একটা জলজ্যান্ত মানুষকে আরেকদল 'মানুষ' নির্বিকারভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা পিটিয়ে হত্যা করলো! এর চেয়ে বড় বেদনার, ভীতিকর, উৎকন্ঠার এবং লজ্জার আর কী আছে আজকের 'আধুনিক' এবং বিজ্ঞানের জয়জয়কারের 'সভ্য' দুনিয়ায়! ২১ বছরের আবরারকে ওরই সমবয়সী, সহপাঠি, ওর মতই দেখতে, ডজন খানেক আবরার কী নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল! এই দুঃসহ ঘটনার পূনরাবৃত্তি হয়েই চলেছে।
বরাবরের মতই খুনীদের গ্রেপ্তার চাই, বিচার চাই, সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, সংশ্লিষ্ট 'এর'-'ওর' পদত্যাগ চাই, বিষয়ভিত্তিক ব্যানার, ফেস্টুন, মিছিল, সভা, মানববন্ধন, দাবী, বর্জন, আন্দোলন, জাগরণ- ক'টা দিন এইতো! এরপর? যে যার পথে....। সদ্য নিহত আবরার এখন আমাদের নানাবিধ 'গবেষণা', বক্তব্য-মন্তব্যের বিষয় মাত্র। আমাদের বিদ্যে-বুদ্ধি, জ্ঞাণ-গম্মি প্রকাশে আত্নতুষ্টির সুযোগ মাত্র। আবরার এর স্বভাব, চেহারা, থুতনির নীচের নির্দোষ একটুখানি দাড়ি, সংস্কৃতি-ধর্মচর্চা, সামাজিক মাধ্যমে আর দশটা বোধ সম্পন্ন সুস্থ মানুষের মত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের এইবাদী সেইবাদী বিশিষ্ট কারো কারোর আলোকরশ্মির গতিতে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ এবং ব্যক্তিগত 'রায়' ঘোষনার 'পবিত্র দায়িত্ব' পালনের 'অধিকার'টা চর্চিত হচ্ছেই। তাই, কেউ কেউ বুকের পাটা চওড়া করে, কেউ মিনমিন করে আবার কেউ ঘেউ ঘেউ করে হলেও তাদের গবেষণা কেতাবে আবরারকে 'উগ্র'দের দলে ফেলে তাকে হত্যার কারণ নিশ্চিত করে চায়ের পেয়ালা হাতে প্রেমের কবিতায় মন দিয়ে রিল্যাক্সড হন। হায়, এমন নির্লজ্ঝ, হতদরিদ্র সোশ্যালমিডিয়াবাজ সেলেব্রিটি 'মানব'জীবন! আবরারদের মা-বাবা এবং প্রিয়জনদের অসহায় চেহারা, পরিবারের আহাজারী, বিলাপ নিয়ে মিডিয়াওয়ালাদের যুৎসই 'মনোযোগ কামাই'ও একটা সময় থামে। কিন্ত হারিয়ে যাওয়া আবরারদের মা-বাবার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চলতে থাকে আমৃত্যু। আর র'য়ে যাওয়া বাকী আবরারদের মা-বাবারা, প্রিয়জনেরা উৎকন্ঠায়, আশংকায় কুঁকড়ে থাকে, চোখ-কান-মুখ বন্ধ করে মেরুদন্ডহীন নির্বিষ সরিসৃপের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে থাকে। স্বাধীন মাতৃভূমিতে সন্তানের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে এর চেয়ে ভাল পথ বুঝি আর এখন নেই। আমাদের সন্তানেরা 'দুধে-ভাতে' চাইনা; চাই শুধুই মানবিক হয়ে বেড়ে উঠুক, সত্যিকারের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকুক। হয়তো কোন একদিন একটা সত্যিকারের সভ্য পৃথিবী ওরা গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।