আমি শাবিপ্রবি'র একজন ছাত্র। আমাদের থেকে ২৫০কিলোমিটার দূরে কিছু মানুষ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। তারা হয়তো আমাদের রক্তের সম্পর্কের কেউ না, তাদের কাউকেই আমরা হয়তো ব্যাক্তিগতভাবে চিনি না। রাস্তায় তাদের হেঁটে যেতে দেখলে নাক সিটকাই তাদের ময়লা কাপড়-চোপড়ের গন্ধে। এমনকি অনেকেই নিজেদের বান্ধবীদের খেপাতে অহরহ 'গার্মেন্টসের মেয়ে' বলে খোঁটা দেই। আমরা ভাল ফ্যামিলি থেকে আসা ভার্সিটিতে পড়া উচ্চশিক্ষিত বিবেকবান নাগরিক, আর তারা কোথাকার মঙ্গাপীড়িত এলাকার চাষা-ভুষার অশিক্ষিত,খ্যাত, মূর্খ ছেলেমেয়ে। তাদের এত দাম দেওয়ার কি আছে?
কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি আমার বাবা-মায়ের পরেই এই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ। আমাদের বাবা-মা আমাদের জন্ম দিয়েছেন, স্কুল-কলেজ পর্যন্ত এমনকি ভার্সিটিতেও আমাদের খরচ দিচ্ছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার আমরা অনেকেই ভুলে যাই। আমরা যারা আজকে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে নামেমাত্র টিউশন ফী দিয়ে পড়ে অথবা মেধার জোরে সরকারী বৃত্তি বাগিয়ে আর ঢাকার বঙ্গ-মার্কেট থেকে সস্তায় কেনা জিন্স-টিশার্ট পড়ে স্মার্ট হয়ে গর্বে রাস্তায় বুক ফুলিয়ে হাঁটি, তাদের এই 'নামেমাত্র টিউশন ফী' কিংবা 'বৃত্তি'র টাকাটা কোথা থেকে আসে তা কয়জন ভেবে দেখেছি? সরাসরি বললে উত্তর আসবে ইউজিসি'র ফান্ড থেকে। কিন্তু ইউজিসি'র ফান্ডের টাকাটা কোথা থেকে আসে? সে টাকাটা আসে আমাদের কৃষকশ্রেণীর নিষ্ঠা, প্রবাসী ভাইদের পাঠানো রেমিটেন্স আর এই অশিক্ষিত, খ্যাত, মূর্খ গার্মেন্টসকর্মীদের জীবনবাজি রেখে রক্ত পানি করা ঘামের বিনিময়ে। তাদের পয়সায় আমরা ফুটানি মেরে তাদেরই খ্যাত/আনস্মার্ট বলে অবজ্ঞা করি। কিন্তু না, তারা আমাদের বড়ভাই কিংবা বোনের মর্যাদা পাওয়ার দাবী রাখে। আমাদের এই দেশটা কিন্তু আমাদের আশেপাশে দেখা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মতই। যে টানাপোড়েনের সংসারে ছোটভাইদের মুখে দু'বেলা ভাত তুলে দেওয়ার জন্য, তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বড় ভাই অথবা বোনটি সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে পড়াশোনা ছেড়ে সব সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাংক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে হাসিমুখে। নিজেকে একবার সেই নিম্নবিত্ত পরিবারের ছোটভাইটির জায়গায় কল্পনা করে দেখুন। আজ যদি আপনার এই নিঃস্বার্থ খেটে-খাওয়া বড়ভাইটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তো কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করত, আপনি কি ঘরে বসে থাকতে পারতেন? কিংবা বড়ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যায়ভার বহনের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের আসন্ন সেমিস্টার ফাইনালের পড়াশোনায় ডুবে যেতে পারতেন?
আমার এতগুলো বড় ভাই-বোনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দেন নাই। এটাও জানি যে এখন থেকে এক সপ্তাহ পরে স্পেকট্রাম-তাজরীনের ভিক্টিমদের মত রানা-প্লাজার ভিক্টিমদেরও সবাই ভুলে যাবে। তাদের চিকিৎসা চলছে না তারা টাকার অভাবে অপারেশন করাতে না পেরে মরে গেছে সে খবরটুকু রাখার সময়ও আমরা পাব না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের কয়েকজনের একটা লক্ষ্য আছে। সেই লক্ষ্য অর্জন আমার পক্ষে সম্ভব কিনা তা-ও আমি জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি আমাদের জীবনের সেরা ডেডিকেশনটুকু আমরা প্রয়োগ করব এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আপনিও যদি আমাদের মত চিন্তা করেন, অনুরোধ করবো আর ঘরে বসে না থাকতে। আপনার আশেপাশে কাউকে না পেলে প্রয়োজনে একলাই নেমে পড়ুন টাকা সংগ্রহে, আপনাকে দেখে আরো ১০জন এগিয়ে আসবে হলফ করে বলছি। আমাদের ভাই-বোনগুলোকে এভাবে বিপদের মাঝে ফেলে যাবেন না।