বাংলাদেশের অধঃপতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী মুক্তিযোদ্ধারা, যুদ্ধকালীন সময়ে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তাদের আচরণ অনেকটা ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইডের মতো। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ তারা আমাকে একটি স্বাধীন ভুখন্ড দিয়েছে এবং একই সাথে আমি মর্মাহত তাদের পরবর্তী আচরণে, যা আমাদের দেশের সকল সম্ভবনাকেই অঙ্কুরে বিনষ্ট করেছে।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মকে সমর্থন করে নি, তারা এখানকার কনস্যুলেট অফিসের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে, তাদের কংগ্রেসে আলোচনাও হয়েছে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সহায়তা দেওয়া অনুচিত হবে কারণ সে অস্ত্র আদতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষদের হত্যার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সর্বাধিক বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভবত সবচেয়ে বেশী বৈদেশীক সাহায্য এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এবং এই পরিমাণ ত্রানসহায়তা এবং বৈদেশিক সহযোগিতা পাওয়া সত্ত্বেও এখানের মানুষের জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। তবে এই বিপূল পরিমাণ অর্থ সাহায্য পেয়েও সেটা বাংলাদেশের অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়নে লাগে নি, বাংলাদেশের কল কারখানাগুলোর উৎপাদন কমেছে, ৮৪ শতাংশ অবাঙ্গালীদের শিল্প কারখানা বস্তুত জাতীয়করণ করা হয়েছিলো, এবং দেশীয় শিল্পউদ্যোক্তাদের বাৎসরিক আয়ের সীমানাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিলো। ১৯৭৩ সালের দিকে ঘোষণা করা হয়েছিলো যেসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ৩ লক্ষ টাকার বেশী, তাদের জাতীয়করণ করা হবে। অর্থ্যাৎ বেসরকারী উদ্যোক্তাদের হাতেও যে সীমিত পরিমাণ শিল্প কারখানা ছিলো সেগুলোও বিকশিত হওয়ার সুযোগ সে সময়ে ছিলো না।
বাংলাদেশ সেসময়ে ইউরোপে চা রপ্তানীর চেষ্টা করেছিলো, তবে শ্রীলঙ্কার চায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলাতে পারে নি, সিলেটের চা বাগান ইজারা দিতে চেয়েছিলো ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে, তারাও সে কিনতে আগ্রহী ছিলো না। বরং বাংলাদেশ উৎপাদন মূল্যের এক তৃতীয়াংশ দামে উৎপাদিত চা বিক্রী করেছে। একই অবস্থা পাটের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক আয়ের ৮৫ শতাংশ তখন পাট রপ্তানীজাত ছিলো, সে সময়ে কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে যায় ৪০ শতাংশ।
মূলত সে সময়ে বাংলাদেশে দুই শ্রেণীর মানুষ বসবাস করতো। একদল ভারতফেরত মুক্তিযোদ্ধা, তারা দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক গণ্য হতো এবং অন্য সবাই হতভাগ্য মানুষ, যারা ভারতে শরনার্থি হিসেবে যেতে পারে নি, যারা এখানেই অভুক্ত অবস্থায় কিংবা অনাহারে কাটিয়েছে, যারা এখানে বর্ষায় চাষাবাদ করেছে, স্থানীয় গেরিলাদের এখানে আশ্রয় দিয়েছে, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এর পর থেকেই তারা জাতীয় জীবনে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে, কিংবা ভারত ফেরত মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবিদের দাপটে।
আল মাহমুদ কোলকাতায় বসে বিভিন্ন রকম রঙ্গ রসে মত্ত থেকে ভারত থেকে ফিরে এসে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা কবি দাবি করেছেন, একই দাবি করেছেন আহমেদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ। নিজেদের শরনার্থী ও প্রবাসী জীবনের গল্পকে পূঁজি করে ভারতফেরত অনেকেই নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে, ব্যক্তিগত পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে অনেকেই বীর বিক্রম, বিরোত্তম পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। সংশোধিত যুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়ার সময় এইসব ব্যক্তিগত পরিচয় কাজে লাগিয়ে যারা বিভিন্ন যুদ্ধবীরের পদবি বাগিয়েছেন, তারা এইসব পদবিকে বেচে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন।
