বেশ অনেকদিন পর ট্রেনে উঠলাম। গন্তব্য সম্পূর্ণ অচেনা অজানা শহর নরসিংদী। আগে কখনোই যাওয়া হয় নি। ভেতরে এক অন্যরকম চাঞ্চল্য কাজ করছিল। ট্রেনের জানালা দিয়ে প্লাটফরমের ভীড় দেখছি আর দেখছি ফেরিওয়ালাদের ব্যস্ত ছোটাছুটি। হঠাৎই বখাটে ছেলের ধরণে বিকট শিষ্ দিয়ে নড়ে ওঠে ট্রেন। প্রথমে কিছুটা দুলকি চালে চলে পরে ছুটতে থাকে তেজী ঘোড়ার মত। রাতের অন্ধকারে পিছিয়ে যেতে থাকে আমার বহুকালের চেনা পরিচিত শহর।
কেমন এক অদ্ভুত অনুভুতি তখন হৃদয় জুড়ে। মনে হয় চেনা জানা আপন জায়গা ছেড়ে কুয়াশায় ভেসে ভেসে মায়াবী ট্রেন ছুটে চলছে কল্পনার ধূসর জগতে। জানালা দিয়ে চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় পেরিয়ে যায় নাম না জানা কত নদী। নরম জ্যোস্নায় সে নদীর কালচে জল চিকচিক করে উঠে। সেই দৃশ্যে মাথার ভিতর ঘাই দেয় সুদূর অতীতের অস্পষ্ট কোন স্মৃতি। কী যেন... কবে যেন... আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে চেয়ে থাকি অন্যমনে। ট্রেনের একটানা ছন্দময় ঝিকঝিক শব্দে হঠাৎই রোমহর্ষের মতো মনে পড়ে যায় সেই কবেকার কোন ছোট বেলার কথা। ছোট্ট আমি মায়ের পাশে বসে ট্রেনের জানালা দিয়ে বিস্ময় ভরা চোখে দেখছি এমনি কোন ভয়ঙ্কর সুন্দর বিমুগ্ধ শীতের রাত!
মনে পড়ে যায় মামা বাড়ী, দুরন্ত ডিসেম্বর মাস। মুখ গুঁজে বার্ষীক পরীক্ষা দিতাম কিন্তু মন পড়ে থাকতো মামা বাড়ীতে। দিন গুনতাম পরীক্ষা কোনদিন শেষ হবে আর আমরা চেপে বসব মেঘনায়। ছোটবেলায় সেই মেঘনা ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দে হারিয়ে যেতাম মামার বিশাল পুকুরে, উঠোন জুড়ে সব কাজিনদের ক্রিকেট খেলা, মামানির আমসত্ত্ব চুরি আরও কত শত ঘটনায়।
আর ঐ একটা মাস ছিল আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা। ভুলু'র মার বড়ই গাছে দিনরাত ঢিল মারা, ওর জাতি আম গাছ ফাঁকা করে দেওয়া, হোসেন মামার ক্ষিরা ক্ষেত ভর দুপুরে সাফা খিরখিরা করে দেওয়া, হিন্দু বাড়ীর পেয়ারা, চালতা, কামরাঙা, লেবু চুরি কি করিনি! আর আমাদের এই সমস্ত অপকর্মের উৎসাহদাতা আমাদের বড়মামা। উনি উনার ছোটবেলার অপকর্মের গল্প বলে আমাদের নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে যেতেন। প্রতিদিন মামার মস্ত উঠোনে সকাল বিকাল ক্রিকেট খেলা আর সেই খেলায় মামা আর মামার একমাত্র ছেলে আমাদের কাজিন নিপুর ঝগড়াটা ছিল এক নিয়মিত ঘটনা। মামাকে আউট করা খুব কঠিন ছিল। আউট হলেই বলত, আমি রেডি ছিলাম না। সব ষড়যন্ত্র।

একবার মামা ছক্কা মারতে গিয়ে বাড়ীর সামনের দিককার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলল। আমরা সব কাজিনেরা তো ভয়েই অস্থির। কোথায় পালাব সেই পথ খুজঁছি। মামানি হুন্কার ছাড়তে ছাড়তে এসে দেখলেন মামা ব্যাট হাতে দাড়িঁয়ে আছে। মামা কোনরকমে কাষ্ঠ হাসি হাসতে হাসতে বললেন, আমি যে এত ভাল ব্যাট করি জানা ছিল না। চার মারতে গিয়ে ছয় হয়ে গেল।

