1st part
দুইদিন বাড়ি থেকে আমাকে কোন ফোন দেওয়া হলো না ৷ তৃতীয় দিন ভাবী ফোন করে বাড়িতে আসতে বলল ৷ সেইদিন রাতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷ বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে ৷ কোনও আপত্তি জানালাম ৷ শুধু আমার কিছু দাবী জানালাম ৷ বিয়েতে কোনও অনুষ্ঠান করা যাবে না,কাওকে দাওয়াত দেওয়া যাবে না এবং বিয়ের আয়োজন করতে হবে রাতে ৷ সবাই আমার দাবী বিনাবাক্যে মেনে নিল ৷ আসলে মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবীক ৷ নির্ধারিত দিনে দুই পরিবারের সাত-আটজনের উপস্থিতিতে বিয়ের কার্যক্রম শেষ হল ৷ যে মেয়েটা একবার শাসনের সুরে থাপড়ায়া আমার দাঁত ফেলে দিতে চেয়েছিল ,সে এখন আমার বউ ৷ কী আজব ব্যাপার ! সিএনজিতে করে বউ নিয়ে বাড়িতে আসলাম ৷ গ্রামে সাধারণত নতুন বউ আসলে পাড়াপ্রতিবেশীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে বউ দেখার জন্য ৷ কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এসবের কিছুই হলোনা ৷ আসলে আমার বিয়ে সম্পর্কে কেউ জানতোই না ৷ রাত একটার দিকে আমাকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো ৷ আমার মনে হচ্ছিলো আমি কোন এক ঘোরের মধ্যে আছি ৷ ঘরটাকে আমার বাসর ঘর মনে হলো না ৷ মনে হল এটা আমাপৃর শোবার ঘর ৷ বাসর ঘরে ফুলতো দূরে থাকলো,ফুলের কোনও পাপড়িরও অস্তিত্ত ছিল না ৷ কেননা ঘরটাকে সাজানো হয়নি ৷ আমার পরনে কোন বিয়ের পোশাক ছিল না ৷ নর্মাল পোশাকেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৷ আমি খুব টেনশনে ছিলাম আমার করণীয় নিয়ে ৷ কি করব ভেবে না পেয়ে পিছনের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম ৷ অনেকক্ষণ পর দূর থেকে ফজরের আজান ভেসে আসলো ৷ বুঝতে পারলাম ভোর হতে দেরী নেই ৷ ঘরের ভিতর উঁকি দিলাম ৷ প্রথমে যেভাবে বসে থাকতে দেখেছিলাম তাকে,এখনও সেভাবেই বসে আছে ৷ ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির বাহিরে চলে গেলাম ৷ একঘন্টার মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরে আসলাম ৷ বাড়ি ফিরেই বুঝতে পারলাম বিয়ের খবরটা বাতাসের আগেই পাড়ায় ছড়িয়ে গেছে ৷ অনেক মহিলা ও বাচ্চা-কাচ্চা এসেছে বউ দেখতে ৷ আমি ভাইয়ার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ৷ কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারি নাই ৷ একটু পর ভাবীর ডাকে ঘুম ভাঙলো ৷
-এখানে কি করছিস?
-দেখছোনা ঘুমাইতেছি ৷
-এই ঘর কী তোর? যা ঘরে যা ৷
-ভাবী প্লীজ বিরক্ত কইরো না ৷
ভাবী বুঝতে পারলেন তার ডাকাডাকিতে কাজ হবে না ৷ তিনি আমার ভাতিজাকে দায়িত্ব দিলেন আমাকে ঘুম থেকে জাগাতে ৷ পিচ্চি শরীরের উপর উঠে লুঙ্গি ডান্স শুরু করে দিল ৷ প্রচন্ডরকম মেজাজ খারাপ হওয়া সত্তেও ঘুম থেকে জাগলাম ৷ ঘুম থেকে উঠে ভাবীকে মনে মনে সেই লেভেলের গালি দিলাম ৷ বাহিরে এসে দেখি মা এবং ভাবী রান্নায় ব্যস্ত ৷ মাকে জানালাম আজকেই সিলেট চলে যাব ৷ মা,ভাবী দুজনেই অবাক ৷ সেখানে ভাইয়াও ছিল ৷ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,কেন?
-এমনিতেই ৷
-এটা কোনো যৌক্তিক কথা হলো?
