somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পটা আসলে এমন নয়

০৮ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শুরুতে কোনো সম্বোধন করলাম না বলে আশা করি কিছু মনে করনি। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা করি এখন তোমার নতুন সংসার আর নতুন আত্মীয়তার চক্রে নিশ্চয় নিজেকে আবার ফিরে পেয়েছ। অনেকটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারছ। তোমার নতুন জগতের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারছ বুক ভরে। এখন আশপাশের কেউ নিশ্চয় বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে না তোমার দিকে। শুনতে হচ্ছে না আমাকে কেন্দ্র করে কারো পিত্তি জ্বালানো কথাবার্তা। হয়তো এসব নিয়ে খোঁটা দেবার মতও কেউ নেই তোমার আশপাশে। আমি তো ছিলাম তোমার দু পায়ের ডাণ্ডা বেড়ি। যে কারণে আমাকে ছেড়ে যেতে পারনি আরো অনেক আগে। হতে পারে তোমার ধারণা ছিল না যে, আবার তোমার নিজস্ব একটা জগত হবে। যে জগতে শ্বাস ফেলবার মতো নিজস্ব একটা আকাশ হবে। পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো হাতের মুঠোয় পেয়ে যাওয়া তোমার রাজ্যে আমি হয়ে গেলাম অনাকাঙ্ক্ষিত, উটকো একটি ঝামেলা। কুঁড়েঘর থেকে স্থানান্তরিত হলে প্রাসাদে। যেখানে হয়তো আমি একেবারেই বেমানান। ধরেই নিচ্ছি, তুমি যেখানে আছ সুখ এবং শান্তিতেই আছ। যেটা আমার বাবা কখনওই তোমাকে দিতে পারেনি।

তবে, একটা কথা কি জানো মা? বাবা তোমাকে ছেড়ে যাওয়াতে যতটা কষ্ট পেয়েছিলে, আপনজনদের কাছে যতটা হেয় হয়েছিলে, সে সময় অতটা বুঝতে না পারলেও এখন কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারি যে, বাবার প্রতি তুমি কতটা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছিলে সে সময়। তোমার পক্ষে সম্ভব হলে কী কী না করতে এখন ভাবলে শিউরে উঠি। আমার ভেতরকার সেই ভীতু আর নির্বোধ বালকটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বোবা যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে।

তোমার মনের অন্ধকার বীজতলায় আমার বাবার প্রতি ঘৃণা আর প্রতিশোধের বীজে অংকুরিত বিধঘুটে চারাটি আস্তে আস্তে মহীরুহ হয়ে উঠতে উঠতে শেকড়বাকড় বিস্তার করেছিল তোমার বাবা-মা আর ভাইবোনদের মাঝেও। যার প্রথম ধাপে তোমার মা আর তুমি গিয়ে অভিযোগ করলে চেয়ারম্যানের দরবারে। অবশ্য পরে যা শুনেছি, সেগুলোকে অভিযোগ না বলে কুৎসা বলাটাই উচিত মনে করি। কথায় আছে না যে, মূর্খের বিষ দাঁতে? তোমরা কিন্তু তার চেয়ে কম কিছু বলোনি। কিন্তু আশপাশে যারা ছিল, তারা কম বেশি সবাই বাবার সম্পর্কে পজিটিভ ধারণা পোষণ করতেন বলে, তোমরা সেখানে নখ বসাতে পারনি। আর সেটা পারনি বলেই মাতা-কণ্যা আরও মরিয়া হয়ে উঠলে। তোমরা নিতে গেলে আরও বড় আর নোংরা একটি পদক্ষেপ। যদিও তোমার মুখেই শুনেছি যে, বাবা তোমার দেনমোহর পরিশোধের কথা তোমাদের বিয়ের কাগজেই উল্লেখ করে দিয়েছিল। তোমরা করলে কী? আমার প্রবাসী বাবার নামে থানায় গিয়ে দায়ের করলে নারী নির্যাতন আর যৌতুক বিরোধী মামলা। আমার মাথা ছুঁয়ে কি বলতে পারবে যে, বাবা কখনও তোমাদের কাছে যৌতুক চেয়েছে? অথচ এ নিয়ে মোটেও লজ্জা পাওনি তোমরা। লজ্জা পাওয়ারই বা কী প্রয়োজন?

