(এটি আমার ছোটবেলার হোস্টেল জীবনের অভিজ্ঞতা। একসময়কার হেফযখানার লম্বা জামা পরুয়া রোগা পাতলা একটা ছেলে আজ আমি চিকিৎসাবিদ্যা পড়ি। দুটি জীবনই বন্দি, তবে অনেক ফারাক। মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। তবে আজকের এই লেখা সুখস্মৃতি নয়।)
২০০৩ সালে অষ্টমে পড়তাম। জুনিয়র একজন রুমমেট ছিল।। তিনি তখন সপ্তমে। ভদ্রলোক একটু ধনী ছিলেন, সিটিসেলের একটা ফোনও ব্যবহার করতেন। ধনী হবার সুবাদে তিনি বেশ ভাবে থাকতেন সবসময়। পড়াশুনা বেশি না করলেও ভদ্রলোকের ধনী বাবা তাকে অনেক বই কিনে দিয়েছিলেন। তার ইংরেজি টু বাংলা একটা অভিধান ছিল। আমার কোন অভিধান ছিল না। বাংলা একাডেমীর একটা অভিধানের দাম ছিল তখন প্রায় ১০০ টাকা। ১০০ টাকা তখন আমার কাছে অনেক। আগামী মাসের শুরুতে কিনবো, আগামী মাসের শুরুতে কিনবো ভাবতাম প্রতি মাসে। সে বছর সবে আমি গ্রামের মাদরাসা থেকে ঢাকায় গিয়েছি। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ইংরেজি একটু কম পারে এটি সর্বজনবিদিত। আমার অবস্থাও ব্যতিক্রম ছিল না। আমি নিজের অবস্থার একটু উন্নতি করতে চাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে ভদ্রলোকের অভিধানটা আমি ব্যবহার করতাম। পাশাপাশি সিট। ভদ্রলোক রুমে থাকলে বলে নিতাম। না থাকলে টেবিলের ঠিক যেখান থেকে অভিধানটা নিতাম সুন্দর যত্ন করে সেখানে গুছিয়ে রাখতাম। কোনোদিন আমার মনে হয় নি যে আমার রুমমেট আমার একটা বই নিয়ে পড়বে আর এটি বিরক্ত হবার মত কোন বিষয়। হথাত একদিন ভদ্রলোকের কাছে অভিধানটা চাইতেই তিনি বেশ উচ্চস্বরেই আমাকে বললেন, আমি ফকির কিনা, আমি কেন একটা অভিধান কিনতে পারি না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি খাম্বিত হয়ে গেলাম। ঠিক করলাম অভিধান আমাকে কিনতেই হবে। আম্মু বাড়ি থেকে প্রথমবার ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরুবার সময় আব্বুর অজান্তে হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন। নিজের নাশতার কিছু টাকা বাঁচিয়ে, আরেক বন্ধুর কাছে কিছু ধার করে আর সেই ২০০ টাকা মিলিয়ে পরবর্তী বছরের শুরুর দিন বাংলা, ইংরেজি, আরবি মিলে মোট ৮ টা অভিধান কিনলাম প্রায় ১২০০ টাকা দিয়ে। ভদ্রলোকের কোন আরবি অভিধান ছিল না। তিনি ভালো আরবি জানতেনও না। পরবর্তীতে যতদিন ঐ রুমে ছিলাম আমার আরবি অভিধান আর আমার থেকে আরবির খুঁটিনাটি জানাটা তার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল। ভদ্রলোক আমাকে যখন অভিধান বা শব্দার্থ বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতেন আমি এক পাশবিক আনন্দ পেতাম। অভিধান ব্যবহারের নিয়মটাও ভদ্রলোক পরবর্তীতে আমার কাছে শিখেছিলেন। তাকে যখন আমি কোন কিছু শিখাতাম তখন আমার মনে হত আমি সেই দিনের সেই কথার প্রতিশোধ নিচ্ছি...
আজ অনেকদিন পর বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান খুললাম। প্রথম পাতায় বড় করে লেখা, ০১ জানুয়ারি ২০০৪। আমার নিন্দুকগণকে আমি দারুণ পছন্দ করি। নানান সময়ে তাঁরা আমার এতো উপকার করেছেন যা আমার কাছের কোন বন্ধু কখনো করতে পারতো বলে মনে হয় না।