'কাঞ্চনজঙ্ঘা' কিছু কথা.....
"পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়..."- নিয়ে কদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়া সরগম! কাঞ্চনজঙ্ঘা নাম শুনলেই আমার মনে ভেসে ওঠে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমার কথা। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমাটা একাধিক বার দেখেছিলাম।
‘পথের পাঁচালী’ বাদ দিলে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সমস্ত ছবির মধ্যে আমার কাছে সেরা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। হয়তো সব ক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়না, কিন্তু কিছু আলোচনা করাই যায়। এ এমনই এক ছবি যার শুরু থেকে শেষ দৃশ্যের প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি সংলাপ এবং আবহসংগীতের প্রয়োগে এতটাই গভীর ভাবনা চিন্তার ছাপ যা বিরল। 'কাঞ্চনজঙ্ঘ' বোধহয় সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র ছবি যে ছবিতে গল্প নেই। কিছু ঘটনার কোলাজ এবং তার মধ্যের কিছু চরিত্র, যাঁদের সমস্যা, ঘাত প্রতিঘাত ধরা হয়েছে কোলাজের আকারে। আপাতত ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
আমার কাছে এ ছবির দুটো দিক, এক হেরে যাওয়ার দিক আর এক জিতে যাওয়ার। সবই ঘটছে দার্জিলিংয়ে একটি সচ্ছল পরিবারের বেড়াতে গিয়ে। কাঞ্চনজঙ্ঘা, পৃথিবী বিখ্যাত পর্বতমালার পাদদেশে। হয়তো এই স্থানে ঘটনা না ঘটলে জেতা’রা চিরদিন জিতে থাকতো, হারারা চিরদিন হেরেই থাকতো। বিশাল পর্বতমালার পদতলে মানুষের অস্তিত্ব কতটুকু? শহরের ব্যস্ত চঞ্চলতায় যত বড়োলোকি করা যায় বা প্রাচুর্যের নীচে মাথা নিচু করে কাটাতে বাধ্য হলেও বিশাল প্রকৃতির কোলে যেন সবাই সমান। যেখানে আমির ফকিরের কোনও তফাৎ থাকেনা। যদিও ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষরা সহজে বশ্যতা স্বীকার করতে চাননা। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে স্বীকার করতে বাধ্য হন। এ ছবি তেমনই এক আশ্চর্য পটভূমিতে নির্মিত।
ছবির শুরুতেই দেখা যায় এমনই এক ক্ষমতাবান পুরুষ’কে। বিরাট শিল্পপতি, অর্থের অভাব নেই। ইংরেজদের পা চাটা ‘রায়বাহাদুর' উপাধি পাওয়া রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরী নিজেই জানিয়েছেন "একদা তাঁর দুজন সহপাঠী ইংরেজ তাড়াতে গিয়ে একটা গুলি খেয়ে কুত্তার মতো মরেছে, আর একটা সেলুলার জেলে মরেছে"। তিনি যে বোকার মতো সে পথ মাড়াননি গর্বের সাথেই জানালেন এবং ইংরেজদের দেওয়া উপাধির জন্য তিনি গর্বিত! এ হেন পুরুষ কতটা দোর্দন্ড হতে পারে সহজেই অনুমেয়। যাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ’প্রয়োজন’। অর্থাৎ প্রয়োজনহীন যে কোনও কিছু তাঁর কাছে মূল্যহীন। প্রথম দৃশ্যে দু তিনটি সংলাপে যা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শিল্পপতি রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরীর শ্যালক যিনি পাখি নিয়ে গবেষণা করেন। পাহাড়ে এসেও যিনি দিনরাত বিভিন্ন প্রজাতির পাখি খুঁজে বেড়ান। তিনি যখন একটি দুষ্প্রাপ্য পাখির খোঁজ দিলেন জামাইবাবুকে, জামাইবাবু প্রথমেই জানতে চাইলেন, "ওই পাখির রোস্ট হয় কিনা?" এবং স্পষ্টই জানালেন তাঁর কাছে "পাখির মূল্য মাংশ খাওয়া টুকুই"! এহেন অহংকারী পুরুষটির মধ্যে যে আবার কতটা কুসংস্কার রয়েছে তাও বুঝিয়ে দিলেন একটা ছোটো দৃশ্যে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে টাইগারহিলে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়ার মুখে রাস্তায় একজনের হাঁচি শুনে থমকে গেলেন। নিমেষে মুখটা বেজার হয়ে গেল। স্ত্রীকে বললেন একটুখানি দাঁড়িয়ে যেতে!