এই তোমাদের মানে, বাংলাদেশের নারী কূলের খুব বড় একটা উপকার করেছে আইন মন্ত্রণালয়। বাঁদরের হাতে খুন্তি অথবা পাগলের হাতে লাঠি তুলে দেওয়ার মতো একটি ভয়াবহ আইন রয়েছে তোমাদের পক্ষে। যে আইনের বদৌলতে তোমরা মেয়েরা সময় অসময়ে পুরুষদের যেমন টাইট দিতে পারছো তেমনই একই আইনের মামলা দিয়ে চৌদ্দ শিকের ভয় দেখিয়ে কেউ কেউ যা খুশি তা করে ফেলতে পারছো। বলতে পার শিবের বুকে দাঁড়িয়ে মা কালীর উদ্বাহু নৃত্যের মতো একটি উন্মুক্ত মঞ্চ পেয়ে গেলে। মাঝে মধ্যে এমন উড়ো কথাও শুনতে পাই যে, নারী নির্যাতনের মামলার হুমকি দিয়ে সত্তর আশি বছর বয়সের বৃদ্ধ শ্বশুরের কাছ থেকে সম্পদ লিখিয়ে নিয়েছে পুত্রবধূ। আরও অনেক কিছুই শুনতে পাই যা নারী নির্যাতনের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ কেমন যুগে বড় হচ্ছি বা কেমন পৃথিবীতে আমাদের রেখে যাচ্ছ মা, বলতে পার?

বাবার সৌভাগ্য বা কোনও সৎকর্মের গুনেই হয়তো বাবা দেশে ছিল না। নয়তো তোমাদের ওপর মহলের হস্তক্ষেপে বাবার জেলবাস কেউ আটকাতে পারতো না। এমনও হতে পারতো যে, বাবার ওপর নেওয়া তোমাদের প্রতিশোধটা ইতিহাসের প্রথম সারিতেই লেখা হয়ে যেত। কিন্তু সেটাও যখন পারলে না, তোমরা এগিয়ে গেলে আরও এক ধাপ ওপরে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে বাবাকে দেশে ফিরিয়ে আনার মতো এক কঠিন জাল বুনতে আরম্ভ করলে।

কোরআনে নিষেধ করা আছে সীমা লঙ্ঘনের কথা। তোমরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলে। তোমার মা যদি স্ট্রোক করে বিছানায় না পড়তেন তাহলে তোমাদের প্রতিশোধ স্পৃহা যে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতো তা হয়তো সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ ধারণা করতে পারেনি। তাই অনুমান করি যে, তোমার মায়ের এ স্থবিরতা বাবার প্রতি সৃষ্টিকর্তার অসীম এক করুণা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু তোমার মাথা থেকে মায়ের হাত সরে গেলে ঠুঁটো জগন্নাথ বা ঢাল তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম হয়ে তুমি কী করলে? আমাকে আঁকড়ে ধরে পায়ের তলায় মাটি ফিরে পেতে চাইলে। সে সঙ্গে দিনে দিনে বাবার বিরুদ্ধে আমাকে বিষিয়ে তুললে নানাভাবে। অথচ তুমি ভালো করেই জানতে যে, আমার সেই হাঁটি হাঁটি পা পা সময় থেকেই বাবাকে তেমন কাছে পেতাম না। যা ও দু তিন বছরে দু আড়াই মাসের জন্য বাবা দেশে আসতো, তাও তাকে চিনে উঠতে না উঠতেই তার ছুটি ফুরিয়ে যেতো। তাই হয়তো বাবার প্রতি সন্তানের যে একটা দুর্নিবার টান তেমন কোনো কিছু অনুভব করিনি কখনও। বাবা তো আছেই। অন্যদের যেমন থাকে। বুঝের মধ্যে এতটুকুই বুঝতে পারতাম।

