ধারণা করা হয় যে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ইসলাম ধর্মের আল্লাহ ঘর কা'বার সাথে পূর্বে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল । তাদের ভ্ন্নি ভিন্ন পূজা-অর্চনা এবং চিহ্নসমূহ এরই প্রমান বহন করে । তাদের প্রাচীন মন্দিরসমূহকে কা'বা অভিমুখী করে রাখাও এর বড় প্রমাণ । বেদ এবং পূরাণ শাস্ত্রে কা'বা শরীফের একাধিক নাম উল্লেখ করা হয়েছে যা বিশেষ বিশেষ হিন্দুরা অবগত আছে । বেদে কা'বা সংক্রান্ত মন্ত্র ও শ্লোকগুলি অনুবাদ করে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা প্রায় অসম্ভব । তবু নিচে এর কিছূ আলোচনা করা হলোঃ
ধারণা করা হয় বেদ ও পূরাণ শাস্ত্রে কা'বার জন্য নিম্নের শব্দসমূহ ব্যবহার করা হয়েছে।
১. ইলাষ্পদ
২. ইলায়াষ্পদ
৩. নাভা পৃথিবীয়া
৪. নাভী কমল
৫. আদি পুষ্কর তীর্থ
৬. দারুকাবন
৭. মুক্তিশ্বর
এ সমস্ত নাম বেদ এবং পূরাণ শাস্ত্রে যে মহান তীর্থ পবিত্রভূমির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তা আমাদের একেবারে অজ্ঞাত । ধর্মীয় গোড়ামী ও আবেগের বশবর্তী হয়ে হিন্দু ধর্মগ্রন্হে বর্ণিত পবিত্র তীর্থসমূহকে ধর্মীয় হিন্দুসমাজ ভারতের সাথে সম্পৃক্ত মনে করলেও তার ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই । আসুন আমরা ঐই নামগুলোর অর্থের দিকে নজর দেই ।
ইলাষ্পদ
বেদসমূহে সংষ্কৃত ভাষায় ইল, ইলিয়া, ইলা, ইলিয়া ইত্যাদি শব্দ মা'বুদ অর্থে এবং 'পদ' স্হান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । তাহলে ইলাষ্পদ অর্থ মা'বুদের স্হান (স্রষ্টার ঘর) ।
ইলায়াষ্পদ
এ শব্দটি ইলাষ্পদ শব্দের সমার্থবোধক । পন্ডিত শ্রীরাম শর্মা আচার্য বেদের হিন্দি অনুবাদে শব্দটির অর্থ লিখেছেন- 'পৃথিবীর পবিত্র স্হান ।'
নাভা পৃথিবীয়া
নাভা অর্থ নাভী আর পৃথিবীয়া অর্থ ভূ-পৃষ্ঠ । এভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় ভূ-পৃষ্ঠের নাভী । সমস্ত মুসলমান ভাল করে জানে যে, কা'বা শরীফকে পৃথিবীর নাভীমূল বলা হয় । বেদের একটি মন্ত্রও সাক্ষ্য দেয়, " আমাদের ইলাষ্পদ পৃথিবীর নাভিমূলে ।" বেদের এই সংজ্ঞার পর কা'বা ঘরই যে ইলাষ্পদ তা অনুমান করতে কোন অসুবিধা আছে বলে মনে হয় না ।
ঋকবেদের তৃতীয় খন্ডের ২০ শ্লোকের চতুর্থ মন্ত্র ।
নাভী কমল
পদ্ম পূরাণে উল্লেখ করা হয়েছে, 'নাভী কমল' একটি তীর্থের নামঃ সেখান থেকে সৃষ্টির সূচনা হয়েছে । কুরআন শরীফেও বলা হয়েছে, ভূ-পৃষ্ঠে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে সেটা মক্কায় অবস্হিত ।
নাভী কমল এবং নাভা পৃথিবীয়া শব্দদ্বয়ের অর্থ অনুধাবন করা হলে বুঝা যাবে যে, সেটা কা'বা শরীফ ছাড়া অন্য কিছু নয় ।
আদি পুষ্কর তীর্থ
এর শাব্দিক অর্থ হল, পালনকর্তার প্রাচীনতম তীর্থ । এটাও পদ্মপূরাণে নাভী কমলের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে । বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি পুষ্কর তীর্থের
সেবা করার জন্য ইচ্ছা করে তার সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় , যে পুষ্কর-তীর্থ যাত্রা করে সে অসীম পূণ্যের অধিকারী হয় ।
