প্রাণসংহারী রক্তকরবী এবং রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী......
১৯৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান এটম বোমার আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি জ্বলেপুড়ে শেষ। তখনও দুটি শহরে সাকুল্যে কোনো ভাবে বেঁচে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রজাতির ১৭০টি গাছ। ওই ১৭০টি গাছের মধ্যে ছিল একটি রক্তকরবী।
বিস্ফোরণের পর ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানী ড.হ্যারল্ড জ্যাকবসেন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- আগামী ৭০ বছর হিরোশিমায় কোনো কিছু জন্মাবে না।
আশ্চর্যজনক ভাবে সেই বছরই হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপের মাঝে প্রথম যে ফুলটি ফুটেছিল, সেটি ছিল রক্তকরবী!
"গাছ মানুষের বন্ধু, এদের জীবন উৎসর্গ করে দেয় মানব কল্যাণে"- কিন্তু রক্তকরবীর আচরণ ঠিক তার বিপরীত। এর পাতা, বাকল, ফুল ও ফল সহ উদ্ভিদের প্রতিটি অংশ তীব্র বিষাক্ত। এই উদ্ভিদ থেকে নির্গত লেটেক্স সেবন করলে মৃত্যু নিশ্চিত। অত্যন্ত রুক্ষ পরিবেশে এই গাছ বাড়তে এবং বেঁচে থাকতে পারে।
সৌন্দর্যের কারণে রক্তকরবী ও শ্বেতকরবী সাহিত্যে স্থান দখল করে নিয়েছে। পাতা তেতো বলে মানুষের ক্ষেত্রে বিষক্রিয়া কম দেখা যায়, অবশ্য TESS (Toxic Exposure Surveillance System) অনুসারে প্রতি বছর আমেরিকায় সহাস্রাধিক বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটে। ঘাসে মেশা শুকনো করবী পাতা বা শাখা খেয়ে গবাদি পশু (বিশেষত ঘোড়ার) বিষক্রিয়া/মৃত্যু দেখা যায়- পূর্ণবয়স্ক ঘোড়ার মারাত্মক মাত্রা ১০০g, (০.৫ mg/Kg)।
'রক্তকরবী'-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। মানুষের প্রবল লোভ কীভাবে জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্রে ও উৎপাদনের উপকরণে পরিণত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কী রূপ ধারণ করছে তারই রূপায়ণ এই নাটকে। নাটকটি বাংলা ১৩৩০ সনে রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লিখেছিলেন...'রক্তকরবী নাটকে ‘নন্দিনী' একটি মানবীর ছবি। চারিদিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ।’ নাটকের মধ্যেই কবি আভাস দিয়েছেন, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়; মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের মৃত্যু, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের সেই সহজ সৌন্দর্যের।
রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী যে এ বাংলার মেয়ে আমাদের একান্ত আপনজন। নন্দিনী সহজ সুখ ও সহজ সৌন্দর্যের প্রতীক। সে সহজতা আমাদের জীবন থেকে চলে গিয়েছে। সহজতার অনুশীলন একান্তভাবে প্রয়োজনে টিকে থাকার জন্যে নয়, বেঁচে থাকার জন্যে। সে কথা বুঝেছিল রাজা। নিজের শক্তির অহংকারে রাজা নিজেকেই বন্দি করেছে। তার সে ‘বন্দিত্ব’ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে শুধু নন্দিনী। নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি ‘রক্তকরবী’ ফুল এনে দিয়ে কিশোর নন্দিনীকে বলে ‘কীসের দুঃখ’। একদিন তোর জন্যে প্রাণ দেব নন্দিনী, এই কথা কতবার মনে মনে ভাবি।’
কিশোরের সঙ্গে কথোপকথনের পরেই নাটকে অধ্যাপকের প্রবেশ ঘটে। অধ্যাপক নন্দিনীকে বর্ণনা করে যক্ষপুরের আচমকা আলো হিসেবে। অধ্যাপকের সঙ্গে কথোপকথনে আমরা বুঝতে পারি নন্দিনী এখানকার নয়। নন্দিনী এই অন্ধকারের বুকে আলোর ঝলসানি। রঞ্জনকে সে বুকে নিয়ে আছে। নন্দিনীর সংলাপেই আমরা প্রথম ‘রঞ্জন’ এবং ‘রক্তকবরী’ এই দুটি শব্দ শুনি। রঞ্জন মুক্তির অনুপ্রেরণা আর রক্তকরবী মুক্তির প্রতীক।
‘রঞ্জন আমাকে কখনো-কখনো আদর করে বলে রক্তকবরী। জানি নে আমার কেমন মনে হয়, আমার রঞ্জনের ভালোবাসার রঙ রাঙা সেই রঙ গলায় পরেছি, বুকে পরেছি, হাতে পরেছি।’
‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী প্রেমের প্রতীক। যক্ষপুরীতে নন্দিনীর এই প্রেমের পরশ রাজা পাননি তার লোভের জন্য, সন্ন্যাসী পায়নি তার কুসংস্কারের জন্য আর মজুররা পায়নি তারা নিজেরাই নিজেদের শেকলে বন্দি বলে।
তবু সেই যক্ষপুরীর শেকল ছেড়ে মুক্ত হওয়ার বারতা আনে নন্দিনী। নন্দিনীর এই আহ্বানে চঞ্চল হয় সবার হৃদয়। জেগে ওঠে সবার মধ্যে মুক্তির স্বাদ। অত্যাচারী রাজাও পেতে চাইল নিষ্কৃতি। কিন্তু লোভী রাজা যে কায়দায় স্বর্ণ মজুদ করেন, সেভাবে কী নন্দিনী নামের প্রেম আর শ্বাশত সুন্দরকে পাওয়া যায়। কেবল রাজা নয়, নন্দিনীকে পেতে চায় সবাই। মোড়ল, কিশোর, অধ্যাপক, কেনারাম, বিশু সবাই চায় নন্দিনীর স্পর্শ। কিন্তু নন্দিনীর ভালোবাসা শুধু একজনের জন্য। মানুষটির নাম রঞ্জন। রঞ্জনের মধ্যেই নন্দিনীর প্রেমের দিশা। অথচ রঞ্জনও তার নিজের শেকলে বন্দী।
‘রক্তকরবী’ নাটকে দেখা যায় যক্ষপুরীর অন্ধকারে পুরুষের সবল শক্তি ভূমিগর্ভ থেকে উঠিয়ে আনছে তাল তাল সোনা। এখানে শুধু কঠোর আর নিঠুর শ্রম দিয়ে সবার কেবল স্বর্ণ লাভের চেষ্টা। এখানে নেই মোটেও প্রাণের আহ্বান। তাই প্রেম সেখান থেকে যায় নির্বাসিত। যক্ষপুরীর মানুষরা ভুলে গেছে যে, সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি। ভুলেছে প্রতাপের মধ্যে নেই পূর্ণতা, প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা। নিজের শেকলের কাছে নিজেই তারা দাস। কিন্তু একসময় নন্দিনী রূপে সকলের চিত্তে দোলা দেয় প্রেম। তাই নন্দিনী চরিত্র দিয়ে বোঝা যায়, মাটির তল থেকে যে সম্পদ খুঁড়ে খুঁড়ে আনতে হয় নন্দিনী সে সম্পদ নয়। মাটির উপরিতলের প্রাণের রূপই হলো নন্দিনী।
তথ্যসূত্রঃ রক্তকরবী ফুল ও নাটকের পোস্টারের ছবি নিয়েছি গুগল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৪১