মাঝে মাঝে কখনও বা ঈদ-পার্বণে বাবার ওখানে যেতাম। দাদীজানের ভালোবাসাটা খুব টানতো আমাকে। বাবাও বলতো যে, এখানেই থেকে যা। বই-পুস্তক নিয়ে চলে আয়। আমাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। পরের বাড়ি কদিন থাকতে পারবি? এক সময় ঠিকই বিরক্ত হবে।

কিন্তু বাবার কথায় পাত্তা দিতাম না। ভাবতাম, মা তো আমার আছে। বাবার কাছে চলে গেলে মা'কে দেখতে পাবো না। তবে, এ কথাও জানতাম যে, বাবার সঙ্গে তোমার আর সম্পর্ক নেই। সেটা কোনোভাবে জোড়া লাগা সম্ভব না। তোমার দোষেই হোক আর বাবার দোষেই হোক তোমাদের মাঝে যে বিচ্ছেদ তা স্থায়ী। বাবা যে তোমাকে ফিরিয়ে নেবে না বা তুমিও যে বাবার কাছে ফিরে যাবে না, সে ব্যাপারটা ততদিনে বেশ বুঝে গেছি।

ক্লাস ফাইভে জিপিএ ফাইভ পেয়ে যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে গেলাম, তুমি শিখিয়ে পড়িয়ে বললে, বাবা নেই। মারা গেছে। কথাটা যেন বলি। কিন্তু কথাটা শুনে আমার ভালো লাগেনি। বলেছিলাম, বাবা তো আছে। মিথ্যে বলতে হবে কেন? উলটো ধমক দিয়ে বলেছিলে যে, যা বলছি তাই হবে। আর যদি কারো কাছ থেকে শুনতে পাই যে বলেছিস তোর বাবা বেঁচে আছে, তো সেদিনই তোকে জবাই করবো।

এত নিষ্ঠুর তুমি? আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এত নিষ্ঠুরতা কি মায়েদের মানায়? আমার চোখে ভাসছিল পত্রিকায় ছাপানো সেই সংবাদগুলো, যেখানে মা তার সন্তানকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। কোথাও বা কোনো মা তার সন্তানকে মেরে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে। যদিও তখন মনে হতো যে, পত্রিকায় অনেক মিথ্যা খবরের মতো সেসবও মিথ্যা। বানোয়াট। কিন্তু সেদিন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তোমার কথা অবিশ্বাস করতে পারিনি। বুঝতে পারছিলাম যে, মা যেমন মমতাময়ী, প্রয়োজনে ডাইনীও হয়ে উঠতে পারে।

সেদিন তোমার কথা মেনে নিয়েছিলাম। কারণ তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি যে আমার মা। পরম নির্ভরতা, ভালোবাসা আর আরাধনার জগত। তোমাকে ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার। তোমাকে হারালে আমি মরে যাবো। কিন্তু আর একটু বড় হয়ে মনে মনে হাজারবার তোমাকে প্রশ্ন করেছি যে, বাবাকে জেল খাটাতে পারো নাই। জেলে রেখে পচাতে পারো নাই। তাই বুঝি তার সন্তানের মুখ দিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করে প্রতিশোধ নিলে? এতে কি তোমার মনে জ্বলতে থাকা আক্রোশের আগুনটা নিভেছিল? সত্যিই কি তুমি সুখ পেয়েছিলে?

ভালো করেই জানি, এ জিজ্ঞাসার উত্তর তোমার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। আশাও করি না। আর যদিওবা প্রশ্নটা করতাম, তাহলে ভিন্ন কথা বলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে এ কথা আমার চেয়ে কে আর ভালো জানে? তোমাকে খুব ভালোবাসি বলেই, তোমাকে খুশি করতে জেনে বুঝে তোমার পরিচিত গণ্ডীতে সুস্থ-সবল মানুষ আমার বাবাটাকে মুখের কথায় মেরে ফেলেছি। তোমার খুশিই যে আমার খুশি মা! তুমি খুশি হবে ভেবেই তো ফেসবুকে বাবার সঙ্গে চ্যাটিং বাদ দিয়েছি। বাবার ফোনকল রিসিভ করতাম না। যদিওবা তুমি রিসিভ করে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলতে, তোর বাবার কল। কথা বল! কিন্তু তোমার চেহারা দেখেই বুঝে যেতাম যে, তুমি মন থেকে চাও না আমি বাবার সংগে কথা বলি। এটাও বাবার প্রতি তোমার এক ধরনের প্রতিহিংসা। বুঝতে পেরে বাবাকে শুনিয়েই অনেকবার বলেছি যে, কথা বলবো না।