আমরা সব কাজিনেরা তখন হক মামার দোকানের সামনে হাজির হয়েছি। কিছুক্ষণ পর দেখি মামা ধুঁকতে ধুঁকতে এদিকেই আসছেন। আমরা উৎকন্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করি, মামা মামানি কিছু বলল! মামা হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে বলল, আরে না! কি বলবে আবার। দেখিয়ে দিলাম না কপিল দেব কাকে বলে।


লাঠি বিস্কিট চায়ে ডুবিয়ে খেতে খেতে ভাবছি কি করা যায়। একজন বলল, মামা গোসল দিব। যেই ক্থা সেই কাজ। চা বিস্কিট শেষ করেই সবাই লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লাম দোকানের পাশেই বিরাট পুকুরে। মামার পুকুরে যাওয়ার উপায় নেই। মামানি আজ দেখতে পেলেই ছ্যাঁচবে। গোসল শেষে সবাই চোরের মতো ঘরে ফিরলাম। মামানি চুপচাপ। পরিস্হিতি সুবিধার না। আমরা চুপচাপ দুপুরের খাবার খেয়ে যাচ্ছি। অন্য সময় হলে মামা মামানিকে রাগানোর জন্য সুর করে বলতো, মামা ভাগিনা যেখানে... আমরা সাথে সাথে সুর মেলাতাম, বিপদ নাই সেখানে। মামা আবার বলতো আমার ভাগিনারা সব কার দলে? আমরা বলতাম, মামার দলে। কিন্তু আজ মামা সেসব কিছুই বলল না।
খাওয়া শেষ হতেই মামানি দুষ্টামির হাসি হেসে বলল, আজ যেহেতু খেলা বন্ধ তাইলে আমরা এখন সবাই কি করব? আমরা কাজিনরা সবাই যেন মেঘলাদিনে একটু সূর্যের উঁকিঝুঁকি দেখতে পেলাম।



হঠাৎই সবাই মামানির পক্ষ নেয়াতে মামা তো রেগে কাই। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, তোদের যদি আর বাবুরহাট বাজারে নিয়ে মিষ্টি খাওয়াই। তোরা কেউ আমার ভাগিনা না। তোরা তোদের মামানিরে নিয়া থাক। আমি আর তোদের সাথে নাই।
আমাদের তখন মিষ্টি চমচমের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। মামানির গল্পের কাছে সব পানসা। আমাদের সবার তখন একই আবদার, মামানি চোরের গল্প বল। চোরের গল্প শুনব। মামানি শুরু করল তাঁর বিখ্যাত চোরের গল্প। সেই গল্প শুনে আমরা কখনো হেসে উঠছি। কখনো অভাগা চোরটার জন্য আমাদের বুকের ভিতরটা টনটন করে উঠছে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে একটা কষ্ট। আমি শক্ত করে মামানিকে জড়িয়ে ধরে থাকি। দুঃখী চোরটার জন্য আমার চোখের কোন একটা অজানা কষ্টে ভিজে উঠে...
হঠৎই ট্রেনের বিকট হুইসালে আমি সুদুর অতীতের গল্পের জগত ছেড়ে বাস্তবে ফিরে আসি। কখন আমার মামাবাড়ীকে বহুদূর পিছনে ফেলে চলে এসেছি সম্পূর্ণ নতুন এক শহরে। নরসিংদী! যেখানে আমি কখনো আসিনি। কিন্তু জানি এই শহরের আনাচে কানাচে এমনি করেই ছড়িয়ে আছে কত মামা কাহিনী! আমি ব্যাগ কাঁধে ফেলে নেমে গেলাম সেই অচেনা শহরের পথে।
মামা কাহিনী শুরু করেছিলাম ব্লগ জীবনের একেবারে প্রথম দিকে। এরপর বহুদিন আর কেন যেন লেখা হয় নি। ইচ্ছে ছিল কিন্তু হয়ে উঠে নি। আজ বহুদিন পর আবার মামা কাহিনী লিখলাম।
মামা কাহিনী! ১