে সন্ধান তারা দিয়ে যাচ্ছে তা নিভে যাবার শংকা তারা উড়িয়ে দিতে পারে না। আর এই শংকার ভেতরেই আচমকা তারা নতুন সত্য আবিষ্কার করে। আপন মেয়েদের আব্র“ রার যে সংকল্প নিয়ে নিজেদের সব সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে এত দীর্ঘপথ পাড়ি দিল, এই অন্তিমলগ্নে এসে বিষয়টাকে তাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়। আব্র“হীন দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, যে আড়াল মানুষ শরীরের উপর চাপিয়ে সভ্য হতে চায় তা মুলত অন্ধকারেরই সমান্তরাল। কেননা অন্ধকারেই তাদের পুরুষরা সব আড়াল উপড়ে ফেলত দ্বিগুণ কামনায়। তখন নিজেদের উপর বয়ে যাওয়া কামনা ও লোভের চিহ্নগুলাতে রণশীল মহিলারা দীর্ঘদিন পর ব্যথা অনুভব করে। দাগগুলাতে হাত বুলাতে বুলাতে নিজেদের নিয়তিকে অভিশাপ দেয়। ােভ ও ক্রোধে কখন যে তারা শহরের পর শহর ছুটতে ছুটতে গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে বুঝে উঠতে পারে না। যৌবনের হা-হুতাশ নিয়ে এতবেশি কাতর হয়ে পড়ে যে তারা মেয়েদের পর্দার শংকাকে আর আমলে নেয় না। কাদা ও কচি ঘাস ওঠা রাস্তার খোঁজ তারা পায় না।
আর কে জানত এই বিভ্রমই তাদের জন্য এক অমোঘ নিয়তি বয়ে আনবে! যে পথের উপর দিয়ে তারা শেষবার গন্তব্যহীন হয়ে ছুটে সে পথটি নিকট অতীতেও মানুষের পদভারে বেজে উঠত। যদিও এই সত্যের স্যা দেবার কেউ নাই। তাদের আন্দাজকে কেবল অসংখ্য পায়ের চাপ আর ঘাসওঠা রাস্তাটিই জোর স্যা দেয়। এমন কথা কেউ বলেনি যে এই রাস্তাই যুবকের সন্ধান নিশ্চিত করবে, তবু তারা আর বেপথু হবার ঝুঁকি নেয় নি এবং শেষ সংকল্প নিয়ে নিজেদের যাত্রাকে টেনে নিয়ে যায়। তারা দেখে রাস্তাটির যেখানটায় আর কোন পায়ের চাপ খোজে পাওয়া যায় না তার অদূরে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে চিকচিক করে অথৈ জলরাশি। চাঁদের আলোয় জলের এই খেলা কেবল তারাই দেখে যাদের দেখা দিতে স্বয়ং দিগম্বর যুবক জলফুঁড়ে উঠে আসে। কূলকিনারাহীন বিশাল এই পুকুরের মাঝখানে ধোঁয়া ওঠা শুরু করলে তাদের বুকের ভেতর আচমকা একটি শংকা দলা পাকিয়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে শান্ত জলে দৃশ্যমান হয় দীর্ঘচুল ও শ্মশ্র“মণ্ডিত দিগম্বর যুবক। জল ফুঁড়ে অসংখ্য যুবক একের পর এক দৃশ্যমান হতে থাকে। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড, চাঁদের আলোতে যুবক ভেবে যেই না তারা জলে ঝাঁপ দেয় এক মারাত্মক বিভ্রম তাদের কাছে পষ্ট হয়ে ওঠে। জল ফুঁড়ে উঠে আসা শরীরগুলা তাদেরই প্রতিবিম্ব। যে শুভ্র ও দীঘল কেশরাশি তারা ছিঁড়ে ফেলেছে নিজেদের যুবতি মেয়েদের আব্র“ হারনোর শংকায় সেই বিগত রমনীরাই পুনরায় তাদের সামনে ধরা দিলে তারা চিনে ব্যর্থ হয়। পুকুরের অথৈ জল চাঁদের আলোতে ক্রমশ সাদা হয়ে উঠতে শুরু করে। নিজেদের এক পুকুর দুধের সরে ভাসতে দেখে তাদের চেহারায় একটা উজ্জ্বল রেখা ভেসে ওঠে। তারা ভাবতে শুরু করে হয়ত দুধের সরে পরিশুদ্ধ হবার পরেই যুবকের সাাত তাদের কাছে সহজতর হবে।
কিন্তু সেই শুভণ তাদের কাছে আর ধরা দেয় না। যুবকের সাাত তাদের কাছে অধরাই থেকে যায়। তারা নিশ্চিত হয় যে, মুলত যেসব মায়েরা নিজেদের যৌবনকে ভাঁজ করে রেখেছিল নানাবিধ পর্দার আবরণে, যাদের পর্দার ভাঁজ ততোধিক কামনার ঝড়ে উপড়ে ফেলত তাদের অন্দরমহলের পুরুষরা, সেসব রমনীদের পে যুবকের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। কেবল সেসব রমনীরাই যুবকের হদিশ পাবে যারা এখনো গর্ভধারণ করার মতা ঝিইয়ে রাখতে পেরেছে এবং যারা আপন সন্তানদের অভুক্ত রেখে পেলব স্তনদুটা উঁচা করে করে রাস্তায় রাস্তায় ছুটতে পারবে। তাদের বুকটা চাটতে দিবে সেসব চোখ না ফোঁটা কুকুরছানাদের যাদের মা, মাদী কুকুরটা, প্রসববেদনা শেষ হওয়া মাত্রই গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিয়েছিল।
চাঁদের আলোয় পুকুরের অথৈ দুধে এক অবিশ্বাস্য আভার জন্ম হয়। সে আভায় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে মানবাকৃতির এক নত্রপুঞ্জ।
রচনাকাল সেপ্টেম্ভর-অক্টোবর ২০০৬