ক্লাস সেভেনে যখন উঠে গেলাম, আমার ক্লাসের অনেকেই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতো। আমারও ইচ্ছে করতো সাইকেল পেতে। আরো ছোট থাকতেই বাবা আমার সাইকেলের শখ পূরণ করেছিল। অনেকদিন তো হলো বাবার কাছে কিছু চাই না। একদিন কী যে হলো, মনের ভুলেই হয়তো বাবাকে ফোন করে বসলাম। ফোনে বাবার সেই পুরোনো আর উচ্ছ্বাস ভরা সম্বোধন শুনে প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলাম। শৈশবের অভ্যাস বশে বলেও ফেললাম, আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিবা?

হঠাৎ বাবা হাহা করে হেসে উঠলে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা তো মোটেও বদলায়নি। ধরে নিয়েছিলাম, আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম যে, এই বুঝি আগের মতো বাবা বলে উঠবে, সাইকেল কবে দরকার? দাম কত? কোথায় পাওয়া যায়? কিন্তু আমাকে আরো হতবাক করে দিয়ে বা কী বলেছিল জানো? আমি জানি এ কথা তোমারও কল্পনাতে আসবে না। মাথায় তুলে আছাড় দেওয়ার মতো বাবা বলে উঠলো, মৃত মানুষ কি কিছু করতে পারে? তুমি না স্কুলে বলেছ যে, তোমার বাবা মারা গেছে?

ছি ছি! কী করলাম এটা? আমিই যে এ কথা বলেছি নিজেই তা ভুলে গেছি! আরো আশ্চর্যের কথা এই যে, কথাটা বাবা জানলো কীভাবে? তার চেয়ে বড় কথা আমার তখন কেমন লেগেছিল তুমি কি ভাবতে পার? তুমি কি ধারণা করতে পার যে, কত বড় একটি মিথ্যার বোঝা আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছ? বাবা কি এটা বাকি জীবনে ভুলতে পারবে না আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? তুমি যে কত বড় যন্ত্রণার যাঁতাকলে আমাকে ফেলে গেলে, তা কখনও অনুধাবন করতে পারবে না।

আরেকটি ঘটনার কথা তো তোমাকে বলাই হয়নি। আমি তখন সিক্সে। তোমার কি মনে আছে, একবার স্কুল থেকে ফেরার সময় অনেকগুলো চকলেট নিয়ে এসেছিলাম? তোমাকে তো বলেছিলাম যে, বাবা এসেছিল। এই চকলেটগুলো দিয়ে গেল। সেদিন কী হয়েছিল জানো মা? প্রথম বাবাকে দেখে চিনতেই পারছিলাম না। কেমন ক্ষ্যাপাটে দেখাচ্ছিল। ভেবেছিলাম কোনো নতুন পাগল বুঝি আমাদের স্কুলে ঢুকে পড়লো। হা হা হা! তা ছাড়া কতদিন ধরেই তো বাবাকে দেখি না। ভুলেই যাচ্ছিলাম প্রায়। ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে যখন আমাকে ডাকছিল বাবাকে চিনতে পারলেও ভয় পেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে না, বাবা এসে যদি কাছে যেতে বলে আমি যেন না যাই? মনে আছে কি না তোমার! বলেছিলে, জাদুর ছোঁয়া দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে বাবা সঙ্গে নিয়ে যাবে। তোমার কাছে আর ফিরতে দেবে না। বাবাকে চিনতে পেরে এগিয়ে গেলেও বাবা যাতে আমাকে ধরতে না পারে, ছুঁতে না পারে, তাই ক্লাস থেকে বের হইনি।

