তবুও কথাটার কোথাও যেন একটু প্রশ্নবোধক চিহ্নের আভাস মেলে। আর সেটুকু টোটাল ফুটবলের জনক 'ক্রুইফের' ঐ হ্যলান্ডের জন্যেই। বার্ট ফন মারউইকের মতো এক জুয়াড়ি কোচের হাত ধরে যে এবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে অরেন্জ্ঞ'রা। বয়সকে হার মানানো উইঙ্গার রোবেন আর মিডফিল্ডার স্নাইডার ইতিমধ্যেই নিজেদের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে আছে আর্সেনালের হয়ে দূর্দান্ত মৌসুম কাটানো আরেক স্ট্রাইকার পার্সি। আছে কেউট, বোমেল, রাফায়েল ফন ডার ফার্টের মতো প্রতিভাবান। তাই এমন দলের বিপক্ষে ব্রাজিলীয় সমর্থকদের কপালে চিন্তার ভাঁজের পাশাপাশি প্রশ্নবোধক চিহ্ন উঁকি দেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
টোটাল ফুটবলকে মাঠে ঘোল খাইয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেলে ব্রাজিলের সহজ সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ ফোরলানের উরুগুয়ে আর তারপরেই তো সেই স্বপ্নের ফাইনাল। (ঘানার কথা মাথায় রেখে) ব্রাজিলের সমর্থকরা ব্যাপাটা যতটা সহজ ভাবছেন ততটা সহজ নাও হতে পারে। ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, পৃথিবীর সেরা ফুটবলটা খেলে আর্জেনন্টিনা আর উরুগুয়ে। তা তিনি বলতেই পারেন। অনেক কথাই তো বলেন! ব্রাজিল সমর্থকরা তার কথার খুব একটা পাত্তা টাত্তা দেয় না। ম্যারাডোনাকে পাত্তা দিক বা না দিক ফোরলানকে যে তাদের পাত্তা দিতে দিতে হবে তা বোধ করি দুঙ্গাও ভালো বোঝেন। ফোরলান তার তারকাখ্যাতির পুরোটাই ছড়াচ্ছেন এবারের বিশ্বকাপে। সাথে আছেন 'গোল মেশিন' সুয়ারেজ। ২৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড ডাচ লীগে আমারষ্টাডামের হয়ে করেছেন ৩৫ গোল। পুরা মৌসুমে ৪৯ টি। মেসি, হিগুয়াইন, রোনালদো, রুনি'রা তার পেছনে। গোলবারের স্যুয়ারেজ লাইনটা যে তার ভাল করেই চেনা ! তেমনটা হলে কপাল পুড়তে পারে ব্রাজিল সমর্থকদের।
সকল হিসেব নিকেশের পরেও ব্রাজিলকে ফেবারিট মেনে নিয়ে যদি ফাইনালে ধরি, তবে তাদের সঙ্গ দিতে দেখা যাবে আর্জেনন্টিনা, জার্মানি অথবা স্পেনের মতো পরাশক্তিদের। তাই আসল পরীক্ষাটা হয়তো ফাইনালেই দিতে হবে ব্রাজিলকে।
পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লোকটাকে সবাই ফুটবল যাদুকর হিসেবেই চেনে। অনেকটা পাগলা স্বভাবের। বা'পায়ের যাদুতে যিনি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি। শতাব্দীর সেরা ফুটবলার পেলে না ম্যারাডোন তা নিয়ে বিতর্ক আছে থাকবে। তবে ম্যারাডোনা একজনই। পৃথিবীতে একবারই আসেন। খোদ ঈশ্বর যার শরীরে ভর করে নেমে এসেছিলেন খেলার মাঠে। সেই ম্যারাডোনাই এখন দলের দায়িত্বে। '৮৬ তে বুরুচাগা, ভালাদানো বাতিস্তাকে নিয়ে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ। পরের আসরে (৯০) ক্যানিজিয়া, চ্যামেটের সহযোগীতায় একক নৈপূন্যে দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনাল অবধি। ফাইনালের লোথার ম্যাথিউসের জার্মানির বিপক্ষে সেই পেনাল্টি ট্রাজেডি। প্রথমবারের মতো কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে দু'দুটো লাল কার্ডের শিকার আর্জেনন্টিনা। ম্যারাডোনাও দেখেছিলেন হলুদ কার্ড। বুঝতে কারো ভুল হওয়ার কথা নয় ফিফার ঘরের বারান্দায় যারা ঘুরঘুর করেন, তাদের সিন্ডিকেশনেই রেফারি কোর্ডেসাল মেন্দেজের এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। সেই বিতর্কিত পেনাল্টিতে একমাত্র গোলটি করে বিশ্বের সকল আর্জেনন্টাইন ভক্তকূলকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে জার্মানিকে তৃতীয় শিরোপা জেতান আন্দ্রে ব্রেমা। পরের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ড্রাগ কেলেঙ্কারী। গ্যালারিতে বসে নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন বিশ্ববাসীকে।
