বলা হয়ে থাকে পাকিস্তান ক্রিকেট টিম নাকি বেটিং আর ম্যাচ পাতানোকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। সেই আসিফ ইকবাল থেকে শুরু করে সেলিম মালিক হয়ে হাল জমানার ওয়াসিম আকরাম... দীর্ঘ নামের অন্তহীন মিছিল। আইসিসির বিশেষ একটা নজরদারী নিয়েই চলতে হয়, সে দেশের ক্রিকেটারদের। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান টিম দুর্ভোগ আর দুর্দশার অন্তহীন এক সিরিজ খেলছে যেন। ডোপ টেষ্টে ক্রিকেটারদের ফেঁসে যাওয়া থেকে শুরু— এরপর নিজের দেশে জঙ্গিদের আক্রমন, হোমগ্রাউন্ডে খেলার সুবিধা না পাওয়া, আন্তজার্তিক টুর্ণামেন্টের আয়োজক হবার অধিকার হারানো, আর সবার উপরে ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের কুনজরে পড়া... দুর্ভোগ আর দুর্দশার অন্তহীন এক সিরিজ যেন চলছেই। পাকিস্তানী বোর্ড চলছে ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে ফকিরি হালে, পাকিস্তনি ক্রিকেটাররা হচ্ছে দুস্থঃ থেকে দুস্থঃতর।
অথচ এরই মধ্যে নতুন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়রা উঠে আসছে, টিমের সাফল্যের নজির গড়ছে। দক্ষিন আফ্রিকায় সদ্য সমাপ্ত চাম্পিয়নস ট্রফিতে সেরা চারে খেলেছে টিম। কিন্ত সেখান থেকে দেশে ফেরার পর থেকেই নতুন নতুন সন্দেহের তীঁর আবার বিদ্ধ করছে গোটা দলকে। প্রশ্ন উঠছে অধিনায়ক ইউনুসের সহজ ক্যাচ ফেলে দেওয়া থেকে শুরু করে — সেমিতে নিউজিল্যান্ডের সাথে হারা নিয়ে। এর আগে অষ্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা নিয়েও অভি্যোগ উঠেছিল তাদের সফট মনোভাব নিয়ে। ইন্ডিয়ার সেমিতে উঠতে গেলে সেদিন ইতোমধ্যে সেরা চারে উঠে থাকা পাকিস্তানকে জিততেই হতো। শেষ বলে পাকিস্তানকে হারিয়ে অষ্ট্রেলিয়া ফাইনালে উঠে গেলে — পাকিস্তানের সাথে ভারতের ক্রিকেট সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় জটিলতর। এরপরে পাকিস্তান অভিযোগ তুলে, নিউজিল্যান্ড ম্যাচে ভারতীয় বোর্ড নাকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আম্পায়ারদের প্রভাবিত করেছে... সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে ওঠা বেটিং এবং ম্যাচ ফিক্সিংএর অভিযোগ নিয়ে ইন্ধন যোগাচ্ছে আর তা নিয়ে পানি ঘোলা করছে ভারতীয় মিডিয়া।
এ সব কিছুর পটভুমিতে পাকিস্তানী কোচ ইন্তিখাব আলমের একটা সাক্ষাৎকার নজরে এলো। প্রকা|শিত হয়েছে আজকের আনন্দবাজারে। পাকিস্তান ক্রিকেটের একটা দুঃসময় চলছে, এই টিমে আমার অনেক প্রিয় খেলোয়াড় আছে। সব মিলিয়ে আমার মনটা বেশ খারাপ...
পাকিস্তানী কোচ ইন্তিখাব আলমের সাক্ষাৎকারটি এখানে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম...