-ভাল লাগছেনা চলে যাব,ব্যাস ৷ এ বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন শোনার ইচ্ছা আমার নেই ৷ এই কথা বলে সেখান থেকে চলে আসলাম ৷ আসলে তখন আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ৷ একবার মনে হচ্ছে বিয়ে করলাম কেন?আবার মনে হচ্ছে, বিয়েতো একসময় করতেই হতো ৷ একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে তাতে কোন সমস্যা নেই ৷ আবার মনে হলো,কেন সে আমাকে বিয়ে করার জন্য এরকম পাগলামী করেছিল? বিষয়টা জানা দরকার ছিল ৷ একবার ভাবলাম,ঘরে সে একা একা কি করছে? একটু দেখে আসি ৷ আবার ভাবলাম,না,দেখার কোনও প্রয়োজন নেই ৷ এরকম হাজারো চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো আর আমি নিজের সাথেই নিজে যুদ্ধ করছিলাম মনটাকে শান্ত রাখার জন্য ৷ প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিলো ৷ আমার শ্বশুরকে দেখলাম আমাদের বাড়ির দিকে আসছে ৷ কথা বলার প্রয়োজন মনে করলাম না ৷ চোখ বুঁজে বসে থাকলাম ৷ ঘন্টাখানেক পর বাড়ি গেলাম ৷ আব্বা তার ঘরে আমাকে ডাকলেন ৷ গিয়ে দেখি আমার শ্বশুরও আছেন ৷ আব্বা জিজ্ঞেস করলেন আমি সিলেট আসতে চাইছিলাম কিনা ৷ আমি শুধু হুম বললাম ৷ আব্বা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,বউকে সাথে নিয়ে যাও ৷ আমি আপত্তি জানালাম ৷ একপর্যায়ে মা,ভাইয়া এবং ভাবী ঘরে আসলো ৷ তারা অনেকভাবে চাপ প্রয়োগ করে আমাকে রাজী করালো ৷ বউকে নিয়ে সেদিনই সিলেট রওণা দিলাম ৷ তার আসলে লং জার্নি করার অভ্যাস ছিল না ৷ রাস্তায় বমি করলো ৷ একপর্যায়ে খেয়াল করলাম সে খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ৷ আমার সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই ৷ ভাবখানা এমন যে,মরলে মরুক ৷ পুরো রাস্তা দুজনের কোনো কথা হয়নি ৷ ভৈরব উজান ভাটিতে গাড়ি স্টপেজ দিল ৷ রাত তখন তিনটা ৷ আমি নেমে একটা সিগারেট টেনে আবার গাড়িতে উঠলাম ৷ উঠে দেখি সে ঘুমিয়ে পরেছে ৷ আসলে সে ঘুমায়নি,সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল ৷ যেটা বুঝতে পারলাম সিলেট এসে পৌছার পর যখন গাড়ি থেকে নামতে যাব ৷ সিএনজি ঠিক করে নিয়ে গেলাম ওসমানী মেডিকেল ৷ জ্ঞান ফিরলে বাসায় নিয়ে আসলাম ৷ আমি যে বাসায় থাকতাম সেই বাসাটা ছিল ব্যাচেলরদের বাসা ৷ তাই ওকে বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছে রেখে বের হলাম বাসা খুঁজতে ৷ সিলেট বাসা পাওয়া একটু কষ্টের ৷ অনেক কষ্টে একটা বাসা ম্যানেজ করে বাড়িতে ফোন দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে আসবাবপত্র কিনে একটা লোক ভাড়া করে বাসা গোছালাম ৷ সন্ধায় বউকে নতুন বাসায় নিয়ে আসলাম ৷ শুরু হলো আমার সংসার জীবন ৷ কেটে গেল কয়েক মাস ৷ cse-তে পড়ার কারণে আমার কেন জানি মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকতো ৷ অন্য cse স্টুডেন্টদের এরকম হতো কিনা জানিনা,তবে অমার হতো ৷ যখন তখন বৌয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতাম ৷ আমাদের শুধু শারীরিক সম্পর্কই ছিল,মনের কোন সম্পর্ক ছিলনা ৷ কথা হতো পরক্ষভাবে ৷ আমি কিছু বললে উত্তর দিতো,তাছাড়া কোন কথা হতো না ৷ মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম একা একা কান্না করছে ৷ তার কান্নায় কোন শব্দ হতো না ৷ শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়তো ৷ এতেও আমার মানসিকতার পরিবর্তন হলো না ৷ অমানুষিক মানসিক অত্যাচার করতাম ৷ একদিন শরীরে হাতও তুলে ছিলাম ৷ আমার কেন