অপর জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা গ্রাস করা ও তার ওপর ‘হিন্দু-ছাপ্পা'(Seal) মারার প্রবণতাকে বলে হিন্দু-শোভেনিজম।
এ ধরণের প্রবণতা ব্রাহ্মণ বাবুদের নতুন নয়। শত শত বছর যাবত তাঁরা এ রোগে ভুগে আসছেন। ফলে, কেবল মুছলমানদের নয় তাদেরও আগেকার জৈন, বৌদ্ধ, শৈব, শাক্তদেরও যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও মহান-তা হিন্দুদের-ই 'হিন্দু কীর্তি' বলে, আত্মসাৎ করার এবং সে সবের ওপর ‘হিন্দু-ছাপ্পা' মারার অনেক নজীর দিয়েছেন- ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ। সে আলোকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী শোভেনিজমের দুএকটি উদাহরণ দিব।
ব্রাহ্মণ বাবুরা উদারচিত্ত মুছলিম পীর-দরবেশ, নবাব- বাদশা, উজীর-নাজিরদেরও যে, হিন্দুরা আপন দেব-দেবী বানিয়ে আত্মগৌরব বৃদ্ধির কোশেশ করেছে-তারও ঐতিহাসিক নজীর আছে। আর তা হিন্দুদের নিকট বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য-কত, 'এ- জনম সে-জনমে'র ইতিহাস-পুরাণ লেখা হ'য়েছে-তার ইয়ত্তা নেই। আমরা এবার ড. এস এম ইকরাম লিখিত এরকম একটি নজীর পেশ ক'রছি।
ড. ইকরাম, তাঁর 'আবে কওছর' নামের উরদু বইয়ের প্রথম খণ্ডে কাশ্মীরের এক শ্রেণীর মুছলমানদের পরিচয় দিতে গিয়ে ড. গোলাম মুহিউদ্দীন ছুফী লিখিত "কাশ্মীরের ইতিহাস"-গ্রন্থের বরাত দিয়ে লিখেছেন-কাশ্মীরের ছোলতান, জয়নুল আবেদীনের শাসনামলে... "স্থানীয় ওলী-আউলিয়া এবং ইছলাম প্রচারকদের এমন একটি শ্রেণীর বিকাশ ঘটে”, যাদের হিন্দুরা "ঋষি" ব'লত।... এ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে অধিক খ্যাতি লাভ ক'রেছিলেন শায়েখ নূরুদ্দীন। তাঁকে হিন্দুরা "নন্দ ঋষি" ব'লতো।
এ রকম আরও অনেক ঘটনার মধ্যে-মোগল বাদশাহ্ "মহামতি" আকবরকে হিন্দুরা তো শুধু "অর্জুন অবতার"-ই বানাননি, একেবারে 'বিশ্বেশ্বর' করে ছেড়েছেন। তাঁর হিন্দু নামও রাখা হ'য়েছে। বলা আকবর বাদশার পূর্বজন্মের নাম ছিল 'মুকুন্দ'। তিনি হ'য়েছে- " ছিলেন 'হিন্দু যোগী'। তিনি এলাহাবাদের প্রয়াগ-তীর্থে যোগ-সাধনা ক'রতেন। একদিন তাঁর 'শিষ্য' (আসলে বা'সো বা চাকর) তাঁকে এক গ্লাস গরুর দুধ খেতে দেন। দুধ খাওয়ার পর তিনি মহা আতঙ্কে দেখেন-পাত্রের মধ্যে গরুর একটা পশম, যা তিনি ও তাঁর 'বা'সো' (আবুল ফজল) খেয়াল করেননি। এটা দেখে তিনি নিশ্চিত হন-এই মহাপাপের জন্য তাঁকে জন্মান্তর গ্রহণ ক'রতে হবে। মুছলমান হ'তে হবে। ফলে তিনি 'কামকূপে' গিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। ইচ্ছাপূরণকারী এ-কূপে 'আত্মহত্যাকালে' মুকুন্দ যোগী, জন্মান্তরে- একজন মুছলমান রাজা হবার ইরাদা করেন। আর তার বা'সো বা শিষ্যও আত্মহত্যাকালে চান প্রভুর মন্ত্রী হ'তে। তার-ই পাপ মোচনের জন্য মুকুন্দ হন-শাহানশাহ্ আকবর; আর তার বাসো হন-উজীর, আবুল ফজল।" এখানেই শেষ নয়। আকবরকে "অল্লোপনিষদে” “ম্লেচ্ছদের মধ্যে অতিখ্যাত এবং প্রথম জীবনে 'পাপিষ্ঠ' ও শেষ জীবনে 'মহাত্মা ব'লেও শ্লোক রচনা করা হ'য়েছে।
তাঁদের এই বিশেষ হিন্দু মানসিকতা, হিন্দু শোভেনিজম ও হিন্দু ফ্যানাটিসিজমের কারণে, কেবল ঐ তিন ক্ষেত্রে নয়, সারা উপমহাদেশের আরও অনেক মুছলিম নর-নারী, অলি- আউলিয়া, পীর-ফকীর, কবি-দরবেশ, সেনাপতি, নবাব, ছোলতান, বীর, বাদশাহকেও তাঁরা হিন্দু বংশজ বানিয়েছেন। বানিয়েছেন- যোগী, ঋষি, মুনি, সন্ন্যাসী। দেব-দেবতা। এভাবে হিন্দু চেতনার ছাঁচে ঢালাই ক'রে, হিন্দু গৌরব বাড়াবার বেশুমার নজীর দেয়া যায়।
যাঁরা 'শূন্যপুরাণ' প'ড়েছেন তাঁরা জানেন- রামাই পণ্ডিত হজরত মোহাম্মদ- (দ.)কে 'ব্রহ্মাবতার', আদম-(আ.)কে 'শিব', বিষ্ণুকে 'পয়গম্বর', গাজীকে 'গণেশ', কাজীকে 'কার্তিক'; মুছলিম ফকীর-দরবেশদের 'মুণি-ঋষি', শেখকে—'নারদ', মাওলানাকে 'পুরন্দর' (ইন্দ্র) এবং মুছলিম পদাতিক বাহিনীকে 'চন্দ্র-সূর্য আদি দেব' ব'লে ঘোষণা ক'রেছেন।১৬ শুধু সেকালের রামাই নয়, এ-কালের রামাইরাও মুছলিম পীর, গোরাচাঁদকে বলেন- হিন্দু, মানিক পীরকে বলেন হিন্দু, সত্যপীরকে হিন্দু, লালন ফকীরকে হিন্দু, তানসেনকে হিন্দু।
এদিকে, বাঙালার ছোলতান আলাউদ্দীন হোছেন শাহকে কবীন্দ্র পরমেশ্বর, তাঁর পরাগলী মহাভারতে "ত্রিভুবনপতি" ও "কলিয়ে অবতার" ব'লেছেন। এক-ইভাবে দিল্লীপতি আলমগীর জিন্দাপীর, ইত্যা শাহানশাহ্ আওরঙ্গজেবকে 'রাজা রামচন্দ্র' ব'লে ছায়া মেরেছেন-আর এক হিন্দু কবি কৃষ্ণরাম দাস।
সব থেকে অবাক ব্যাপার; বাঙালা তথা সমগ্র পূর্ব ভারতের গৌরব, মুছলিম বীর কেশরী ভাটি রাজ্যের সেই "ভাটির ঈশ্বর" (শাহান শাহ্) ঈছা খান 'মছনদ-ই- আ'লা কেও হিন্দু সম্পর্কিত করে দেখাবার কম কোশেশ করা হয়নি। অথচ মুন্সী রামচন্দ্র ঘোষের লেখা 'জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানদের ইতিহাসে, ঈছা খানকে কোন এক দাউদ খানের সহোদর বলা হ'য়েছে। দীনেশ চন্দ্র সেন বইটি 'অথেনটিক' এবং 'তাতে লেখা সমন্ত তথ্যই গ্রহণযোগ্য' বলেছেন।
ঈছা খানের তথাকথিত পিতা কালিদাস জাত দিয়ে মুছলমান হবার পরও-তার চরিত্র, আধ্যাত্মিকতা, দান ইত্যাদিতে হিন্দুত্বের গৌরব আরোপ ও তা আকাশ-ছোঁয়া করার জন্য; আর বাঙালার ছোলতান- পরিবারের মর্যাদা নিচু করার জন্য হিন্দু কলমে যে-সব অপচেষ্টা করা হ'য়েছে, তা অতিশয় নিন্দনীয় ও অসংগত। কারণ, সব কথা বাদ দিলেও কালিদাস গজদানী-হিন্দু থাকাকালে, ফি-দিন একটা ক'রে “স্বর্ণগাভী” একজন ব্রাহ্মণকে দান ক'রতেন। এ কেচ্ছা রাজা হরিশচন্দ্রকেও হার মানায়। ঘটনা যদি সত্যই হয়, তবে কালিদাস কর্ত বছর ধ'রে কতজন ব্রাহ্মণকে কি পরিমাণ ওজনের "স্বর্ণগাভী” দান ক'রেছেন, তা কেন জানা যায় না? কারণ, এর কোন ভিত্তি নেই। আসলে "গজদান" হ'ল অযোধ্যার একটা শহরের নাম। তাই 'গজদানী' একটা পদবী মাত্র, যা ইছলাম গ্রহণের পর নামসহ বর্জন করা হয়। তাঁর নতুন নাম হয়-ছোলায়মান খান।
বাঙালায় প্রাচীনকালে আগত পীর-গাজী-কাজী-ছৈয়দ সাধকদের 'হিন্দু' ব'লে দাবি করার নজীরেরও অভাব নেই। হিন্দুরা মুছলিম "পীর বরহক"কে বাঙালা শব্দে "সত্যপীর" ব'লে, তাঁকে বানিয়েছেন "সত্য নারায়ণ”। এ বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন- "সত্যপীরকে সত্য নারায়ণ আখ্যা প্রদান করিয়া এবং ফকীর দাস ইত্যাদি নাম দ্বারা মুছলমান পীর-ফকিরের প্রতি বাঙালী হিন্দু এখনও ভক্তি দেখাইতেছেন।”
ড. সুকুমার সেন "ইসলামী বাংলা সাহিত্যে” "পীর গোরাচাঁদকে" হিন্দুর ঠাকুর' ও 'হিন্দু' ছিলেন ব'লে দাবি ক'রে লিখেছেন-"কুচিৎ হিন্দুর ঠাকুর সম্পূর্ণরূপে মুসলমানের পীর হ'য়ে গেছেন। কিন্তু নাম বদলাননি। যেমন, বর্ধমান ও চব্বিশ পরগণা জেলার পীর গোরাচাঁদ"। ড. শহীদুল্লাহ্ এর প্রতিবাদ ক'রেছেন। তিনি ব'লেছেন, "ইহার কোন প্রমাণ নাই।" [বোন বিবির জহুরানামা ও আঠার ভাটির ইতিহাস ১ম সংস্করণ, পৃষ্ঠাঃ ২৬,২৭,২৮]
ভারতীয় লেখক-গবেষক পরমেশ চৌধুরী তার ‘আর্যজাতির অস্তিত্বই ছিল না’ বইয়ের নিজের কথা কম করে বলে বেশিরভাগ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন ইউরোপীয় পণ্ডিতদের বরাত দিয়ে। বইয়ের এক জায়গায় পরমেশ বাবু লিখেছেন- “[আরবে] সেমিটিক জাতি এসেছিল পূর্বদেশ থেকে। আব্রাহাম [সেমিটিক নবী ইবরাহিম- লেখক) ছিলেন মানবধর্মের উৎসভূমি কাশ্মীরের বাসীন্দা। তিনি সেখান থেকেই পাড়ি জমিয়েছিলেন প্যালেস্টাইনে।... ইহুদি ধর্ম হলো আদিম ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরূপ মাত্র। ব্রাহ্মণ্যধর্মই স্বাভাবিক ও সনাতন ধর্ম। আব্রাহাম হলেন ব্রহ্মা। লেখক পরমেশ চৌধুরী অতঃপর, ইউরোপীয় পণ্ডিতদের বরাতে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন পৃথিবীর প্রাচীন সংস্কৃতি এবং ধর্ম প্রভৃতির উৎস ভারতবর্ষ। মোজেস বা মুসা ছিলেন একজন ধর্মত্যাগী ভারতীয়। আর মহম্মদ ছিলেন একজন ভণ্ড বা প্রতারক।' [আত্মবিস্মৃত বাঙালি (৪র্থ সংস্করণ) পৃষ্ঠাঃ ১৬৯-৭১]
ঢাকার বদ্বীপ প্রকাশনার প্রকাশনায় শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চলের ‘আর্যজন ও সিন্ধুসভ্যতা’ বইয়ে বিকৃত ইতিহাসের এক উৎকৃষ্ট নমুনা পাওয়া যায় যা হিন্দু শোভেনিজমের জ্বরে আক্রান্ত। এই বইয়ের এক জায়গায় বলা হয়েছে “বাইবেলের এদন (Eden > Edn) সংস্কৃত উদ্যানের রূপান্তর হওয়া সম্ভব। সংস্কৃত উদ্যান শুধু বাগিচা নয়। রাজকীয় বাগিচাকেও উদ্যান বলা হয় অর্থাৎ রাজ-বাগিচা। বাইবেল অনুসারে আদম-হাওয়া সৃষ্টির পর ঈশ্বর তাদেরকে এদনে স্থান দিয়েছিলেন। সংস্কৃত মৎস্য শব্দের সঙ্গে মোশি (মুসা) নামের সম্পর্ক থাকতে পারে। মোশির (মুসার) ভাই এবং তার অধীনে প্রধান যাজক হারোন (হারুন) বৈদিক দেবতা বরুনের রূপান্তর হিসেবে অনুমান করা যায়। বাইবেলে আব্রাহাম (আরবী ইব্রাহীম)-এর পূর্বনাম আব্রাম বলা হয়েছে। এটা সংস্কৃত অপরাম থেকে হওয়া সম্ভব। আদম নামও প্রথম মানুষ বোঝাতে আদিম মনু থেকে আসতে পারে। ভারতবর্ষের পুরাণ-কথায় মনু বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। মহাপ্লাবনের সময় মনু তার নৌকায় রক্ষা লাভ করেছিলেন। আমরা অনুমান করি এই মনু উপাখ্যান থেকে বাইবেলের নোয়া (নূহ) উপাখ্যানের উৎপত্তি। সম্ভবত মনুর নৌকা হিব্রু উপাখ্যানে নোহ-তে নোয়া পরিণত হয়েছে।“ [আত্মবিস্মৃত বাঙালি (৪র্থ সংস্করণ) পৃষ্ঠাঃ ১৭২-৭৩]
যাহোক, এভাবে সেন-শাস্ত্রী মহাশয়ান ও তাঁদের মুছলিম শাগ্রেদান বিনা প্রমাণে, শুধু ধারণার ওপর আস্থা রেখে বলেন-গোরাচাঁদ হিন্দু, মানিক পীর হিন্দু, সত্যপীর হিন্দু, তানসেন হিন্দু, লালন ফকীর হিন্দু, এরপর না জানি কবে দাবি ওঠে নজরুলও ছিলেন হিন্দু। তাঁর আসল নাম ছিল 'অর্জুন'। কেননা হিন্দু ব্যাকরণের 'নামাভাস'-সূত্রানুযায়ী নজরুলের 'অর্জুন' হওয়া অতি স্বাভাবিক। তাই মুছলমানরাই যে অর্জুন নামটা 'নজরুল' ক'রে হিন্দুর গৌরব আত্মসাৎ ক'রেছে, তাতে আর সন্দেহ কী! এমন গবেষণা ভবিষ্যতে হ'তেই পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির বানানো কিংবা তাজমহলকে হিন্দু মন্দির দাবী করা এই হিন্দু শোভেনিজমেরই উদাহরণ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৯:৩৬