‘‘এ রকম চললে সেকেন্ড স্লিপ আর থার্ড স্লিপের সামনে ঝাঁপাবে না’’
দলের অধিনায়ক ইউনুস খানের সঙ্গে ম্যাচ ফিক্সিং এর দায়ে অভিযুক্ত তিনি। দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী কোচ ইন্তিখাব আলম। লাহোরে তার বাড়ি থেকে উত্তেজিত পাকিস্তান কোচ ফোনে ইন্টারভিউ দিলেন আনন্দবাজারের গৌতম ভট্টাচার্য— কে।
প্রশ্নঃ পাকিস্তান থেকে এত রকম খবর আমাদের দেশে আসছে যে, বোঝার উপায় নেই কোনটা সত্যি? কোনটা মিথ্যে? কেউ বলছে আপনাদের পদচ্যুত করা হয়েছে। কেউ বলছেন গোটাটাই আজগুবি। আপনারা বহাল তবিয়তে আছেন?
ইন্তিখাবঃ আর?
প্রশ্নঃ তিন নম্বর হল, পাকিস্তানের এক রাজনীতিবিদ সরাসরি আপনাদের অভিযুক্ত করেছেন। তাই কার্যত দেশের মানুষের সামনে আপনারা কাঠগড়ায়।
ইন্তিখাবঃ (তিক্ত গলায়) তিন নম্বরটা ঠিক। আগামী ১৩ তারিখ আমি আর ইউনুস ইসলামাবাদ যাব স্ট্যান্ডিং কমিটির সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনে।
প্রশ্নঃ কি মনে হচ্ছে গোটা ঘটনায়?
ইন্তিখাবঃ কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। খুব নোংরা, অসত্য, দুঃখজনক, হতাশ করে দেওয়া অভিজ্ঞতা। কি আশ্চর্য, ম্যাচ হারলেই কি ফিক্সিং শব্দটা জুড়ে দেওয়া পাকিস্তান ক্রিকেটারদের নিয়তি হয়ে গেল? আর কোন দেশ হারলে লোকে তো এসব বলে না! ফাইনালে ম্যাকালাম এত সহজ ক্যাচ ফেলল, কেউ তো বলেনি — ফিক্সিং? ইন্ডিয়া সেমিফাইনালে উঠতে পারলো না। সাউথ আফ্রিকা ফেভারিট হয়ে নিজের দেশে এমন বিশ্রি হারল। শ্রীলঙ্কানরা বাড়ি চলে গেল তাড়াতাড়ি। কোনও কথা তো কোথাও উঠল না!
যাবতীয় অভিযোগ কি শুধু পাকিস্তানের জন্য তোলা নাকি?
প্রশ্নঃ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে টিমের পারফরম্যান্স যখন স্ট্যান্ডিং কমিটি ব্যাখা করতে বলবে, তখন কী এগুলোই বলবেন?
ইন্তিখাবঃ শুধু এগুলো কেন, অনেক কিছুই বলবো (ক্ষোভে গলা কাঁপছে)। বলবো তিন মাস আগেই আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছি। এই টিমটাই তো জিতেছে। সেগুলো ভুলে গেলেন? সাউথ আফ্রিকায় আমরা মাত্র একটা দিন খারাপ খেলেছি, সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড ম্যাচটা। তাও বিরাট কোনও বিপর্যয় ছিল না। আরও ২০-৩০ রান হাতে থাকলে আমরা ম্যাচটা বার করে নিতাম।
প্রশ্নঃ অভিযোগ তো এটা নয়। অষ্ট্রেলিয়া ম্যাচ নিয়ে।
ইন্তিখাবঃ হ্যাঁ, ওই তো ভারতীয় মিডিয়া লিখেছে।
প্রশ্নঃ ভারতীয় মিডিয়া?
ইন্তিখাবঃ আহমেদাবাদ থেকে কে একটা লিখেছে জঘন্য লেখা। সেটা পড়েই এমন প্রতিক্রিয়া পলিটিশিয়ানদের। যত সব অনৈতিক সাংবাদিকতা। যে ম্যাচটা টুর্নামেন্টের সব থেকে নাটকীয় আর সবচেয়ে ক্লোজ হয়েছে, তার মধ্যে কিনা ম্যাচ ফিক্সিংএর গন্ধ খুঁজে পেল?