কিন্তু মা, জানলে হয়তো তোমার মন খারাপ হবে যে, আমার খুব ইচ্ছে করছিল একছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কতদিন বাবা আদর করে না। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে না। জোর করে জাপটে ধরে গাল চেটে দেয় না। আমার খুব ইচ্ছে করছিল যে, বাবা আমাকে জাপটে ধরুক। গাল চেটে দিক। তুমিই তো বলেছিলে, চোখের দিকে তাকিয়েও বাবা যাদু করতে পারে। তাই বাবা যাতে আমার চোখে চোখ রাখতে না পারে সে জন্য ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চকলেটের প্যাকেটটাও ধরতে এগিয়ে যাইনি।

ক্লাস টিচার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছেলেটা আপনার কে হয়? তারপর আমার দিকে ফিরে বলেছিলেন, ভদ্রলোক তোমার কী হয়, তাকে চেনো তুমি?

তখনই ভয় পেয়ে আমি তাকিয়েছিলাম বাবার মুখের দিকে। আগের মতো একটা দুষ্টু দুষ্টু হাসি ফুটে ছিল বাবার ঠোঁটে। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম, বাবা যদি সত্যিটা বলে দেয়? আমাকে টিচারের কাছে ধরিয়ে দেয়? তখন কি স্কুলে আমার মুখ থাকবে? সত্যিটা যখন সবাই জেনে যাবে তখন তো আমি মিথ্যুক হয়ে যাবো। টিচাররা, বন্ধুরা, ওপরের ক্লাসের ভাইয়া আর আপুরা আমাকে চিট বলবে। আমার স্কুলে আসাটাও বন্ধ হয়ে যাবে লজ্জার কারণে। তখন তোমার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল আমার। কেন যে শুধু শুধু মিথ্যে কথাটা বলালে আমাকে দিয়ে! তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, বাবা, সত্যিটা টিচারকে বলবে না তুমি! চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার কথাটা আমার জন্য কত বড় যে এক সত্যি তা কেবল আমিই জানি।

বাবা কিন্তু আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিল। টিচারের সামনে, ক্লাসমেটদের সামনে ছোট করেনি। যদিও বিপদের কারণটা ছিলে তুমি। টিচার বাবাকে বলিছিলেন, আপনার পরিচয়টা তো দিলেন না। ছেলেটার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক তা-ও জানি না। বাবা টিচারের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিল, আমি এগুলো দিয়ে যেতে এসেছি। বেয়ারার। তারপর টিচারের হাতে চকলেটের প্যাকেটটা দিয়ে বাবা চলে গিয়েছিল। আর এ নিয়ে যে আরও কত বড় বিপদে পড়েছিলাম তা তো তুমি জানো না।

বাবা চলে যাওয়ার পর টিচার আমাকে বলেছিলেন, সত্যি করে বলো, লোকটা কে? নয়তো চকলেট একটাও দেবো না। আমি তখন বাধ্য হয়ে বলেছিলাম, চিনি না। আগে কোনোদিন দেখিনি। এবার বুঝতে পারছ তো, কতগুলো মিথ্যে আমাকে বলতে হলো? ভবিষ্যতে যে আরও কত মিথ্যে বলতে হবে আল্লা ছাড়া আর কেউ জানে না।

সেদিনের পরও অনেকদিন দেখেছি যে, স্কুলের গেটে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। কোনোদিন বাজারের কোনও চায়ের স্টলে বা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করতাম। ডাক দিনে শুনতে পাইনি এমন একটা ভাব দেখিয়ে সরে যেতাম। তার মাস কয়েক পর তোমাদের কারও কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, বাবা আবার দেশের বাইরে চলে গেছে, সেখান থেকেও আমাকে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল। কিন্তু কোনও বারই রিপ্লাই করিনি। আমি এসব করেছি শুধু তোমার জন্য। তোমাকে খুশি করতে। ভালোবেসে।