ইনি এমনই এক পুরুষ কখনো হারতে চাননা। সংসারে তিনিই শেষ কথা। তিনি যা বলবেন সবাইকে তাই মানতে হবে। দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসার মূল কারণ ছোটো মেয়ে মনীষার সাথে বিলেত ফেরত এক প্রকান্ড ইঞ্জিনিয়ারকে ভিড়িয়ে দেওয়া। মেয়ের পছন্দ অপছন্দ নিতান্তই গৌণ। পছন্দের বিপরীতে গিয়ে বিয়ে করার ঘোর বিরোধী হয়েও স্ত্রীর প্রতিবাদের কোনও মূল্য নেই। শিক্ষিতা, গুণসম্পন্না স্ত্রীর পরিচয় শুধুমাত্র সন্তান প্রসব করা নারী মাত্র। যিনি একদা গানের চর্চা করতেন। কিন্তু বর্তমানে সব বন্ধ।
"এখনই বিয়ে করলে ছোটো মেয়ের বি.এ পরীক্ষার কী হবে?"- এ প্রশ্নের উত্তরে কর্তা মহাশয় বললেন, "দুটো বিয়ে একসঙ্গে হতে পারে না। তা ছাড়া মেয়েমানুষ বেশি পড়াশোনা করলে পুরুষের ভাত বন্ধ হয়ে যায়"!
এই যার নারী সম্পর্কে দর্শন তাঁর কন্যা সন্তানদের পরিণতি কী হবে সহজেই অনুমেয়। অথচ একমাত্র পুত্র যার কাজ হলো দিনমান সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গ দেওয়া। রেস্টুরেন্টে তাদের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ধ্বংস করা। আর ক্যামেরায় সুন্দরীদের ছবি তোলা। যদিও সুন্দরীরা বন্ধুত্ব করে, খায় দায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ তাকে পাত্তা দেয়না। ছেলে অবশ্য দমবার পাত্র নয়। আবার অন্য কোনো সুন্দরী মেয়ের ঘাড়ে পড়ে আলাপ করে। এটাই তার নেশা। পিতৃদেবকে তার এই কর্মে অবশ্য বাধা দিতে দেখা যায়না বরং বলেন, " পুরুষদের মধ্যে অমনটি থাকা অন্যায় কিছু না"! যত কড়াকড়ি যেন কন্যাদের ব্যাপারে।
বাবার জোরাজুরিতে বড় মেয়ের দাম্পত্য জীবন যে সুখী হয়নি তাও দেখা যায় ঘটনার কোলাজে। এ হেন পুরুষ যাঁর মুখের ওপর কেউ কোনোদিন কথা বলেনি সেই তাঁরই মুখের ওপর কথা বলে বসল নিরীহ গোবেচারা একটি ছেলে।
তার কাকার সাধ হয়েছিল দার্জিলিং বেড়ানোর। ভাইপো অশোক নিয়ে এসেছিল কাকাকে দার্জিলিংয়ে। কাকা হঠাৎ দেখেন সপরিবারে বেড়াতে এসেছেন রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরী। যাঁর ছেলের একসময় তিনি টিউটর ছিলেন।
বেকার ভাইপোর জন্য এ পরম সুযোগ কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না। ভাইপোর শত আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন কর্তা মশাইয়ের কাছে। এবং বলে বসলেন ভাইপোটি পাশকরে বসে আছে, তাকে যেন কর্তা মশাই দেখেন।
পরে ভাইপোকে একা পেয়ে কর্তা মশাই বুঝিয়ে দিলেন তিনি এসব পছন্দ করেন না। কোনও অযোগ্য অন্যের দানে চাকরি জুটিয়ে কোম্পানির উন্নতি ঘটাতে পারে না। অশোক ভীষণ অপমানিত হয়। সে বেকার এ কথা ঠিক, কিন্তু অযোগ্য কিছুতেই নয়। পরে কর্তা মশাই দয়াপরবশ হয়ে জানতে চান কত টাকার চাকরি হলে তার চলবে? সে কত টাকার চাকরি আশা করে? মুখের ওপর অশোক বলে দেয়, "আপনার দেয়া চাকরির দরকার নেই। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।"
এ উত্তর শুনে কর্তার আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু বিমর্ষ হয়ে গেলেন। কারণ তাঁর অফারকে এমন করে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে এ ভাবনাতেই ছিল না। রাগে নিজের চুরুট ছুঁড়ে ফেললেন রাস্তায়৷ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো অশোক।
এ ছবিতে আরও একজন জিততে এসেও হেরে গেলেন তিনি মিস্টার ব্যানার্জী। বিলেত ফেরত মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। বংশ ও পেশার মহিমায় গর্বিত। রায়বাহাদূর সপরিবারে দার্জিলিং এসেছেন ছোটা মেয়ে মনীষা(মনি)র সঙ্গে তার আলাপ জমাতে ও বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করতে।
ছবি শুরুতে মা'কে মনি জানিয়েছিল 'মা আমি কিন্তু বেশি সাজগোজ করছি না'। মা সম্মতি জানিয়ে বলেছিল, 'রোজ যেমন করিস তাই কর'!
