১ম পর্ব
সুমনের পাগলামী দিন দিন বাড়তে লাগল । ডাক্তারী, কবিরাজী সব ধরনের চিকিৎসা চলছে, কিন্তু কোন উন্নতির লক্ষণ নাই । কিছুদিন পর দেখা গেল সে ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে বিক্রি করা আরম্ভ করছে । প্রথমে বিষয়টা গোপন ছিল । একদিন তার বোনের স্বর্ণ বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে । খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সে তার পরিবারের অনেক মূল্যবান জিনিসই ইতিমধ্যে বিক্রি করে ফেলছে । বড়ভাই তাকে ধরে আচ্ছা মত ধোলাই দিলেন । সুমন স্বীকার করল সে নেশা করে । সে এও বলল- যে রাত্রে রেজান মারা যায় সেই রাত্রে দু'জনে প্রচুর মদ পান করেছিল । খুব সম্ভবত অত্যধিক মদ্য পান জনিত কারনে রেজানের মৃত্যু হয় । আমাদের এলাকাটা চা বাগানের পাশাপাশি হওয়ায় চোলাই মদ (বাংলা মদ) সহজলভ্য । সুমনকে “ভোর” (মাদক নিরাময় কেন্দ্র) এ ভর্তি করা হলো । ছয়মাস পর “ভোর” থেকে ছাড়া পেল । মাস খানেক সুস্থু ছিল ।
তারপর শুরু হল নতুন উৎপাত। সন্ধ্যার পর রাস্তায় মানুষকে রেজান সেজে ভয় দেখিয়ে চিনতাই। লোকজনের মধ্যে ভূতের ভয় ঢুকে গেল, রেজানকে ভূতে মেরেছে এই ধারনা বাস্তবে রুপ নিল । কিছু দিনের মধ্যেই লোকজন সন্ধ্যার পর একা যাওয়া আসা বন্ধ করে দিল, সবাই দলবদ্ধ হয়ে যাওয়া আসা করত, এতে সুমনের রেজান সেজে চিনতাই বন্ধ হয়ে গেল । সপ্তাহ খানেক পর খবর পেলাম সে একজন ফেরিওয়ালাকে চাকু মেরেছে টাকার জন্য । এই দিনের পর সে আর বাড়ীতে আসতনা । দিন দিন তার দাপট বাড়তে লাগল । সে দুজন পার্টনারও যোগাড় করল । এলাকার দু' একজন দুষ্টু লোক সুযোগ নিল। তারা সুমনকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে কয়েকটা ঘটনা ঘটাল । তিন/চারজনকে চুরি মারল, কয়েকজনকে মারপিট করল, মাথা ফাটাল, আরো কিছু চুরি/ডাকাতির ঘটনা । এলাকায় মোটামুটি ত্রাসের সৃষ্টি হলো । সুমনকে সবাই এক নামে ভয় পেত । সে দোকানে গিয়ে কোন জিনিস নিয়ে টাকা দিতনা । ইতিমধ্যে সে হেরোইন থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে । এলাকাবাসী থানায় অভিযোগ করল । কিন্তু পুলিশ আসার আগেই কিভাবে যেন সে খবর পেয়ে যেত। বছর খানেক পর চাচা (সুমনের বাবা) এবং বড় ভাই আরো লোকজনের সহযোগীতায় তাকে আটক করলেন । তাকে আটক করা সহজ ব্যাপার ছিলনা কারন ইতিমধ্যে সে একটা আগ্নেয়াস্ত্র যোগাড় করেছে । চাচা স্ব-উদ্যোগে তাকে আগ্নেয়াস্ত্র মামলায় পুলিশে সোপর্দ করলেন । প্রায় দু'বছর পর তাকে একদিন বাজারে দেখা গেল । কে বা কাহারা তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনল আজ পর্যন্ত তার হদিস মেলেনি । সুমনের ত্রাস আবার শুরু হল, সবাই ভয়ের মধ্যে আছে কোন দিন কাকে ধরে।
সুমন তার মা'কে খুব ভালোবাসতো। প্রায় তিন মাস পর চাচী (সুমনের আম্মা) মূমুর্ষ অবস্থার ভান করে সুমনকে বাড়ীতে ডাকলেন এবং রাজী করালেন সে চুরি ডাকাতি ছেড়ে দিবে বিনিময়ে চাচী তাকে প্রতিমাসে ১০,০০০ টাকা দিবেন নেশা করার জন্য । এভাবে চাচী উনার সব স্বর্ণ বিক্রি করলেন নিজের নামের জায়গা বিক্রি করলেন ।
কিছুদিন যেতেই আবার শুরু হল নতুন উৎপাত। সুমনদের বাড়ীর ৫০০ গজের মধ্যে ছিল শশ্মানঘাট । চাচী একদিন রাত্রে দেখলেন সুমনের রুমের দরজা খোলা এবং সে ঘরে নেই । সবাই খোঁজাখুজি করে সুমনকে শশ্মানঘাটে আবিস্কার করলেন । তার মুখ থেকে যা শুনা গেল তা শুনে সবাই হতবাক ! সে গত ১০/১৫ দিন ধরে প্রতিদিন রাত্র ১ ঘটিকার পর শশ্মানঘাটে ছাতা মাথায় দিয়ে বসে থাকে রেজানের সাথে দেখা করার জন্য। রেজান বলছে শশ্মানঘাটে তার সাথে দেখা করবে ।