প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের অনেকের রাজনৈতিক আনতি পাকিস্তানপন্থী হলেও তারাও পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়েই পুনর্বাসিত হয়েছেন। এবং তাদের অতীত রাজনৈতিক জীবন তাদের হয়তো কিঞ্চিৎ সহায়তা করেছে এই হালুয়া রুটির ভাগ পেতে। বস্তুত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কোমর ভাঙার কাজটা করেছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভুতিশীল রাষ্ট্রের সহানুভুতিকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে প্রতিষ্ঠালোভী কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা, এবং তাদের দুর্ণীতির কারণেই এই পরিমাণ ত্রান সহায়তা পাওয়ার পরেও বাংলাদেশে কোনো স্থায়ী উন্নয়ন অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে নি।
এই রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সাথে সাথেই দেশপ্রেমিক কিছু মুক্তিযোদ্ধাও অস্ত্র সমর্পন না করে বামপন্থী বিপ্লবে সংযুক্ত হয়েছিলো। এরাও একটা সময়ে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে এবং প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করেছে।
শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে বাড়তি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার এই হরির লুটের সময়েই লোভী এবং প্রতিষ্ঠাকাতর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অন্য সব সাধারণ নাগরিকের দুরত্ব তৈরি হয়েছিলো, নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের দুরত্ব তৈরি হয়েছিলো, এবং এই ব্যবধান কখনই কমে নি পরবর্তীতে।
সে সময়ে অনেক অযোগ্য মানুষও শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদ অধিষ্ঠিত হয়েছে। এবং তাদের অযোগ্যতাও আমাদের রাষ্ট্রকে ভুগিয়েছে অনেক। এরপর একটা বৈষম্যমূলক নীতি প্রবর্তিত হয়েছিলো, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভিন্ন সরকারী চাকুরীতে বাড়তি কোটার ব্যবস্থা ছিলো , এই কোটাভিত্তিক ব্যবস্থা সব সময়ই কিছু অযোগ্য মানুষকে উন্নতির সুযোগ দেয় এবং যোগ্য মানুষদের অবাঞ্ছিত করে। শতকরা ১৫ থকে ২০ জন মানুষকে যদি শুধুমাত্র পোত্রিক পরিচয়েই রাষ্ট্রীয় পদ প্রদান করা হয় তবে অন্তত শতকরা ১৫জন যোগ্য মানুষের নিয়োগবঞ্চিত হয় ।
তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, তারা আমাদের সম্মানের পাত্র, কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো তারা তাদের সেই সম্মানীয় অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন, এবং নিজেদের অনৈতিকতা এবং নিজেদের লোভের কারণে আমাদের কাছে অসম্মানের পাত্র হয়েছেন।
গতকাল হঠাৎ করেই একটা ব্যনার দেখলাম, মুক্তিযোদ্ধাকোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমরণ অনশনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, তাদের চাকুরীর বয়সসীমা বৃদ্ধি করতে হবে, তারা কি অন্য গ্রহের মানুষ, তারা কি অন্য রকম কিছু, না কি বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাদের পৈত্রিক তালুক কিংবা এটা তাদের মামার বাড়ী?
অন্য সব সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী যখন নিজেদের চাকুরীর বয়েস বাড়ানোর আন্দোলনে নেই তখন শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে হাইলাইট করে এমন উদ্ভট আব্দার দেখলে আশ্চর্য হলাম, তারা এতটা নির্লজ্জ হলে তাদের সম্মান করবার কোনো কারণ অবশিষ্ঠ থাকে না আমার।
আমি ভেবে দেখলাম আমাদের অধঃপতনের জন্য সিংহভাগ দায় আমি দেখছি আমাদের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের উচ্চাকাঙ্খী সদস্যদেরই।