আবারো সেই জার্মানি। অধিনায়ক ফিলিপ লামের নেতৃত্বে অসাধারণ খেলতে থাকা পোডলস্কি, চতুর মিডফিল্ডার ওজিল ( আমার মতে এবারের সেরা নবাগত), শোয়েনস্টাইগার'রা বালাকের অভাবটা বুঝতেই দেন নি। আছে বিশ্বকাপ ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা বড় রোনাদোর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকা সুযোগসন্ধানি ক্লোসা। আর মাত্র তিনটি গোল বাকী। এবারের ক্লোসাকে দেখে মনে হচ্ছে আসার সময় তিনি বুঝি বলটিকে তাবিজ করে নিয়ে এসেছেন। দূর্দান্ত এই দলটির সাথে এবার কোয়ার্টার ফাইনালেই মুখোমুখি ম্যারাডোনার আর্জেনন্টিনা। হয়তো এই দিনটির জন্যেই এতদিন অপেক্ষায় ছিলেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার অনেক দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে দলটির নামের সাথে। জমে আছে অনেক দিনের দেনা পাওনার হিসেব। ২০ টা বছর! পারবেন তো ম্যারাডোনা সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে দিতে !?

জার্মান মেশিনকে থামিয়ে দিতে পারলেই সেমিফাইনালে আর্জেনন্টিনার আরেক কঠিন প্রতিপক্ষ ফেবারিট স্পেন। (প্যারাগুয়ের কথা মাথায় রেখেই) 'পেরেনিয়াল আন্ডারঅ্যাচিভারস' বলে যে স্টিকার স্পেনের গায়ে সাঁটা থাকতো তা অনেক আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তারা। আছে মধ্য মাঠের বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের সেরা দুই মিডফিল্ডার জাভি হার্নান্দেজ ও ইনিয়েস্তা। ক্লাব ফুটবলের টুকটাক খোঁজখবর যারা রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন আজকের লিওনাল মেসির 'মেসি' হয়ে উঠার পিছনে এ'দুজনের অবদান কতটুকু। অসম্ভব সূক্ষ্ম, ক্লোজ- কন্ট্রোল, ড্রিবল এবং গেম ভিশন দু'জনের। মাঝমাঠ দখল, ডিফেন্স চেরা পাস আর সময়ে গোল করার ক্ষমতা দুজনেরই সমানভাবে আছে। আছে তরেস আর ডেভিড ভিয়ার মতো ভয়ংকর স্ট্রাইকার। উইংয়ে আছে দুর্দান্ত সার্জিও র্যামোস। আর ফ্যাব্রেগাসের মতো মধ্যমাঠের 'মনি'কে যারা সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখার সাহস দেখায় তাদের ফেবারিট না মেনে উপায় কি!
তারপরও আর্জেন্টিনার সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধতে পারেন কারণ ঐ মেসি। দলের প্রাণ ভোমরা। সঙ্গে আছে তেভেজ, হিগুয়াইন, অ্যাগুয়েরো, মিলিতোর মতো ফরোয়ার্ড। মধ্যমাঠের দুই অভিজ্ঞ খেলোয়াড় রদ্রিগেজ ও মাসচেরানো। কড়া ডিফেন্সের পাশাপাশি লং পাসে মধ্যমাঠে বল যোগান দেয়া, উইং দিয়ে আক্রমনে উঠে আসা এক পরিশ্রমী খেলোয়াড় গ্রাব্রিয়েল হাইন্জ্ঞা। দলের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর আছেন ঐ পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির ঐ ক্ষেপাটে পাগলা মানুষটা। আর্জেনন্টিনার সমর্থকরা তাই আশায় বুক বাঁধতেই পারেন।
সকল বাধা অতিক্রম করে এ'দুটো দলই যদি ফাইনালে যেতে পারে তবেই তো বিশ্ববাসী দেখবে ফুটবলের আসল সৌন্দর্য। ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা ফাইনাল। সে হবে এক চিরস্মরনীয় ম্যাচ। সেই ম্যাচে যেই জিতুক আসল জয়টা কিন্তু হবে ফুটবলের। পৃথিবীর তাবৎ ফুটবল প্রমিকের।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১০ সকাল ৭:৪৫