সেজ ফুফুর বিয়ের ধুমধামের কথা আমার খুব মনে আছে, ব্যক্তিগত কিছু অপমানের কারনে...

বালকের মান অপমান জ্ঞান বড়ই তীব্র। আমার তখন বালক বয়স। আমাদের বাসার যে কোন অনুষ্ঠানে মেজচাচার ভুমিকা বরাবরই ইভেন্ট ম্যানেজারের। যত বিশাল অনুষ্ঠানই হোক না কেন, সব কিছুর কেন্দ্রীয় ভুমিকায় থেকে অভাবনীয় দক্ষতায় তিনি সবদিক সামলাতেন। আর এ কাজে তাকে যোগ্য সহযোগীতা দিয়ে যেত তার এক গাদা ডেপুটি আর তাদের রাশি রাশি অ্যাসিষ্টান্টরা। তৎকালে আধুনিক ক্যাটারিং সিস্টেম ছিল অজানা বস্তু। সে সময় প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনদের সক্রিয় অংশ গ্রহনের মধ্য দিয়েই সমাধা হয়ে যেত বিয়ে শাদির মতো যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। যার যেমন কর্ম দক্ষতা, সে অনুযায়ী দ্বায়ীত্ব সে বেছে নিত, কেউ থাকতো ভাড়ারের দ্বায়ীত্বে, কেউ বাবুর্চীর তত্বাবধান কাজে, কেউ বা খাবার পরিবেশনায় আবার কেউ কেউ অতিথিদের অভ্যার্থনার দ্বায়ীত্বে।
পরিবারের কমবয়সীদের দেওয়া হতো সামর্থ্য অনুযায়ী দ্বায়ীত্ব, সেই ছোটবেলায় আমদের মতো বাচ্চাদের টার্গেটই থাকতো কত গুরুত্বপুর্ণ পদে নিজকে আসীন করা যায়... বিয়ে বাড়িতে সেদিন অতিথিদের অভ্যার্থনার দ্বায়ীত্বে যে ক্ষুদ্র দলটি প্রধান ফটকে নিয়োজিত ছিল, আমি ছিলাম তার কনিষ্ঠতম সদস্য। সন্ধ্যা থেকেই সব কাজ সুচারু ভাবে চলছিল, সেদিনের বরযাত্রীদের সাথে ছিলেন এক রুপসী ভদ্রমহিলা, সম্পর্কের দিক থেকে আমি তার নাতি স্থানীয় হওয়ার সুবাদে দুই দিন আগের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে তিনি আমার গালে মুখে বিস্তর হলুদ লেপে দিয়েছিলেন... অঘটন ঘটল বরপক্ষের এই রুপসী ভদ্রমহিলা আসার সাথে সাথে... বলা বাহুল্য এই অঘটনের (খল) নায়ক আমি নিজেই...

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যা করা জায়েজ আছে, বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনে সদ্য পার্লার ফেরত কোন রুপসীকে যে তা করা যায় না, এই কান্ডজ্ঞান আমার নাই, এই অভিযোগে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে সেদিনের অভ্যার্থনার দল থেকে আমাকে দ্রুত বরখাস্ত করা হল, এবং ভাড়ার ঘরে দাদীর তত্বাবধানে পানের গায়ে চুন লাগানোর মতো খুবই নিন্ম মানের এক কাজে আমাকে নিয়োজিত করা হলো।




