বাংলাদেশের সংবিধানের ১১অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবতার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। অনেকে মনে করেন নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় শুধুমাত্র ভোটাভুটির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয়নি। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ভিত তৈরী হয়েছে জনগণের কতগুলো মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং আইনের শাসনের মাধ্যমে । ভোট প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হলেও মানুষের মৌলিক অধিকার সমূহ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। মৌলিক অধিকার যেমন চিন্তা, বিবেক, বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সংগঠন ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা, পেশা বৃত্তির স্বাধীনতা, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার যা হরণ করা যায় না। এগুলো মানুষের জন্মগত অধিকার যা আইন দিয়ে রহিত করা যায় না।
আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ না থাকলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অবাধ সুষ্টু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা ঘটলেও যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হতে পারে না। অন্যদিকে সংবাদপত্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অর্থ সবকিছু রিপোর্টিং করার স্বাধীনতা নয়, জনস্বার্থের বিষয়গুলো তুলে ধরাই মূলত স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের আড়ালে কিছু সংবাদপত্রের মালিকরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে কোন কোন সময় যা পরিবেশন করেন তাকেও যথার্থ অর্থে নিরপেক্ষ স্বাধীনতা বলা যায় না। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হতে পারে। অবাধ তথ্য প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রের স্বার্থেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব নয়। একটি সুষ্টু গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম অপরিহার্য। গণমাধ্যম বা সংবাদপত্র যে কোন বিষয়ের উপর জনমত সংগঠনের ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করতে পারে অত্যন্ত সফলভাবে। অপরাধ প্রতিরোধ ও গণমাধ্যমের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। যে কোন ঘটে যাওয়া অপরাধ সম্পর্কে ভীতি তৈরী করতে গণমাধ্যমের রয়েছে অনেক শক্তি। পাশাপাশি অপরাধ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের একটি উক্তি হলো- The all security of all is in free press. অর্থাৎ সকলের সকল নিরাপত্তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মধ্যে নিহিত।
যে সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিদ্যমান এবং গণমাধ্যম মুক্ত ও স্বাধীন সে সমাজই আলোকিত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আইনের শাসন,গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এ বিষয়গুলো একটি অপরটির পরিপূরক। গণতন্ত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবেও স্বীকৃত। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জন শৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। তবে এ কথাও সত্য কোন স্বাধীনতা বা অধিকারই আইনের ঊর্দ্ধে নয়। বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের আরও বিকাশ ঘটুক, দেশ ও জাতি আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করুক- এটাই প্রত্যাশা ।