দারুকাবন
সংষ্কৃত ভাষায় 'দার' অর্থ হচ্ছে স্ত্রী এবং 'বন' অর্থ জঙ্গল । বাইবেল মুকাশিফাতে ইউহানা গ্রন্হের দ্বাদশ অধ্যায়ে কাবাকে বলা হয়েছে নারী, আর মক্কাকে আল-কুরআনে মধ্যে উম্মুল কুরা অর্থাৎ 'জনপদের মা' বলা হয়েছে । অভিধানে এই শব্দটির যে অর্থ লেখা হয়েছে তা হচ্ছে : একটি বন বা জঙ্গলের নাম যাকে তীর্থস্হান মনে করা হয় ।
এই শব্দটি যে বেদমন্ত্রের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে তার তর্জমা হল- 'হে পূজারীগণ ! দূর দেশে সমুদ্রপোকূলোবর্তী এলাকায় যে দারুকাবন রয়েছে তা মানুষের তৈরী নয় । সেখানে ইবাদত করে, তার ওসীলায় জান্নাতে পৌছে যাও ।' (ঋকবেদ ১০-১৫৫-৩)
ইসলাম ধর্মমতে হযরত আদম (আঃ) পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বেই ফেরেশ্তাদের দ্বারা কাবা গৃহের ভিত্তি স্হাপন করা হয়েছিলো । আদম এবং আদম সন্তানদের জন্য সর্বপ্রথম কেবলা কাবা গৃহকে সাব্যাস্ত করা হয়েছিলো । আল-কুরআনে আল্লাহপাক বলেন,
-মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ নির্মিত হয়, তা মক্কায় অবস্হিত এবং এ গৃহ বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত ও বরকতের উৎস ।
মুক্তিশ্বর
স্যার উইলিয়াম মূর-এর ইংরেজী -সংষ্কৃত অভিধানে এ শব্দটির অর্থ এভাবে করা হয়েছে - The city of mecca-yagya অর্থাৎ মক্কা নগরী কুরবানীর স্হান । ঈশ্বর অর্থ আল্লাহ , মুক্তি অর্থ মক্কা । অতএব মুক্তিশ্বর হল আল্লাহর মক্কা অথবা আল্লাহর জন্য কুরবানীর স্হান ।
নূহ (আঃ) পর্যন্ত সবার কেবলা ছিলো কাবাগৃহ । নূহের আমেলে সংঘটিত মহাপ্লাবনের সময় সমগ্র দুনিয়া নিমজ্জিত হয়ে যায় এবং কাবা গৃহের দেয়াল বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে । তারপর হযরত ইবাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) এর আল্লাহর নির্দেশে কাবা গৃহ পনঃনির্মণ করেন । কাবা গৃহ ই ছিলো তার এবং তার উম্মতের কেবলা । (মারেফুল কুরআন)
শিখ ধর্মের প্রচারক গুরু নানক কাবা'কে শিবের মন্দির হিসেবে উল্লেখ করেছেন ।
কাবা সম্পর্কিত বেদের একটি শ্লোকঃ
মূর্ধানমস্য সংসী ব্যাথর্বা হৃদয়ং চ যৎ
মস্তিস্কাদধ্বঃ প্রৈরয়ৎ পবমানোহধি র্শীর্ষতঃ
তদ বা অথর্বণঃ শিরো দেবকোশঃ সমুজিতঃ ।
তৎ প্রাণো অভি রক্ষতি শিরো অন্নমথো মনঃ ।।
উর্ধ্বো নু সৃষ্টাস্তির্য্যঙ নু সৃষ্টাঃ সর্বা দিশঃ পুরুষ আ বভুবাঁ ।
পুরং যো ব্রক্ষণো বেদ যস্যাং পুরুষ উচ্যতে ।।
যো বৈ তাং ব্রক্ষণো বেদামৃতেনাব্রতং পুরম্ ।
তষ্মৈ ব্রক্ষ চ ব্রক্ষশ্চ চক্ষুঃ প্রাণং প্রজাং দদুঃ ।।
ন বৈ তং চক্ষুর্জহতি ন প্রাণো জরসঃ সুরা ।
পুরং যো ব্রক্ষণো বেদ যস্যাং পুরুষ উচ্যতে ।।
অষ্টাচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পুরয়োধ্যা ।
তস্যাং হিরণ্যায়াঃ কোশঃ স্বর্গো জোতিষাবৃতঃ ।।
তস্মিন হিরণ্যয়ে কোশে ত্র্যরে ত্রিপ্যাপ্রষ্ঠিত ।
তস্মিন যদ সক্ষমাত্নন্বৎ তদ বৈ ব্রক্ষবিদো বিদুঃ
প্রভাজমানাং হরিণীং যশসা সংপরীবিতাম ।