আজকাল মাঝে মাঝেই আমার খুব মনে হয়, সামগ্রিক বিশ্ব উৎপাদনের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ দুনিয়া জুড়ে চলছে, বৈশ্বিক এই ক্রিয়াকর্মে, এখানে বাংলাদেশের ভুমিকা কি? বর্তমানের আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ঠ্যই হলো কোন দেশই এখন একক ভাবে পুর্ণাঙ্গ কোন ফিনিশড প্রোডাক্ট বানায় না।
সহজ উদাহরন হিসাবে বলা যায়, আজ লন্ডনের অভিজাত কোন ষ্টোরে বিখ্যাত ব্রান্ডের যে শার্টটা আমরা বিক্রি হতে দেখি, তার ফেব্রিক হয়তো ইন্ডিয়ান, বাটন পাকিস্তানের, স্টিচিং বাংলাদেশের, মার্কেন্ডাইজিংএর কাজটা করছে শ্রীলঙ্কানরা এভাবে...
একেক দেশের অবকাঠামো একেক মানের, সে অনুযায়ী তার দক্ষতারও রকমফের ঘটে, আর সেই দক্ষতা অনুযায়ী সে টোটাল প্রোডাকশনে অংশগ্রহন করে। সেই হিসাবে বাংলাদেশের দক্ষতার জায়গাটা কোথায় যেখানে দুনিয়াব্যাপি উৎপাদনচক্রের কোন একটা অংশের দ্বায়ীত্ব বাংলাদেশ নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারে? চলমান এই বৈশ্বিক (গ্লোবাল) কর্মযজ্ঞে তার একটা স্থান গড়ে তুলতে পারে?
এ যাবত আমরা দেখছি বাংলাদেশের মেয়েরা খুব কম মজুরীতে সেলাইএর কাজ করে, ফলে উন্নত বিশ্বের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির স্থানান্তর আমরা দেখেছি বাংলাদেশে, কিন্ত প্রায় কয়েক দশক যাবত ধরে চলে আসা এই সেক্টরটির উৎপাদনশীলতায় কোন গুনগত পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই না। বিশ বছর আগেও আমরা যা করতাম, সম্ভবতঃ এখনও আমরা সেই কাজটাই করছি।
যে কোন সাধারন বুদ্ধির মানুষও এটা বোঝে যে বাঙালীর বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করে তাকে দাবিয়ে রাখে না, তাকে গরীব করে রাখে না। বিশ্ব উৎপাদন ব্যাবস্থায় বাংলাদেশের ভূমিকা কি হবে, তা প্রধানত নির্ভর করে কি ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা আমরা এখানে জারি রেখেছি, এবং কত সিরিয়াসলি আমরা সেই অবকাঠামো থেকে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের সুবিধা বজায় রাখতে পারছি। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করার জন্য তো প্রস্তুত, কিন্ত সেই উৎপাদনশীলতার আন্তর্জাতিক মান যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তবে আমরা আমাদের দুরবস্থার জন্য কাকে কাকে দায়ী করবো?
গত কয়েকদিন বাংলাদেশ ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে যে অব্যাবস্থাপনার নজীর দেখালো, তাতে করে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের আস্থার জায়গাটাই নতুন ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। বাংলাদেশের এ যাবতকালের যাবতীয় উন্নতি, যা কিছু অর্জন, তার দাবীদার মুলতঃ কিছু দুঃসাহসী ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা। যারা অনেক সময়ই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার তোয়াক্কা না করে ব্যাক্তিগত মেধা আর উদ্যম দিয়ে একের পর এক বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়েছেন। কিন্ত সেই সব উদ্যোগী তরুন উদ্যোক্তাদের হতাশার গর্ভে বারবার ছুড়ে ফেলা হয় কি ভাবে... এ রকম একটা ঘটনার বিবরন পড়ছিলাম আজকের এক সংবাদপত্রে।
বলা হচ্ছে কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা কেন্দ্র (হেল্প ডেস্ক) কিছু দিন থেকে পরিচালনা করছে ঢাকার একটি সফট ওয়্যার ফার্ম। কানাডার ওই ফার্মটির পরিকল্পনা ছিল ঢাকায় তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়ানোর, কিন্ত গত বুধবার সকাল থেকে ইন্টারনেটের শ্লথ গতি আর শুক্রবারে পুরো পুরি ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা কানাডার ওই ফার্মটিকে বাধ্য করেছে তাদের হেল্প ডেস্ক সহ অন্যান্য অপারেশনের কাজটি সীমিত আকারে রাখতে। পুরো অপারেশন ঢাকায় স্থানান্তর করার বিষয়ে তারা হয়ত আরো বেশি করে ভাববে... কারন ইন্টারনেটের দুরবস্থা দেখে কানাডীয় প্রতিষ্ঠানটি দ্বিধান্বিত...

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ৯:৪৬