চরম পানি সংকটে রাজধানীবাসী
নানাবিধ কারণেই পানির নাম হয়েছে জীবন। পানির অপর নাম ‘জীবন’ হলে বলতে হবে রাজধানীর মানুষ ‘জীবন সঙ্কটে’ আছে। এই পানি নিয়ে ভয়াবহ ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রাজধানীবাসী। দীর্ঘ দিন যাবত রাজধানীর প্রায় সর্বত্রই ওয়াসার পানি দুষিত ও দুর্গন্ধময়। বাধ্য হয়ে এ দূষিত-বিষাক্ত পানিই ব্যবহার করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সুপেয় পানি কিম্বা কৃষির ও কল কারখানার জন্য জন্য প্রয়োজনীয় পানিরও অভাব দেশ জুড়ে। আমি শুধু ঢাকা মহানগরীর পানি সমস্যা নিয়েই লিখছি।
পানি নাই কিম্বা যা আছে তা দুষিত হলেও পানির বিকল্প কিছুই নাই। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে জীবন ধারণে পানির প্রয়োজন। খাওয়া, গোসল, রান্না, কাপড় ধোয়া, টয়লেট, বাগান ও কনস্ট্রাকশনসহ জনজীবনের নানা কাজে পানির ব্যবহার অবধারিত। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ওয়াসার পানির সরবরাহে যেমন ভয়াবহ স্বল্পতা তেমনই সরবরাহকৃত পানি ব্যবহার অযোগ্য। ট্যাপ খুললেই বেরিয়ে আসছে ফেনা আর ময়লাযুক্ত পানি। ওয়াসা ঢাকা মহানগরীর বাসিন্দাদের পানির নামে যা সরবরাহ করছেন তা নানা বর্ণের, নানা গন্ধের এবং নানা স্বাদেরও। পান করা দূরে থাক, এই পানিতে গোসল, রান্না এবং হাত-মুখ ধোয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। ফোটালেও দুর্গন্ধ দূর হয় না। ফিল্টারে এই পানি ফিল্টারেশন হয়না। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের এ পানিই একমাত্র ভরসা। তাঁরা বাধ্য হয়ে এই পানি ব্যবহার করছেন। কোথাও কোথাও ওয়াসার পানির লাইনে বিশুদ্ধ পানির পরিবর্তে মানুষের পয়ঃবর্জ্য পর্যন্ত ঢুকছে। এ পানি ব্যবহারের ফলে ঢাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন।
বিত্তশালীরা পানি কিনে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হলেও নিম্নআয়ের মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব। রাজধানীতে বিকল্প পানি সংগ্রহ দুর্মূল্যের বিষয়। পানি কিনে দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য আছে হাতেগোনা কিছু মানুষের।
দূষিত পানি পান করার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিশদ বলার অপেক্ষা রাখে না। পেটের পীড়া, জণ্ডিস, পাকস্থলির রোগব্যাধি, কিডনি বিকলসহ মারাত্মক ও ঘাতক ব্যাধির কারণ দূষিত পানি। ওয়াসার পানিতে মল, কেঁচো, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি কী-না পাওয়া যায়। বিশেষ করে পানি দুর্গন্ধযুক্ত হয় ওয়াসার পাইপে লিকেজের কারণে। রাজধানীর অধিকাংশ পানির পাইপই স্যুয়ারেজের সঙ্গে লাগানো।একেতো পুরনো পাইপ-তারউপর যত্রতত্র এবং যখন তখন খোঁড়াখুঁড়ির ফলে এসব পাইপের অধিকাংশই টুটা-ফাটা। ফলে ওয়াসার পানির সঙ্গে স্যুয়ারেজের মলমূত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পত্রিকায় সরকারের নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকান্ডের বড়বড় হেডলাইন পড়লেও মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কোনো খবর চোখে পড়ে না।
ওয়াশার পানিতে কি বিষ? বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ করেছি-একুরিয়ামের পানি বদল করলেই শক্ত সামর্থ মাছুগুলোও মরে যাচ্ছে। বাড়ির ছাদে লাগানো বিভিন্ন গাছে কিম্বা বাগানের গাছে ওয়াশার পানি দিলে অনেক গাছ মরে যাচ্ছে কিম্বা অনেক গাছের পাতা পূড়ে যাচ্ছে, ছিদ্র ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে! ওয়াশায় কমপ্লেন করলে জানায়- ওয়াশার উতস পানি অতিরিক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত হবার কারনে হান্ড্রেড পার্সেন্ট পিউরিফিকেশন করা যাচ্ছেনা।কল কারখানার বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদির পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ায় পানি ২য়বার পরিশোধন করে নগরবাসীকে সরবরাহ করা হচ্ছে।কিন্তু পানি দুষনমুক্ত হচ্ছেনা।
শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীতে পানির চাহিদা প্রতিদিন ২২০ থেকে ২২৫ কোটি লিটার। পানির এই চাহিদা মেটানো হয় গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং শীতলক্ষ্যার পানি পরিশোধন করে সরবরাহের মাধ্যমে।
আমার ধারনা, পানির প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন বড় শহরের তুলনায় ঢাকা শহরের অবস্থান সুবিধাজনক। ঢাকার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এর চারপাশে নদী। এসব নদীই হতে পারে ঢাকা শহরের পানির প্রধান উত্স। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত কোনো সুপরিকল্পনার খবরও আমাদের জানা নেই। ঢাকা শহরের মোট চাহিদার ১৫ ভাগ পানি নদী থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাকিটা গভীর নলকূপ থেকে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের পানি অতিমাত্রায় দূষিত হওয়ায় তা পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা সত্বেও ঢাকা শহরের মোট চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয় গভীর নলকূপের সাহায্যে মাটির নিচ থেকে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়-ওয়াশার পানির পাম্প আছে কিন্তু সেই পাম্প চালানো যাচ্ছেনা বিদ্যুতের অভাবে। জরুরী পাওয়ার সার্ভিস ব্যাক আপেরজন্য নেই জেনারেটর। বর্তমান অবকাঠামোতে পর্যাপ্ত পাম্প থাকলেও বিদ্যুত্ সরবরাহ না থাকলে পানির সমস্যা থাকবেই। নাগরিকদের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সরকারের কর্তব্য। এটি দয়া নয়, মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষের অধিকার দিতে সরকারের আন্তরিকতাই কাম্য। পানি সঙ্কট নিরসনে পদ্মা-যমুনাসহ রাজধানীর নিকটবর্তী নদীগুলো থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি এনে সরবরাহের প্রকল্প গ্রহন করলে পানির সমস্যা অনেক সহজেই লাঘব করা সম্ভব।
সুপেয় পানি পাওয়া মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার থাকলেও সরকার এই বিশয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেনা। সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছেন আরো একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর-যা আমাদের প্রয়োজন হবে আগামী ১০/১৫ বছর পর!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৮:০৮