ডাক্তারের পরামর্শে তাকে পাবনা ভর্তি করা হলো । সেখানে দুই বছর থাকল । এবার তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শুরু করল। কারো সাথে কোন কথা বলেনা ।
কিছু দিনের মধ্যে সুমন আবার পাগল হয়ে গেল। চুরি ডাকাতি অবশ্য আগেই ছেড়ে দিছে । সুমনকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে করতে একদিন হার্ট এট্যাক করে চাচা মারা গেলেন, তার ৯ মাস পর চাচীও মারা গেলেন । সুমন সারা দিন ঘুমায় আর রাত্রে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে বসে কান্না করে । একদিন বড় ভাইয়ের সাথে গেলাম তাকে কবরস্থান থেকে আনতে । সে কিছুতেই আসবে না । তার একটাই কথা আমার জন্য বাবা-মা মারা গেছেনে। আমি এখন তাদের সেবা যত্ন করব। জোর করে নিয়ে এলাম। আবার পাঠানো হলো মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে । সেখানে থাকল ১ বছর।
আমি ট্রান্সফার হয়ে এলাকায় চলে আসলাম। একদিন গাড়ীতে উঠতে যাব এমন সময় পিছন থেকে কে সালাম দিল। চেয়ে দেখি সুমন। হাড্ডিসার শরীর । কথা বলতে পারছেনা, ঠোঁট কাপছে, শরীর কাপছে। যে সুমনক সবাই ভয় পেত তাকে এখন ধাক্কা দিলে পড়ে যাবে এই অবস্থা । বললাম- কিরে তোর কি হয়েছে, তোর এ অবস্থা কেন? বলল- বড়ভাই বাড়ী থেকে বের করে দিছেন, গত তিনদিন ধরে কিচ্ছু খাইনি। আমাকে ২০ টাকা দিন। আমি বললাম ২০ টাকা দিয়ে কি করবি ? ১০০ টাকার একটা নোট দিলাম। সে বলল – এক মিনিট দাঁড়ান । দৌড়ে দোকানে গেল। একটু পর ফিরে আসল। হাতে একটা ডেনিস কনডেন্সড মিল্ক এর কৌটা । বাকী টাকা ফেরত দিয়ে বলল- তুমি অফিসে চলে যাও।
বড় ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন এখন সে আর ভাত খায়না, শুধু তরকারীল ঝুল আর ডেনিস কনডেন্সড মিল্ক খায় । কোন অবস্থায়ই তাকে ঘরে আটকে রাখা যায়না । ঘুমের ঔষধ এখন আর কাজ করেনা । বড়ভাই বাড়ী থেকে বের করে দিছেন বলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে রাস্তায় রাস্তায় টাকার জন্য ভিক্ষা করে । তার ভিক্ষাবৃত্তি দিন দিন বাড়তে লাগল। যখন তখন লোকজনকে বিরক্ত করা শুরু করল। বড়ভাই তাকে ধরে একটা রুমে তালা দিয়ে বন্দী করে রেখেছেন অনেক দিন । কিন্তু কিভাবে যে সে ছাড়া পায় বুঝতে পারেন না । শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে লোহার রড দিয়ে প্রিজন সেলের মত ছোট্র একটা রুম বানিয়েছেন কয়েদীদের মত করে । আর হাতে শিখল দিয়ে বেঁধে রাখেন।
আমাদের এলাকায় সবচেয়ে সুন্দর একটা পরিবার ছিল সুমনদের। তারা দুই ভাই দুই বোন। বোন দু'জনই বিবাহিত। এক বোন লন্ডন অন্যজন স্যুইজারল্যান্ড । বড় ভাইয়ের বয়স প্রায় চল্লিশ। সুমনকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে আজ পর্যন্ত বিয়ে করতে পারেননি । চাচা-চাচী দু'জনই মারা গেছেন হার্ট এট্যাকে সুমনকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার কারনে।
শুধুমাত্র একজন সদস্য নেশাগ্রস্থ হওয়ার কারনে একটা পরিবার, একটা সমাজ কিভাবে ভোক্তভোগী হয় তার বাস্তব উদাহরন সুমন। সুমনের অত্যাচারের কারনে তার পরিবারকে সইতে হয়েছে অনেক অশান্তি, লাঞ্চনা আর অপমান। শুনতে হয়েছে অনেক গালি । কিভাবে ধ্বংশ হতে পারে একটি সাজানো পরিবার তার বাস্তব উদাহরন সুমনদের পরিবার।
আসুন আমরা নেশামুক্ত পরিবার, সমাজ, দেশ গড়ি। নিজে সুখে থাকি, অন্যকে সুখি হতে সাহায্য করি।
একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে ।