অফিসের কাজে দেশের বাইরে যাওয়া একদিকে যেমন আনন্দের ঠিক অন্যদিকে অনেক বড় দায়িত্বের। আনন্দ এখানে যে ব্যাংকের সব স্টাফদের মাঝ থেকে বাছাই করে নেবার পরে পাঠানো। এটা চাকুরিজীবনের একটা অন্যতম অর্জনও হতে পারে। অন্যদিকে দায়িত্ব এখানে যে কারণে আসা তার পুরোপুরি করতে পারা এবং না পারা।
যেদিন চীফ অপারেটিং অফিসার (COO) জানালেন ব্যাংকের অপারেটিং সিস্টেম বদলানোর জন্যে ব্যাপারটা বাংলাদেশ পার্টের পুরোটা যাচাই-বাছাই করার জন্যে সর্বমোট চারজন যাচ্ছে কলম্বো দেড় মাসের জন্যে। এই চারজনের বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ থেকে। তাদের মুল কাজ হলো তারা কনফার্মেশন দেবার পরেই মাত্র সবকিছুই ইমপ্লিমেন্ট হবে। এ সংবাদে নিজের মাঝে কিছুটা উত্তেজনা ভাব সৃষ্টি হয় কারণ আমিই একমাত্র জুনিয়র সদস্য যারা এই টিমে আছে। এর আগে যারাই বিভিন্ন সময়ে হেড অফিসে গিয়েছিলো তারা সবাই পজিশনের দিক থেকে অনেক অনেক সিনিয়র।
জুনের ২৬ তারিখে আমাদের যাত্রাদিন। ফ্লাইট আড়াইটায়, চেক ইন ১২টায়। নির্ধারিত দিন এবং সময়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত। যেহেতু কলম্বো তাই আগ থেকে ভিসা নেয়ার খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো না। ভিসা অন এরাইভাল চাইলাম সাথে ছিলো ব্যাংকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। লাইন আর এগোয় না। যে গতিতে লাইন এগোয় মনে হয় হেঁটে পাড়ি জমাই শ্রীলংকার পথে। ইমিগ্রেশনের দায়িত্বশীলরা পুলিশের লোক। ভেবে পাইনা বছরের পর বছর ধরে কেন পুলিশ ইমিগ্রেশনের মতো একটা কাজে জড়িয়ে!
লাইন-লাইন, অনেক লাইন। মানুষের পিছে মানুষ দাঁড়ানো। সবার একটা উদ্দেশ্য এই ঝক্কি আর গুরুত্বপুর্ণ ঘাট পেরুনো। আমরা মোট চারজনের টিমে সবাই একলাইনে দাঁড়ানো। হাতে পাসপোর্ট-টিকেটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। আমার ঠিক সামনে দাঁড়ানো আমার এক কলিগ তার কাজ সেরে নিলেন। ইমিগ্রেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক তার মতো করে সব কিছু দেখে শুনে ছেড়ে দিলেন তাকে। এবার আমার পালা। ইত্যবসরে এক কাণ্ড ঘটলো। ১২জনের একটা ট্যুরিস্ট টিম কলম্বো হয়ে মালে যাবে তাদের দুইজন এসে আমার ঠিক সামনে দারিয়ে গেলো। আমি পেছনে আসার জন্যে অনুরোধ জানালাম। একজন পুলিশ বললেন তারা অনেক আগে এই লাইনে ছিলো কিন্তু ভিসা জটিলতায় তাদের কাজগুলো আগে সেরে নেয়া হয়নি! তাই তারা এখন এ কাজ করবে এই লাইনে এসে। আমি বিরক্ত হলেও মেনে নিলাম।
দুইজন লোকের কাজ শেষ হলো। আমি পাসপোর্ট দিলাম ইমিগ্রেশনওয়ালাকে। তিনি জানতে চাইলেন আমিও কমার্শিয়াল ব্যাংকের কী-না! আমি হা বললাম। তিনি এক এক করে আমার যাবতীয় তথ্য কম্পিউটারে ইনপুট দিতে শুরু করলেন। ইত্যবসরে তার কম্পিউটার হ্যাং হয়ে গেলো। আমাকে অনুরোধ করলেন অন্য কোন লাইনে গিয়ে কাজ সেরে নিতে। আমি তাই করতে অন্য বুথে নিজের কাগজপত্র জমা দিলাম। ইমিগ্রেশনওয়ালা আমাকে বললেন ভিসা কোথায়? আমি বললাম কলম্বো থেকে নেবো! তিনি আমাকে