নাম শুনে গোবিন্দ হালদারকে কেউ চিনতে পারুক আর নাই পারুক যখন তার কানের কাছে উচ্চারণ করা হবে কালজয়ী জাগরণ আর মুক্তির গান-‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’,‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ তখন তাঁকে না চেনার কথা না। তিনি গোবিন্দ হালদার, আমাদের উদ্দীপনার প্রতীক এক অবিনাশী কণ্ঠস্বর। বেঁচে আছেন তিনি যদিও তবু দিন দিন পতিত হচ্ছেন মৃত্যুমুখে অবহেলা আর বিনা চিকিৎসায়। শারিরীকভাবে তিনি ভুগছেন কিডনি, লিভার, নিউরো, চর্ম ও চোখের সমস্যায়। বাকশক্তিও প্রায় রহিত হওয়ার পথে।
নিজ ঘর ছেড়ে পরবাসী হয়ে জীবনযাপন করছেন হাওড়া জেলার বকুলতলার নজিরগঞ্জে যেখানে গোবিন্দ হালদারের স্ত্রী পারুল হালদারের বাবার বাড়ি। গোবিন্দ হালদারের মেয়ে আর্থিকভাবে তার বাবাকে ঠকিয়েছে এবং জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবারও পায়তারা করছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ ওঠেছে শারীরিকভাবেও হেনস্থা করেছে মেয়ে এবং মেয়ের জামাই। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের এই বন্ধুকে তীব্র আর্থিক সংকটের পাশাপাশি, মানসিক অত্যাচার এবং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবার হুমকিও চলছে সমানতালে। (তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ ২৭ মার্চ ২০১৪)
গোবিন্দ হালদারের কলম যতই শক্তিশালী হোক না কেন এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি মানসিক ও শারিরীক আক্রমণগুলো মোকাবেলা করতে অক্ষম। অসহায় এই পরিবার ইতোমধ্যে নিরাপত্তা চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটা থানায় সাধারণ ডায়েরিও লিপিবদ্ধ করেছে। কিন্তু পুলিশ সার্বক্ষণিক কোন মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না বলে তিনিও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। শারিরীক অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র মানসিক অত্যাচার ক্রমে গুণি এই শিল্পীকে দেখিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর পথ।
বাংলাদেশ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদানের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ/ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা দিয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এটা ভাল উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। গোবিন্দ হালদারকেও বাংলাদেশ সম্মানিত করেছে। রাষ্ট্রীয় এই সম্মাননার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সম্মানিও ছিল। ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা’ দিয়ে সম্মানিত করে। এর আগে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ত্রাণ তহবিল থেকে গোবিন্দ হালদারকে ১৫ লাখ টাকাও অনুদান দেন। কিন্তু কোন আর্থিক সাহায্যই ভোগের সুযোগ তাঁর হয়ে ওঠেনি।
ইতিহাস বলে যুগে যুগে গুণি মানুষজন খুব কমই জন্মায়। সৃষ্টিশীলতা শুরুর পরের সময় থেকে তাদের মননশীল সৃষ্টিগুলো আলোকিত করে যায় যুগে-যুগে, কালে-কালে। ১৯৩০ সালে পশ্চিমঙ্গে জন্ম নেওয়া কালজয়ী এই গীতিকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেছেন সেটা অতুলনীয়। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা আর স্বাধিকারের চেতনাকে ধারণ করা এই মানুষটি সীমানাগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ধারণ করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকুতি। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ সীমান্তের বাসিন্দা গোবিন্দ হালদার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আকাশবাণী কলকাতার কেন্দ্রে বসে একের পর এক লিখে গেছেন কালজয়ী চেতনা উদ্দীপক সব গান। সে গানগুলো একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের উদ্দীপ্ত করেছে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে।শুধু নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধেই গান রচনা করে তিনি ক্ষান্ত হননি ১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয় পুরো নয় মাসের স্থিরচিত্র বর্ণনাভিত্তিক অমর গান ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে...’। পরদেশের মানুষের জন্যে তারাই এমন আবেগ আর ভালোবাসা উৎসারিত করতে পারে যারা অন্তর থেকে ধারণ করে। গোবিন্দ হালদার ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশকে, আত্মত্যাগ আর সংগ্রামকে।
গুণি এই মানুষটি বাংলাদেশে নেই। তিনি আছেন তাঁর জন্ম আর বেড়ে ওঠার জায়গা পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু ওখানে তিনি ভাল নেই। ভাল থাকার সুযোগও নেই। এমনকি বেঁচে থাকার সুযোগও ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। পরিবার এবং রাষ্ট্র তাঁকে সে সুযোগ দিচ্ছে না। তাঁর বর্তমান অবস্থা আমাদের জন্যে অশেষ হতাশার, একই সাথে সর্বোচ্চ সম্মান জানাবার সুযোগও। এই সুযোগকে কী বাংলাদেশ কাজে লাগাবে?
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, গুণি মানুষদের রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাবার রেকর্ড বাংলাদেশের রয়েছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনিও পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছিল রাষ্ট্র। ২৪ মে ১৯৭২ সালে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। রাষ্ট্রের এই উদ্যোগ শুধু কবিকেই সম্মানিত করেনি, সম্মানিত করেছে বাংলাদেশকেও।
বাংলাদেশের সামনে আবার সুযোগ এসেছে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর কলমসেনানী গীতিকার গোবিন্দ হালদারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্ব নেওয়ার। গোবিন্দ হালদারকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকত্ব দিলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সম্মানিত হবে। একই সাথে ঋণ শোধের কিছুটা চেষ্টাও হবে। যদিও ঋণশোধ সম্ভব না মোটেও কারণ তাঁর সে অবদান শোধের উর্ধ্বে।
ব্যক্তি পর্যায়ে গোবিন্দ হালদারের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ খুব সীমিত। এজন্যে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্যে দরকার ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ। প্রাথমিকভাবে সরকারি সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তিতে কূটনৈতিক সফলতাই পারে ঋণশোধের পথে এগিয়ে যেতে। বঙ্গবন্ধু সরকার কাজী নজরুলকে নিয়ে আসতে পেরেছিল, বঙ্গবন্ধু কন্যা সেখ হাসিনা সরকার কী পারবেন একই ধরণের উদ্যোগ নিতে এবং সফল হতে!
বাংলাদেশ তাঁকে মৈত্রী সম্মাননা দিয়ে সম্মানিত করেছে কিন্তু তাঁর বর্তমান অবস্থাতে শুধু রাষ্ট্রীয় সে স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়। দরকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়া। শুধু লৌকিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশই যথেষ্ট নয়, বাংলাদেশ গোবিন্দ হালদারের দায়িত্ব নিক। বাংলাদেশ সফল হবে কীনা সেটা পরের ব্যাপার তবে যদি কোন উদ্যোগ না নেয়া হয় তবে আমরা অকৃতজ্ঞ বলে হয়তো চিহ্নিত হয়ে যাবো। বাংলাদেশ কী অকৃতজ্ঞ কোন দেশ? উত্তর হবে- না, বাংলাদেশ অকৃতজ্ঞ দেশ না! বাংলাদেশ তাঁর সুহৃদদের সম্মান দিতে জানে।
আরেকবার প্রমাণের সুযোগ বাংলাদেশের সামনে। বাংলাদেশ প্রমাণ দিক; বাংলাদেশ গোবিন্দ হালদারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ সম্মানিত করুক নাগরিকত্ব প্রদান এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে!