নমঃ ধৃষ্ঞবে চ প্রমৃশায় নমো নিষঙ্গিণে চেষুধিমতে ।
নমস্তীক্ষেষবে চায়ুধিনে চ নমঃ স্বাষূধায় চ সুধন্বণে চ । ৩৬
অনুবাদঃ
দ্বিধাহীন নির্ভীক, বিচারকরূপী রূদ্রকে নমস্কার,
বাণ ও তুণীর্ধারী রূপী রূদ্রকে নমস্কার, তীক্ষ্ণবাণ ও আয়ুধধারী রূদ্রকে নমস্কার ।।৩৬
বিশ্লেষণঃ
হযরত মোহাম্মদ সাহেব ছাড়া এমন ঋষি দৃষ্ট হয় নাই; যিনি পৃথিবীতে প্রশাসক রাজা; বিচারক ও অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি ছিলেন । এইগুলি একমাত্র তাহার-ই পরিচয় ।
নমঃ পার্যায় চাবার্যায় চ ।
নমঃ প্রতরণায় চোত্তরণায় চ ।
নমস্তীর্থায় চ কুলায় চ ।
নমঃ শষ্পায় চ ফেন্যায় চ ।। ৪২
অনুবাদঃ
সংসারের পরপারে ও সংসারে জ্ঞাতরূপী রূদ্রকে নমস্কার
পাপ তারণের কারণরূপী রূদ্রকে নমস্কার
তীর্থে ও কুলে জ্ঞাতরূপী রূদ্রকে নমস্কার
কুশাদিতে ও ফেনায় জ্ঞাতরূপী রূ্দ্রকে নমস্কার ।। ৪২
বিশ্লেষণঃ
এখানে ভবিষ্যতে আর্বিভূত রূদ্রের পরিচয় ব্যক্ত হইয়াছে যে, ঋষিগণ সাধারণতঃ বৈরাগী ও সংসারত্যাগী হন, কিন্তু উক্ত রূদ্র একাধারে সংসারে অনাশক্ত ও সংসারাী হইবেন, তীর্থ ও সমাজে সর্বত্রই তাহার অধিকার ও কর্মক্ষেত্র হইবে । এই ক্ষেত্রে হযরত মোহাম্মদ সাহেবই চিহ্নিহ হইলেন ।
---এক্ষণে তাহার ভৃত্য তথা শিষ্যগণকেও রূদ্র বলা হইয়াছে.......
নম আতন্বানেভ্যঃ প্রতিদধানেভ্যশ্চ বো নমো ।
নম আবচ্চদ্ভ্যো হসদ্ভ্যশ বো নম ।।
নমো বিস্বজদ্ভ্যো বিদ্ব্যদ্ভ্যশ্চ বো নমো ।
নমঃ সভান্ত্যঃ সভাপতিভ্যশ্চ বো নমো ।
নমোহশ্বেভ্যো হশ্ব পতিভ্যশ্চ বো নমো ।
নম আব্যাধিনীভ্যো বিবিধ্যন্তীভ্যশ্চ বো নমো ।
নব উগণাভ্য স্তংহতীভ্যশ্চ বো নমঃ ।।
নমঃ সেনাভ্যঃ সেনানিভ্যশ্চ বো নমো ।
নমো রথিভ্যো অরথেভ্যশ্চ বো নমো ।
নমঃ ক্ষত্তৃত্ত্যঃ সংগ্রহীতৃভ্যশ্চ বো নমো ।
নমো মহদ্ভ্যো অর্ভকেভ্যশ্চ বো নমঃ ।। [২২-২৬]
অনুবাদঃ
ধনুর্ধারীরূপ হে রূদ্র, তোমায় নমস্কার ধনুতে জ্যা ও বান যোজনকারী রূদ্রদের নমস্কার ।
ধনুর আকর্ষণ ও বাণ নিক্ষেপকারী রূদ্রদের নমস্কার !!
শত্রুর প্রতিবান নিক্ষেপকারী ও তাহাদের তাড়নাকারী রূদ্রদের নমস্কার;
স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্হা অনুভবকারী রুদ্রদের নমস্কার,
নিদ্রা ও উপবেশন অবস্হায় অবস্হানকারী রূদ্রদের নমস্কার, স্হির ও ধাবিত রূদ্রদের নমস্কার
সভা ও সভাপতিরূপে স্হিত রূদ্রদের নমস্কার, অশ্ব ও অশ্বপতিরূপে স্হিত রূদ্রদের নমস্কার,
সমন্তত ও বিবিধ প্রকারে আঘাতকারী দেবসেনারূপ রূদ্রদের নমস্কার;
সানুচর মাতৃগণ ও হনন সমর্থা - রমণীগণকে নমস্কার ।।
সেনা ও সেনাপতি রূপ রূদ্রদের নমস্কার, রথী ও অরথীদের নমস্কার,
রথাধিষ্ঠাতা ও অশ্বসংগ্রহক সারথিদের নমস্কার, মহৎ ও ক্ষুদ্রদের নমস্কার ।।
বিশ্লেষণঃ
এখানে ঐ সকল মানবীয় রূদ্রদের সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, তাহারা-ও তাহাদের গুরু রুদ্রের ন্যায় ধনুধারী শত্রুদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপকারী হইবে, তাহারা শত্রুগণকে বিবিধ প্রকারে আঘাত করিবে । তাহারা ঐশী জগতের রাজ্যলিপ্সু সম্রাটের অধীনস্হ কোন সৈন্য নয়, তাহারা ধর্মের উদ্দেশ্যে কলির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সেনানী হইবে , সেজন্য তাহাদিগকে দেবসেনা আখ্যা দেওয়া হইয়াছে ।
হযরত মোহাম্মদ সাহেব যদ্রুপ ধনুর্ধারী ঋষি ছিলেন, তদ্রুপ তাহার শিষ্য গণও ধনুর্ধারী যুদ্ধরত সেনানী ছিলেন । তাহারা বিভিন্ন যুদ্ধে বিবিধ প্রকারে শত্রুদের আঘাত করিয়া পরাজিত করেন এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন । পৃথিবীর কোন নবী পয়গম্বর, ঋষি, অবতার কেহ যুদ্ধের দ্বারা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন নাই । যর্জুবেদের রুদ্র এবং কল্কিপূরাণে কল্কি অবতার সম্পর্কেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে যে তিনি অশ্বপতি হইবেন এবং যুদ্ধ দ্বারা ধর্ম শত্রু ও কলির বিনাশ সাধন করিয়া ধর্ম প্রতিষ্ঠা করিবেন । পৃথিবীর ইতিহাসে হযরত মোহাম্মদ সাহেব ছাড়া অন্য কাউকে সেইরূপ দেখা যায় না । যাহার কারণে খৃষ্টানগণ বিদ্বেষবশতঃ তাহার সম্পর্কে বলিয়া থাকেঃ
The Koran with one hand and the Sword with the other (History of the Arabs, ch xi) " একহাতে কোরআন , অন্য হাতে তরবারী ।"
কিন্তু তিনি ব্রক্ষ-প্রেরিত হইয়া ব্রক্ষ-ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে আর্বিভূত হইয়াছেন । সুতরাং তাহার শত্রুগণ, বিদ্বেষীগণ যাই বলুক না কেন, তিনি তারা দায়িত্ব অবশ্যই সমাধা করিবেন এবং তিনি তাহাই করিয়া গিয়াছেন ।
২৪শ মন্ত্রে সবিশেষ ও অদ্ভুত লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে যে, উক্ত ধর্মযুদ্ধে মাতা ও নারীগনও যোগদান করিবেন ।
২৬শ মন্ত্রে উল্লেখিত "মহৎ ও ক্ষুদ্র" বলিতে পদমর্যাদাসম্পন্ন এবং সাধারণ ব্যাক্তিগণ অথবা বয়স্ক ও বালকগণ বোঝায় ।
