"তপনমোহন চট্টোপধ্যায় রচনাসমগ্র:"
মূলতঃ আমি বই কিনি অন লাইন থেকেই। তারপরও প্রতি বছর দুই একবার বই মেলায় যাওয়া হয় বই কিনতে। আমি বই কিনি মূলতঃ পরিকল্পনা করে। অর্থাৎ কি বই কিনবো- তা আগে থেকেই ঠিক করে নেই। কয়েক দিন আগে বন্ধু দেবু "তপনমোহন চট্টোপাধ্যা রচনাসমগ্র:" বইটি কিনেছে এবং বইটি পড়ে আমার সাথে বইয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছে। তারই প্রেক্ষিতে "তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় রচনাসমগ্র:" ওর থেকে পড়ার জন্য এনেছিলাম। বইটি পড়ে অনেক অজানা বিষয় জেনেছি- যার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি-
সিরাজ, মিরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল, জগৎশেট, উমিচাঁদ এদের কেউ বাঙালি নয়। আলিবর্দি খানের জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে, মিরজাফরের ইরানে। আর সিরাজের ধমনীতে ছিল তুর্কি রক্ত। তাদের কারও ভাষা বাংলা নয়। আর তাই যখন ইংরেজ সৈন্যের গোলার আঘাতে মুর্শিদাবাদের পতন হয়, পলাশির অম্রকাননে সিরাজের পতনের সূচনা হয় অথচ তখন সাধারণ কৃষকটি নির্বিকার জমিতে লাঙ্গল চালিয়ে গেলো। পরবর্তীতে সিরাজ যখন পালিয়ে গেল, বাংলার জনগণই তাকে ধরিয়ে দিল। তাই পূর্বকালে নবাবী পতনে মানুষ স্বাধীনতাহীনতা বুঝেছে, এটা ভাবতে আমার দ্বিধা হয়।
সিরাজকে নায়কত্ত্ব দেন নাট্যকার গিরিশচন্দ্র সেন। বাংলা ভাষায় যতগুলো ছবি হয়েছে সিরাজদৌলাকে নিয়ে সেইখানে সিরাজকে সৎ নিষ্টাবান এবং আদর্শ জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে! ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হওয়ার ফলে রাজনৈতিক ভাবেই সিরাজকে উন্নত চরিত্রের এক দেশ প্রেমিক বীর হিসাবে দেখিয়েছেন আমাদের পথ প্রদর্শকেরা। আসল সত্য জানতে হলে যে পাঠোভ্যাস তাতেও আমাদের অনেক ঘাটতি। সিরাজদ্দৌলা সম্পর্কে বানানো বহু মিথ বৃহত্তর বাংলায় প্রচলিত আছে। তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় বেশ কিছু সত্য উদঘাটন করেছেন, বাকীটাও করা দরকার। তাই আমার প্রচেষ্টা ভিন্ন দৃস্টিকোন থেকে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা।
-----------------------------------------------------------------
নবাব সিরাজ: ভিন্নচোখে দেখাঃ
সিরাজউদ্দৌলা বাংলা ও বিহারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে মাতামহ আলিবর্দী খাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে। সেই সময় দিল্লির অধীশ্বর এমন দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে সিরাজ তার অনুমতি প্রার্থনা করারও প্রয়োজনবোধ করে নি। এতে বেঁচে যান তিনি দিল্লিকে বিরাট অঙ্কের খাজনা দেওয়া থেকে।
রাজক্ষমতা হাতে পেয়ে সিরাজ প্রথমেই পূর্ববঙ্গের ঢাকা নিবাসী, কাকা নওয়াজিস মহম্মদের বিধবা স্ত্রী ঘসেটি বেগমের সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করার জন্য সৈন্য পাঠান। ঘসেটি বেগম সিরাজের খালা ও চাচী দুইই ছিলেন। ঘসেটি বেগমের নিজের রক্ষীবাহিনী সিরাজের সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভয় পেয়ে পলায়ন করায় সিরাজ বিনা বাধায় নিজের কাকিমা তথা খালার সমস্ত সম্পত্তি অধিকার করেন। কাকা নওয়াজিস মহম্মদের ডান হাত রাজবল্লভকেও কারাগারে বন্দী করে রাখেন।
রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণদাস তা জানতে পেরে সমস্ত নগদ অর্থ; হীরা-জহরত ও স্বর্ণ নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে যান এবং তৎকালীন গভর্নর ড্রেক সাহেবের থেকে সুরক্ষা নিয়ে সেখানেই থেকে যান। তিনি স্থির করেই নিয়েছিল যতদিন না পিতার মুক্তি হয় তিনি ঢাকা ফিরে যাবে না।
রাজবল্লভের সম্পত্তি এইভাবে হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় সিরাজ প্রচন্ড খেপে যায়। তিনি ড্রেক এর কাছে দূতের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠান কৃষ্ণদাসকে যেন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষ্ণদাসের বিরুদ্ধে অভিযোগের নির্দিষ্ট প্রমাণাদি দেখাতে না পারার জন্য ড্রেক সাহেব দূতকে নগর থেকে বহিষ্কার করে দেয়।
সেই সময় ভারতের উত্তরপূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল করমন্ডল উপকূলে ফরাসীরা প্রবল পরাক্রান্ত ছিল, এবং ইংরেজদের সঙ্গে তাদের সঙ্ঘর্ষ লেগেই ছিল। কলকাতায় ইংরেজদের যত সৈন্য ছিল, চন্দননগরে ফরাসী সৈন্য তার ছিল তার দশগুণ। এই কারণে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য কলকাতায় ইংরেজরা নিজেদের দুর্গের সংস্কার ও সৈন্যবল বৃদ্ধির উদ্যোগ করতে লাগল। এই খবর সিরাজের কানে গেল। ইংরেজদের উপর তার প্রবল দ্বেষ ছিল। সিরাজ ড্রেক সাহেবকে ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখলেন আপনি নতুন দুর্গ বানাতে পারবেন না, পুরনো যা আছে ভেঙে ফেলবেন এবং কৃষ্ণদাসকে আমার হাতে সমর্পণ করবেন।
সিরাজউদ্দৌলার সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া মাতামহের পুরাতন কর্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাহার প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা প্রতিদিন তাহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্রায় কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই”।
রাজ্যের প্রধান লোকেরা এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সিরাজের পরলোকগত আর এক কাকা সায়ক মহম্মদের পুত্র সওকতজঙ্গকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টায় দিল্লিতে অনুমতি প্রার্থনা করে দূত পাঠাল। যদিও সওকতজঙ্গ স্বভাবচরিত্রে সিরাজেরই মত। তবে তারা হয়ত ভেবেছিল আগে সিরাজ তো বিদায় হোক পরে দেখে শুনে একজন ভাল লোককে বেছে নিলেই হবে।
সিরাজ এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সওকতজঙ্গকে হত্যাকরার উদ্দেশ্যে পূর্নিয়া রওনা হলেন। এই সময় তার ড্রেক সাহেবের কাছ থেকে তার পত্রের উত্তর এল। ড্রেক সাহেব তার কোন কথাই রাখতে রাজী নন। সিরাজ পূর্নিয়া যাত্রা স্থগিত রেখে সসৈন্যে কলকাতার দিকে যাত্রা করলেন। পথে যত ইংরেজদের কুঠী ছিল সব লুঠ করল, এবং যত ইউরোপীয় দেখতে পেল সবাইকেই বন্দী করলেন।
-------------------------------------------------------------------------
যে কোন গঠনমূলক সমালোচনা কে স্বাগত জানাই। ভিন্ন মত আমাদের মনন কে সমৃদ্ধ করে সন্দেহ নাই।
তথ্য সূত্র:
উইকপিডিয়া প্রচুর ঘেঁটেছি। সেখানেও অনেক কিছু না বলা থেকে গেছে। বিদ্যাসাগরের লেখা বাংলার ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা। ওই বইটি স্কুলপাঠ্য করা উচিত ছিল। সেরা বই।
তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় রচনাসমগ্র: এক সময়ে শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে পাওয়া যেত এই বই, যেমনটি যেত তাঁর লেখা পলাশির যুদ্ধ, পলাশির পর বক্সার, মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড ইত্যাদি বই।