জানি মনে হতো,ওর কারণে আমি কোনও দিন সফল হতে পারব না ৷ছয় মাসের বেশী হয়ে গেলো ৷ একদিন শ্বশুর গ্রামে আসার অনুরোধ জানালো ৷ সময় নেই বলে ফোন রেখে দিলাম ৷ চলে গেলো একবছর ৷ এই একবছর একই ছাদের নীচে বাস করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম বউয়ের কিছুটা মানসিক সমস্যা আছে ৷ ধরে নিলাম এই কারণেই হয়তো আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগলামী শুরু করেছিল ৷ যাইহোক,একদিন গভীর রাতে খেয়াল করলাম বউ পাশে নেই ৷ ঘরের আলো জ্বালাতেই সে ব্যালকনি থেকে ঘরে প্রবেশ করলো ৷ কিছু না বলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ৷ পরের দিন দেখি একই অবস্থা,সে বিছানায় নেই ৷ এবার আর আলো জ্বালালাম না ৷ নিঃশব্দে উঠে ব্যালকনির দিকে গেলাম ৷ জ্বানালার পর্দা একটু সরালাম ৷ দেখি সেখানে কেউ নেই ৷ ফিরে এসে পুরো বাসা খুঁজলাম ৷ কোথাও নেই ৷ মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম পাইলে খবর করে ছাড়ব ৷ কিন্তু কোথাও নেই ৷ ফিরে আসলাম রুমে ৷ আবার ব্যালকনিতে গেলাম ৷ এইবার তাকে পেলাম ৷ আসলে সে ব্যালকনিতে শুয়ে ছিলো তাই জানালা দিয়ে দেখতে পাইনি ৷ আমার উপস্থিতি সে বুঝতে পারে নাই ৷ আনমনে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ অঝোরে কাঁদছে ৷ সে কান্নার কোনও শব্দ নেই ৷ মাঝে মাঝে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ৷ আমি যেন হতবিহ্বল হয়ে গেলাম ওকে এই অবস্থায় দেখ ৷ চলে এলাম ঘরে ৷ তখনই সে বুঝতে পারলো ৷ আমার পিছে পিছে ঘরে ঢুকলো ৷ আমি বিছানায় এসে বসলাম ৷ ও প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আমার কিছু কড়া কথা শোনার ৷ আমি কিছু না বলায় সে একটু আশ্চর্য হলো ৷ আমি শুয়ে পড়লাম ৷ সেও পাশে এসে শুয়ে পড়লো ৷ অনেকক্ষণ হয়ে গেল ঘুম আসছিলোনা ৷ শুধু অস্বস্তি লাগছিলো ৷ আমার মনুষ্যত্ব নিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম ৷ আমিতো নারী নির্যাতনের পক্ষে না ৷ অথচ আমার ঘরেই একজন নারী বিগত এক বছর ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছে ৷ আমি নিজেই একসময় ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলাম ৷ আর আমার ঘরেই একজন নারী অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার ৷ আমি আর ভাবতে পারছিলাম না ৷ আসলে তার দোষটা কী? সে ডিভোর্সী মেয়ে? সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়?আসলে এগুলোতো দোষ হতে পারে না ৷ রাসুল নিজেইতো ডিভোর্সী এবং তার চেয়ে পনেরো বছরের বড় এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন ৷ তাহলে আমার সমস্যা কোথায়? নাকি তার কর্মকান্ড আমাকে বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য করেছিলো বলে তাকে ঘৃনা করছি? এখানেওতো তার কোনও দোষ নেই ৷ কারণ আমি বুঝতে পেরেছি তার কিছুটা মানসিক সমস্যা আছে ৷ এই কারণেই হয়তো ঐ সময়টাতে সে এরকম করেছিলো ৷ কিন্তু আমি কেন এরকম অমানুষ হলাম?আমি আর ভাবতে পারলাম না ৷ বিছানা থেকে উঠে পড়লাম ৷ ঘরে আলো জ্বালালাম ৷ খেয়াল করলাম প্রচন্ড রকমের ঘেমে গিয়েছি ৷ একটু পানি খেলাম ৷ বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি শোয়া অবস্থাতেই বউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ আমি গামছা দিয়ে পুরো শরীর মুছে গোসলে ঢুকলাম ৷ গোছল শেষ না হতেই আজান শুরু হলো ৷ ভাবলাম,আজ আর ঘুমাবো না ৷
চলবে..........
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:২৬