যথারীতি বাবার নির্দেশে ইঞ্জিয়িয়ারের সাথে ঘুরতে হলো। কিন্তু কিছুতেই তার ভালো লাগছিল না। হয়তো মানুষ, বংশ মর্যাদায় ও পেশাগতভাবে মোটেই খারাপ নন মিঃ ব্যানার্জী। কিন্তু মনীষার ভালো লাগছিল না। যেন সে পালাতে পারলে বাঁচে। তার ভালো লেগেছিল কাকার সঙ্গে অশোক বলে যে বেকার ছেলেটি এসেছে তাকে। খুবই অভাবী, সাধারণ বাড়ির। যার ছোটোবেলায় বাবা মারা গ্যাছে। মা অসুস্থ। পঞ্চাশ টাকার টিউশনি করে। অন্যের প্যান্ট ধার করে ইন্টারভিউ দিতে যায়। দার্জিলিং বেড়াতে এসেছেও অন্যের ধার করা প্যান্ট পরে। তবুও তার বাবার দেওয়া চাকরির অফার মুখের ওপর না করে এসেছে।
মিস্টার ব্যানার্জী অবশ্য শেষ পর্যন্ত মনীষাকে মুক্তি দেয়। বলে, "আজকে এই রোম্যান্টিক স্যারাউন্ডসে তোমার হয়তো মনে হচ্ছে যে love is the most important thing in the world, কিন্তু কলকাতায় ফিরে গিয়ে কখনো যদি তোমার মনে হয় যে প্রেমের চেয়েও সিকিউরিটিটা বড় কিংবা সিকিউরিটি থেকেও একটা প্রেম গ্রো করতে পারে তখন তুমি আমাকে জানিও।"
মনীষা জানতে চায়, 'আর এখন?'
"এখন ইউ আর ফ্রি"।
'ওঃ মিঃ ব্যানার্জী'!'- মনীষার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সে যেন এ যাত্রায় বেঁচে গেল।
এ ছবি নিয়ে যে কত লেখা যায়। ফ্রেম ধরে ধরে আলোচনা করা যায়। এমনিতেই লেখা বড়ো হয়ে গিয়েছে।
একটা ছোটো মনঃস্তাত্ত্বিক দৃশ্যের কথা বলে শেষ করছি। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে মনির মা যখন একা আপন মনে গান গাইছিল, 'এ পরবাসে রবে কে.....'। পেছন থেকে গান শুনছিল মনির মামা। মনির মায়ের দাদা। দাদা আস্তে আস্তে বোনের কাঁধে হাত রাখে। কত বছর পর বোনের গান শুনলেন। হয়তো এই পরিবেশ বলেই সম্ভব হয়েছে।
দাদাকে পেয়ে হঠাৎ যেন মনির মায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল।
-'দাদা, মনিকে একটা কথা বলতে পারলে ভালো হতো'।
"এখনি?"
-'হ্যা এক্ষুনিঃ।
"তা তুই উঠছিস কেন? তুই তোর মেয়েকে খুঁজে বেড়াবি? আমি বললে হবে না?"
-'হবে।'
"কী বলবো বল?"
-'বলবে, আমার নাম করে বলবে৷ সে নিজে যা ভালোবোঝে তাই যেন করে। কোনো দিক থেকে কোনো জবরদস্তি নেই।'
"কিন্তু জামাইবাবু?"
-'সে আমি বুঝবো। ঝগড়া করতে হয় আমি করবো। সবই যদি মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় বেঁচে থেকে লাভ কী?'
আমার মনে হয় এই সংলাপ সব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সারা জীবন সব মুখ বুজে সহ্য করে এই বিদ্রোহ ঘটতে পারত কাঞ্চনজঙ্ঘা'র পদতল ছাড়া? শুধু পরিবেশ কত মানুষের ভেতর থেকে কত কথা বের করে আনল। কত জেতা মানুষকে হারিয়ে দিল। কত হারা মানুষকে জিতিয়ে দিল।
ইন্দ্রনাথ চৌধুরী চরিত্রে ছবি বিশ্বাস, লাবন্য চৌধুরী চরিত্রে করুণা ব্যানার্জি, অশোক চরিত্রে অরুণ মুখার্জি, মনীষা চরিত্রে অলকানন্দা রায় এবং জগদীশ চরিত্রে পাহাড়ি স্যান্যালের অভিনয় অতিক্রম করার মতো কোনো শিল্পীর বিকল্প গত অর্ধশতাব্দীতে এখনো জন্ম নেয়নি বলেই আমার ধারণা।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ পঞ্চগড় থেকে তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিগুলো নিয়েছি আমাদের সুপ্রিয় সহব্লগার আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ ভাইর ফেসবুক পোস্ট থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৯