হযরত মোহাম্মদ সাহবে মক্বাবাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া নিরূপায় হইয়া মাতৃভূমি ত্যাগ করিয়া তিনশত মাইল দূরবর্তী মদীনায় হিজরত করেন । তথাপি মক্কাবাসীগণ পরবর্তী বৎসরে একহাজার সশস্ত্র সৈণ্যবাহিনী নিয়া মদীনা আক্রমণে উদ্যত হয় । হযরত মোহাম্মদ সাহেব তিনশত তেরো জন শিষ্য নিয়ে বদর নামক প্রান্তরে সম্মূখীন হন । সে যুদ্ধে সাধারণ মুসলিমদের সঙ্গে হযরত মোহাম্মদ সাহেব, আবু-বকর, হযরত উমর প্রভৃতি মহৎ ব্যাক্তিগণকে যোগদান করিতে হয় ; আবার সৈণ্য সংখ্যার স্বল্পতা হেতু বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বহু কিশোর বালকগণকেও অস্ত্র ধারণ করিতে হয় । ২৬ শ মন্ত্রে উহারই উল্লেখ করা হইয়াছে ।
উপরোক্ত পরাজয়ের কারণে মক্কাবাসীগণকে ক্ষিপ্ত হইয়া তৎপরবর্তী বৎসরে তিন হাজার সৈণ্য নিয়া ধাবিত হয় এবং ওহোদ নামক পর্বতের পাদদেশে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয় । এই যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল মাত্র সাত শত । এই যুদ্ধে মদীনার বহু মুসলিম নারীও যুদ্ধে যোগদান করেন । ২৪শ মন্ত্রে তৎপ্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে ।
ওহোদ যুদ্ধে মুসলিমগণের কিছূ ক্ষয় ক্ষতি হইলেও চূড়ান্ত ফয়সালা হইল না । সেইজন্য মক্কাবাসীগণ পুনরায় দশ হাজার সৈণ্য বাহিণী নিয়া আক্রমণ করিতে অগ্রসর হয় । তখন মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র এক হাজার । তাহারা এই যুদ্ধে পরীখা খনন করিয়া আত্নরক্ষা করিতে সচেষ্ট হন । ইতিমধ্যে তাহাদের প্রতি ঐশ্বরিক সাহায্য স্বরূপ ঝড়বায়ু আসিয়া বিপক্ষগণের সৈণ্যশিবির সমূহ মুলোৎপাটিত করিয়া দেয় । ৬৫শ মন্ত্রে তৎসম্পর্কে বলা হইয়াছে- "অন্তরীক্ষ লোকে যে রূদ্রগণ আছেন, বায়ুই যাহাদের বাণতুল্য আয়ুধ, তাহাদের প্রতি নমস্কার ।"
উক্ত যুদ্ধে মুসলিম সৈণ্যগনের প্রতি ঐশ্বরিক সাহায্যস্বরূপ বৃষ্টি বর্ষিত হয় । ফলে বিপক্ষের বিরাট সৈণ্য বাহিণীকে পরিচালনা করা কষ্টকর হয় এবং মুসলিম ক্ষুদ্র বাহিণী তৎপরতার সহিত তাহাদেরকে পরাজিত করে । সেই দিকে ইঙ্গিত করিয়া ৬৪শ মন্ত্রে ব্যক্ত হইয়াছে - দ্যুলোকে যে রূদ্রগণ আছেন, বৃষ্টিই যাহাদের বাণতূল্য আয়ুধ, সেই রূদ্রদের প্রতি নমস্কার । কত অপূর্ব মিল !
হযরত মোহাম্মদ সাহেব ও তাহার মুসলিম বাহিনী হইল পৃথিবীর রূদ্র, ৬৬শ মন্ত্রে তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতঃ ব্যক্ত হইয়াছে- "পৃথিবীতে যে রূদ্রগণ আছেন, অন্নই যাহাদের বাণতুল্য আয়ুধ, তাহাদের প্রতি নমস্কার । তাহাদের উদ্দেশ্যে পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ও উর্দ্ধদিকে অন্জলী বদ্ধ করিয়া নমস্কার করি ।"
এই বলিয়া শতাধিক নমস্কার সম্বলিত ১৬ শ অধ্যায় সমাপ্ত করা হইল । আশ্চর্য হইতে হয় যে , এই অধ্যায়ে যত নমস্কার জ্ঞাপন করা হইয়াছে, চারি বেদের কোথাও কারো প্রতি এত শ্রদ্ধা, ভক্তি, নমস্কার জ্ঞাপন করা হয় নাই । পৃথিবীর রূদ্রগণ যে মানব জাতীয় হইবেন, 'অন্নই যাহাদের বাণতুল্য আয়ুধ ' দ্বারা তাহা নির্দ্দেশ করা হইয়াছে ।
-------
সূত্রঃ ---বেদ - পুরাণে আল্লাহ ও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) - ধর্মাচার্য অধ্যাপক ড. বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়, ইসলামী সাহিত্য প্রকাশনালয়, ৪৫, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০.
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:৫৮