প্রশ্নঃ কিন্তু আপনার দেশের রাজনীতিবিদই বা কি! তার নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা থাকবে না? ভারতীয় মিডিয়া কোথায় কী লিখেছে সেটা নিয়ে সে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়বে!
ইন্তিখাবঃ তাই তো হয়েছে।
প্রশ্নঃ এর আগে শ্রীলঙ্কা সফরের পরেও তো টিম পারফরম্যান্স নিয়ে দেশে ম্যাচ পাতানোর তুফান তোলা হয়েছে। তখন তো ভারতীয় মিডিয়া আওয়াজ তোলেনি।
ইন্তিখাবঃ বললাম তো, দুঃখজনক ফ্যাশনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কোথায় আমাদের দেশের ক্রিকেটারদের সমস্যা বুঝে লোকে আরও সহানুভুতিপ্রবণ হবে তা নয়, উলটে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। কত কষ্ট — ছেলেগুলো জঙ্গি হামলার পর থেকে দেশের মাঠে খেলতে পারে না। ক্রাউড সাপোর্ট পায় না। দেশে এত সব হিংসাত্মক ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে বিশ্বকাপ জিতেছে। তারপরেও বেচারিদের রেহাই নাই।
প্রশ্নঃ ইমরান — আপনার প্রাক্তন ক্যাপ্টেন টিমের পাশে দাড়িয়েছেন।
ইন্তিখাবঃ হু, কাগজে পড়লাম।
প্রশ্নঃ বাকি মিডিয়া?
ইন্তিখাবঃ এটাই সুখের কথা যে, ওরা টিমের পাশে আছে।
প্রশ্নঃ পাকিস্তানি আওয়াম?
ইন্তিখাবঃ হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তারাও টিমকে বিশ্বাস করছে। আজই ডন পত্রিকায় একটা সার্ভে-তে শতকরা নব্বই শতাংশ লোক বলেছে তারা টিমকে সাপোর্ট করে।
প্রশ্নঃ ক্রিকেট বোর্ডও পাশে?
ইন্তিখাবঃ ক্রিকেট বোর্ড এখনও পর্যন্ত কিছু বলেনি। তবে আমাদের কর্তা ইজাজ বাট দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কাল ফিরছেন। ফিরলে বোর্ডের স্ট্যান্ডটা পরিস্কার হবে।
প্রশ্নঃ মানসিক ঝড়ঝাপটার মধ্যে ছেলেদের চাঙ্গা রাখছেন কি করে?
ইন্তিখাবঃ খুব কঠিন কাজ। এই অবস্থায় কী এদের এক ছাতার তলায় অক্ষত রাখা সম্ভব নাকি? মানসিকতাটাই তো ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায়। আমাদের পরের সফরের জন্য দুবাই রওনা হতে হবে নভেম্বরের শুরুতে। আল্লাহ জানেন, তখন টিমের হাল কি থাকবে।
প্রশ্নঃ এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও ঘটবে। সমাধান সূত্রটা কোথায়?
ইন্তিখাবঃ আমার আবেদন হল, ক্রিকেটার আর ক্রিকেটারদের প্লিজ একলা থাকতে দিন। নিজের মতো থাকতে দিন। সবাই যদি এর মধ্যে ঢুকে পড়ে, যদি রাজনীতিবিদ এর থেকে সস্তা প্রচার খোঁজে, তা হলে সাংঘাতিক অবস্থায় নেমে যাবে খেলাটা। তখন প্রতিটি ঘটনাকেই সন্দেহজনক মাইক্রোস্কোপে ফেলে দেখা হবে। আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি, ভবিষ্যতের কোন যুবা ক্রিকেটার আর ঝুঁকি নিয়ে হয়তো অসাধারন কিছু করতে যাবে না। দ্বিতীয় স্লিপ ঝাঁপিয়ে পড়ে থার্ড স্লিপের সামনে থেকে হাফ চান্সে ক্যাচ তুলবে? ভুলে যান। হাফ চান্সের সুযোগ নেওয়া বলে আর কিছু থাকবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৭