হায়, তারপরও কি তোমার মন পেলাম? সেই তো আমাকে ছেড়েই গেলে। নতুন করে আবার সংসার পাতলে। যদি ছেড়েই যাবে তোমার মনে ছিল, তাহলে আরও আগেই যেতে। আমার কাঁচা মনের ক্ষত এতদিনে শুকিয়ে যেতো। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়া কোনও শিশুর মনের আঘাত নিশ্চয় ক্লাস নাইনে পড়া কোনও কিশোরের চেয়ে কম হবে। সে সঙ্গে সেই কিশোরের কষ্টের ক্ষত সারতে নিশ্চয় আরও বেশি সময় লাগবে? কথায় বলে না যে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস? আমার মনও অনেকটা পেকে গেছে। হয়তো এ আঘাত আমৃত্যু আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে।

বাবা যখন আমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেছিল, তখন কৌশল করে আমাকে আটকে রাখলে। আমাকে ভয়ডর না দেখিয়ে তোমার বা আমার চোখের পানি উপেক্ষা করেও যদি বুঝিয়ে শুনিয়ে বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতে, তাহলে হয়তো বাবার পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতাম এতদিনে। বাবার স্ত্রীও হয়তো এতদিনে আমাকে মায়ায় জড়িয়ে নিতে পারতো। তখন তো খুব বলতে যে, আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আমাকে ছাড়া তোমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে। কিন্তু মা, আমি জানি না এখন কীভাবে দিন কাটছে তোমার যেখানে আমি নেই। এমন কী আছে তোমার অন্ধকার পৃথিবীতে যেখানে তুমি স্বাভাবিক রয়েছ? আসলে পরনির্ভরশীল মানুষের গন্তব্য বা আশ্রয়ের কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। সে কারণে কোনও রকম মায়ায় তাদের জড়ানো উচিত নয়। তবু তোমার কথা মতোই কাগজে কলমে বাবাকে মেরে ফেলেছি আগেই। এখন তুমিও আমাকে ছেড়ে গেলে। ফলটা কী হলো? না হতে পারলাম বাবার না রইলাম মায়ের।

সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি যে, মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত। কিন্তু এখন এ কথাও জেনেছি যে, পিতাহি পরম, পিতাহি ধরম, পিতাহি তপঃ। কথাগুলো যে চমৎকার তা তুমিও স্বীকার করবে। তবে তুমি যে তোমার জেদ বজায় রাখতে আমাকে পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত, সন্তান ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট তপস্যা ভঙ্গ করে দিয়ে গেলে এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করবো না। কোনও ভাবে দায়ীও করবো না। কারণ তুমি যে আমার মা। গর্ভধারিণী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, দিনরাত কষ্ট সয়ে দশমাস না দেখে না চিনেই এতটা ভালো বেসে আগলে রেখেছিল, সেই মা নতুন করে জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্যই কোনো ভুল করেনি। উপযুক্ত সময়েই সিদ্ধান্তটা নিয়েছ। আমি এখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ফোর ফাইভে পড়ুয়া সেই ভীতু আর নির্বোধ ছেলেটির চেয়ে নাইনে পড়ুয়া ছেলেটির বোধ বিবেচনা আর সাহসও নিশ্চয় বেশি? যে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বা প্রবোধ দেওয়ার যোগ্যতাও রাখে অনেক!

সুখি হতে চেষ্টা কোরো। সন্তুষ্ট থাকতেও চেষ্টা কোরো। বাবার সংসারে যে ভুলগুলো করেছিলে, নতুন সংসারে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করবে না আশা করি। তা ছাড়া একই ভুল দ্বিতীয় বার করবেই বা কেন? আমার এ ছোট্ট জীবনেই বুঝে গেছি যে, জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিটাই সব কিছু নয়। যদি সময় পাও তাহলে অল্পস্বল্প দোয়া আমার জন্য কোরো। যেন, দুঃখগুলোকে অতিক্রম করতে পারি। তোমাকে যেন কোনো অবস্থাতেই ভুল না বুঝি__ না অতীতের কোনো কর্মে, না বর্তমানে। ইতি। পিতৃ-মাতৃহীন একজন।


২৫জানুয়ারি, ২০১৫



সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৬
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×