ছাড় দিতে রাজি হলেন না। বললেন, এ কাজ তিনি করতে পারবেন না। কারণ ওখান থেকে আমাকে ফেরত পাঠানো হলে তার চাকুরি নিয়ে তানাটানি শুরু হয়ে যাবে। তিনি তার সিনিয়রের কাছে আমাদের রেফার করলেন। আমরা ওখানে গেলাম। সিনিয়র অফিসার আমাদের কাগজপত্র দেখে জুনিয়রকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন। এবং বললেন তিনি যেন আমাকে আমন্ত্রণপত্রের ফটোকপিও রাখেন। আমার কাছে কোন ফটোকপি ছিলো না। যে অফিসার আমাকে শেষ পর্যন্ত ছাড়পত্র দিলেন তিনিও ফটোকপি রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না।
এ নিয়ে এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের সামনে অন্ততপক্ষে আমাদের দুই ঘন্টাধিক সময় কাটে। এই সময়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা আমাদের যাবতীয় তথ্যাদি যেভাবে কম্পিউটারে ইনপুট দিতে থাকেন তা দেখলে যে কারো ঘুম পাবে। এই সময়ে যেখানে সেবা দ্রুত এবং তড়িৎ দেবার কথা সেখানে এমন শম্বুক গতি সত্য হতাশার। ইত্যবসরে লক্ষ্য করলাম, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ব্যবহারের ছিরি। অন্যান্য মানুষজনদের তারা যেভাবে সম্ভোধন এবং ব্যবহার করছে মনে হচ্ছিল যারাই এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তারা হয় তাদের বাসার কাজের লোক অথবা তারা দয়া পরবশ হয়ে তাদের করুণা করছে। আমাদের সাথে এমন ব্যবহার হয়নি যদিও তবু যে ভোগান্তি আর আচার-ব্যবহার দেখেছি তাতে করে মনে হয় তাদের গায়ে পুলিশী পোষাকের কারনেই নিশ্চয়ই এমনতর ব্যবহার!
আমার নিজের সহ আমাদের টিমের চারজনের তিনজনের আর এম পি পাসপোর্ট। যা মেশিনে দিলে সব তথ্য আপনা-আপনিই এসে যাবার কথা। আমি জানি না এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়ে কীনা। কিন্তু তা না হয়ে এমন মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থা আমাদের সার্বিক সেবার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিন ঘন্টা দেরিতে বিমানে উঠার পরে আরো তিন ঘন্টা বাদে কলম্বো গয়ে পৌছালাম। কলম্বো থেকে আমাদের অন এরাইভাল ভিসা নেবার কথা। আমরা লাইনে গিয়ে দাড়ালাম। বললাম পোর্ট এন্ট্রি চাচ্ছি। কলম্বো বিমানবন্দরের দায়িত্বরত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জানালেন আপাত সাতদিনের ভিসা দিতে পারবেন। কারণ এখন পোর্ট এন্ট্রিতে তারা সাত দিনের বেশি দিতে পারেন না। তিনি বললেন, Immigration and Emigration অফিসে এই একই কাগজ জমা দিলে তারা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে দেবে। আমাদের চারজন লাইনে ছিলাম ছাড়পত্র এবং ভিসা দিতে সর্বোচ্চ সময় নিলেন দশ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে তিনি আমাদের পাসপোর্ট জাস্ট স্ক্যান করলেন। একটা মেশিনে আলতো করে চাপ দিয়ে দিয়েই সিল মেরে দিলেন।
হায়, ঢাকায় যেখানে আমাদের চেক ইনে সময় লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি সেখানে কলম্বোতে এসে ভিসা পেতে সময় লাগলো মাত্র দশ মিনিট!