পুরং হিরণ্যায়ীং ব্রক্ষা বিবেশা পরাজিতাম ।।
[অথর্ববেদ ১০ম কান্ড ১ম অনুবাক ২য় সুক্ত ২৬-৩৩ মন্ত্র]
অর্থ - ২৬ , অথর্ব তার মস্তক ও অন্তর একত্রেই (ঐশী আদেশের সঙ্গে) গ্রথিত করিলেন, তখন ধর্মপরায়নতা তাহার ললাটে আবর্তিত হইল । ২৭, অথর্বের মস্তক প্রভুর আবাসস্হল ; উহা আত্না, মস্তক ও অন্তর সর্বদিক দিয়া সংরক্ষিত ছিলো । ২৮, উহার নির্মাণ উচ্চ, উহার প্রাচীরসমূহ সমান হোক বা না হোক, কিন্তু প্রভুকে উহার সর্বত্র দৃষ্ট হয় । যে ব্যাক্তি প্রভুর গৃহকে অবহিত আছে, সে উহা জানে । কারণ সেখানে প্রভুকে স্বরণ করা হয় । ২৯, যে ব্যাক্তি আধ্যাত্ন-মৃতে পরিপূর্ণ প্রভুর এই পবিত্র ধর্মাধামকে অবহিত থাকে, ব্রক্ষ এবং ব্রক্ষা তাহকে অর্ন্তদৃষ্টি, প্রাণ ও সন্তানাদি দান করেন । ৩০, যে ব্যাক্তি এই পবিত্র গৃহকে অবহিত হয় এবং যাহার অর্ন্তদৃষ্টি ও আত্নশক্তি বিদ্যমান, সে কখনো উহা ত্যাগ করেনা । কারণ সেখানে প্রভুকে স্বরণ করা হয় । ৩১, দেবতাদের এই পবিত্র ধামের আটটি চক্র-পরিক্রম ও নয়টি দ্বার আছে । উহা অপরাজেয় এবং উহা হিরণ্যময় অনন্ত জীবন এবং স্বর্গীয় জ্যোতিতে সমাবৃত । ৩২, তথায় হিরণ্যময় পবিত্র আত্না প্রতিষ্ঠিত আছে । উহা তিনটি স্তম্ভ, তিনটি কড়িকাঠ দ্বারা নির্মিত ; কিন্তু উহা ব্রক্ষাত্নার কেন্দ্রবিন্দু । ৩৩, ব্রক্ষ সেখানে অবস্হান করেন, উহা স্বর্গীয় প্রভায় সমুজ্জল ও স্বর্গীয় আর্শীবাদে পরিপূর্ণ । এ ধাম মানুষকে হিরণ্যময় পনমাত্নার জীবন দান করে এবং উহা অপারজেয় ।
বেদের একত্ববাদঃ
১. সদা-সর্বত্র বিরাজমান তন্দ্রা-নিদ্রাহীন সদা সজাগ প্রতিনিয়ত করূণা বর্ষণকারী সর্বশক্তিমান হে প্রভূ ! আমরা শূধু তোমারই মহিমা স্বরণ করি, তোমারই জয়গান গাই । প্রভূ হে ! আমাদের সর্বোত্তম আত্নিক পথে, আলোকিত পথে পরিচালনা করো । আমরা যেন সব-সময় সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকে অনূধাবন করতে পারি । [ঋগবেদঃ ৩.৬২.১০]
২. সত্যজ্ঞানী তিনিই, যিনি জানেন প্রভূ এক এবং অদ্বিতীয় । তিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্ব বিষয়ে একক ক্ষমতার অধিকারী । প্রাণ এবং নিষ্প্রাণের সব-কিছুই তার নখদর্পণে । সকল ক্ষমতার কেন্দ্র তিনি একক অনন্য । [অথর্ব বেদঃ ১৩.৫.১৪-২১]
৩.আদিতে তিনি-ই ছিলেন । সৃষ্টির সবকিছুর উৎসও তিনি-ই । সমগ্র অস্তিত্বের তিনি-ই প্রভূ । আকাশ ও ভূ-মন্ডলে বিরাজমান সবকিছূর তিনি-ই লালনকারী । অন্য কারো কাছে নয়, শুধুমাত্র সেই মহাপ্রভূর কাছেই আমাদের সবকিছূ সমর্পন করছি । [অথর্ববেদ- ৪.২.৭]
উৎসঃ পন্ডিত সত্যকাম বিদ্যলংকার -এর ইংরেজী অনুবাদ The Holy Vedas থেকে কিছু বাণীর সরল বাংলা মমার্থ । প্রকাশিত হয় -কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দ্বারা ।
তথ্য সূত্র---জগদগুরু মুহাম্মদ (সাঃ) , শায়খুল উবুদিয়া ইমাম সাইয়েদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুহু আল-হোসাইনী । রেনেসাঁ পাবলিকেশন্স ।
আরও জানতেঃ
একটা লিংক নিচে দেওয়া হল---
দেখতে পারেন এখানে
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১১ দুপুর ২:৫৯