ব্রিটিশ শাসিত বাংলাতে ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে জানা গেল চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পাবনা ও রাজশাহী জেলায় মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৭০ জনের বেশি, এই হার বগুড়াতে শতকরা ৮০ জনেরও ওপরে। এখানে উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের শাসনকেন্দ্র মুর্শিদাবাদে মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৫০ জনেরও কম ছিল। দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের এই বিশাল মুসলমান জনগোষ্ঠী কোথা হতে এলো? কখন এলো? আর কীভাবেই বা এলো? এসব প্রশ্নমালা শিক্ষিত সমাজে - একটা ব্যাপক বিতর্কের সূত্রপাত করল যা আজ পর্যন্ত আমাদের মাঝে জারি আছে।
বাঙালি জাতির পরিচয় নিয়ে সেই বিতর্কে সর্বপ্রথম অংশ নেন আদমশুমারির প্রধান সরকারি কর্মকর্তা হেনরি বেভারলি নিজেই। বাংলায় মুসলমানদের শাসন কেন্দ্রের বাইরে কীভাবে এত মুসলমান আসল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেভারলি বলেন, 'মুঘল রক্ত নয়, বরং নিম্নবর্ণের অধিবাসীরা হিন্দুধর্মের কঠোর বর্ণপ্রথা থেকে ইসলামধর্মে কনভার্ট করেছে।' এরপর কট্টর হিন্দুত্ত্ববাদী বঙ্কিমচন্দ্র তার এক অযৌক্তিক প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসচর্চার যে পদ্ধতিগত এবং তত্ত্বীয় মডেল দাঁড় করিয়ে গেছেন, তা অদ্যাবধি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসচর্চার মূলধারার অভিমুখ নির্ধারণ করে। আমাদের জাতীয় ইতিহাস চিন্তার আলাপে ‘বহিরাগত বিজয়ী জাতির সংস্কৃতি গ্রহণ/বর্জন করা', “বিজয়ী-বিজিত সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়' ইত্যাদি অনুমানের মাধ্যমে আর্য জাতির সাথে অনার্যদের মিশে যাওয়া, অথবা অনার্য বা শূদ্রবর্ণের হিন্দু জনগোষ্ঠীর মুসলমান হিসেবে ধর্মান্তরিত হওয়ার অনুমান বঙ্কিমচন্দ্রের পদ্ধতি ও তত্ত্বেরই ধারাবাহিকতা।
বঙ্কিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আহমদ ছফা লিখেছেন পক্ষপাতদুষ্ট, বহুল পঠিত বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধ। প্রকৃতপক্ষে, ছফার জবানে বাঙালি মুসলমানের যে বয়ান পাই তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী লেখকদের (যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র, যদুনাথ, রমেশচন্দ্র প্রমুখ) হাতে বলে ঐতিহাসিক এবং সাহিত্য সমালোচকরা একমত"। হিন্দুত্ববাদী এই বয়ানের সারকথা হলো - বাঙালি মুসলমান আদতে নীচুজাতের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত, গ্রাম্য, খ্যাত, অতীতের কুসংস্কার আঁকড়ে থাকা একটা পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যার প্রধান কাজ হলো মধ্যযুগের ইসলামে আশ্রয় নিয়ে আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত হিন্দু বাঙালির বিরোধিতা করা। অথচ সেইসব হিন্দুর অধীনতার মাধ্যমেই যে তারাও আধুনিক হয়ে উঠবে, প্রগতির পথে চলবে, কুসংস্কার থেকে মুক্তি অর্জন করবে এই সত্য না-বোঝার মতো মূর্খ, বেআক্কেল। দাড়ি-টুপি আর হিজাবের প্রতি প্রগতিশীলদের যে ঘৃণা, মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকরির বাজারে যে বৈষম্য, এসবের মূলেও এই একই বয়ান যে, বাঙালি মুসলমান অতীতমুখী, আধুনিকতা-বিরোধী, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিমুখ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু তথা সাম্প্রদায়িক। বাংলা-বিভাগের (এমনকি ভারত বিভাগেরও) দায়ও এজন্যই বাঙালি মুসলমানের। স্বদেশী আন্দোলন (অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন) এজন্যই প্রগতিশীলতার অভিমুখী আন্দোলন যার মধ্যে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম, আর সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক জাতীয় বীর ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন আর প্রীতিলতা
.
বাঙালি মুসলমান নিয়ে প্রচলিত ইতিহাস কোনো ঐতিহাসিকের গবেষণা থেকে আসেনি, আর পরবর্তীতে না কোনো ঐতিহাসিকের গবেষণা একে সঠিক হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে! উল্লিখিত প্রবন্ধ আর বই দুটোর রচয়িতাদের কারোই ইতিহাস গবেষণায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছিল না। হরহামেশাই যাদের এ সংক্রান্ত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের প্রায় সকলেই হয় বাংলা সাহিত্যে বা দর্শনে এমনকি পদার্থ বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে রচনা করে চলেছেন বাঙালি জাতির ইতিহাস! অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ে ইতিহাস গবেষক হিসেবে খ্যাতিমানরা আছেন ইতিহাসের অন্যান্য বিষয় নিয়ে। অর্থাৎ, জাতির এবং ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মূলধারার ইতিহাস চর্চা চলছে ইতিহাস। গবেষণায় প্রশিক্ষণবিহীন গবেষক-লেখকদের হাতে।
এই বিষয়টা অনেকটা হাসপাতালের চিকিৎসার কার্যক্রম ডাক্তারিবিদ্যাবিহীন পদাধিকারীদের হাতে ফলাফল হওয়ার দাবি ছেড়ে দেওয়ার মতো। ফলাফল যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। সেই ১৮৮১ সালে সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখে গেছেন, বাঙালি মুসলমান নিশ্চয়ই নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। আমরা দেখছি ১৪০ বছর পরে এসেও আমাদের বর্তমান বুদ্ধিজীবীরা তথ্যবিহীন সেই তত্ত্বেই ঈমান রেখে বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসচর্চা এবং সেই অনুযায়ী আমাদের জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করে চলেছেন। কিন্তু কেন? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়ে প্রথমে মুসলমানের জাতিরাষ্ট্র পাকিস্তান তারপর বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও কেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী একজন সাহিত্যিকের কল্পিত ধারণাকে যথাযথ একাডেমিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয় না? কেন ইতিহাস গবেষণায় প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও পদ্ধতিগত উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষকদের দিয়ে বাঙালি মুসলমান জাতির উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস রচিত হয় না?
ইতিহাস গবেষণা একটা পেশাদারি (professional) কাজ, যা যথাযথভাবে করতে গেলে সুনির্দিষ্ট দক্ষতার (expertise) প্রয়োজন হয়। আমরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে যেমন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে না গিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই, তেমনি ইতিহাস জানার জন্যও যেতে হবে উপযুক্ত ট্রেনিং নিয়ে পেশাদার হিসেবে স্বীকৃত ঐতিহাসিকের কাছে। আর এসব ট্রেনিং হতে হবে দক্ষ ঐতিহাসিকের তত্ত্বাবধানে উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণার মাধ্যমে। পল্লি- চিকিৎসক দিয়ে ওষুধের ফার্মাসি, বড়জোর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজ চলে। কিন্তু রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ স্বাস্থ্যসেবার জন্য অন্তত এমবিবিএস পাশ করতেই হয়। অনুরূপভাবে ইতিহাস চর্চায় যোগ্য লোকের দরকার।
দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চার কাজটা তুলে দেওয়া হয়েছে অপেশাদার ঐতিহাসিকদের হাতে। যেমন, ডেইলিস্টার-প্রথম আলো গ্রুপের প্রকাশিত সৈয়দ আবুল মকসুদের উল্লিখিত বইটি। এর মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করা যায় দুই শব্দে – ভিকটিম ব্লেমিং, অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তিই অপরাধী, আক্রমণকারী না। এই গ্রুপ আগেও এমনি করে গোলাম মুরশিদকে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস' নামের একটা গোঁজামিলে ভরা ইতিহাস বইয়ের জন্য পুরস্কৃত করেছে। “বাংলা একাডেমি' থেকে প্রকাশিত পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় কুমার রায়ের লেখা ‘আদি বাঙালি: নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭)’- একই ধারার বই, যেখানে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের কোনোরূপ সংজ্ঞা ছাড়াই বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসের আলোচনা করা হয়েছে। একইভাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। উচ্চতর পর্যায়ে সমাজ, সংস্কৃতি বা ইতিহাস বিষয়ে এদের কারোরই তত্ত্বীয়, পদ্ধতিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং গবেষণা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পদ আর বাংলা গদ্য-লেখায় পারদর্শিতা ছাড়া তাদের আর কোনো দক্ষতা নেই উল্লিখিত বইগুলো লেখার জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সেগুলো গ্রহণযোগ্য জ্ঞানের স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ, একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেই দেখা যায় যে, এসব লেখা গোঁজামিলে ভরা। আর উল্লিখিত বিষয়ে সত্যিকার পেশাগত দক্ষতা থাকলে সুনির্দিষ্ট করেই চিহ্নিত করা যায় এসব রচনার মধ্যকার তত্ত্বীয় এবং পদ্ধতিগত ভুলভাল যার খানিকটা উপরে আলোচনা করেছি।
বঙ্কিমের এই ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বের হতে না- পারলে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের সঠিক পাঠ অসম্ভব। ফলে ৯০% ভাগ বাংলাদেশি নাগরিক তথা বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয় নির্ণয় এবং তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করাও অসম্ভব। বঙ্কিমের ধারায় পদ্ধতিগত নানান মৌলিক সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। এসবকে সংশোধনের মাধ্যমে অধিক গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ পদ্ধতিতে ইতিহাসচর্চা করতে হবে। কিন্তু একইসাথে বঙ্কিমের তত্ত্বের মধ্যে আর্যরক্তের ভিত্তিতে বাঙালিত্ব নির্ণয় করার অনুসিদ্ধান্তকেও অতিক্রম করতে হবে।
.
অসীম রায়ের গবেষণা থেকে জেনেছি যে, পূর্ববাংলার এই গ্রামীণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নিম্নবর্গের থেকে ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত হয়নি, আবার বাইরে থেকে মাইগ্রেট করেও আসেনি। এদের জন্ম এই বাংলার মাটি-আলো-বাতাসের মধ্যেই। এই অঞ্চলে নতুন জেগে ওঠা পাললিক চরাঞ্চলে জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ বিস্তারের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এই জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে স্থানীয় নিম্নবর্গের আদিবাসী তথা কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, বনবাসী, নৌকাবাসী এবং অনুরূপ অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে। প্রাথমিক পর্যায়ে এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কবরে মাজার বা খানকাহ প্রতিষ্ঠা হলে কালক্রমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তারা পীর হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরও পরের ধাপে মুসলমান সাহিত্যিকরা সাংস্কৃতিক দূতিয়াল হিসেবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবির্ভূত হন এবং আরব-ইরানের ইসলামের সাথে এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পার্শ্ববর্তী হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে যা উদীয়মান এই মুসলমান কৃষকসমাজের সাথে অভিজাত নগরবাসী মুসলমান সমাজের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেন।
এই মুসলিম সমাজের সূচনা হয়েছে নিম্নবর্গের আদিবাসী তথা কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, বনবাসী, নৌকাবাসী এবং অনুরূপ অন্যান্য জনগোষ্ঠীসমূহ থেকে। অর্থাৎ, এই মুসলমান সমাজ বাংলার বাইরে থেকেও আসেনি, আবার স্থানীয় নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকেও ধর্মান্তরিত হয়নি। আর এই সমাজে পীর হিসেবে পরিচিতরাও মূলত সুফি দরবেশ ছিলেন না। বরং তারা ছিলেন দুঃসাহসী ও অগ্রবর্তী কিছু মুসলমান। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব থাকলেও অধিকাংশই ছিলেন সমাজনেতা, যারা জলা-জংলার মধ্য থেকে কৃষিজমি বিস্তারের পাশাপাশি উদীয়মান কৃষকসমাজে সামাজিক শৃঙ্খলা, কর্তৃত্ব ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নেতৃস্থানীয় বিশেষ ব্যক্তিকে পীর হিসেবে বরণ করার পাশাপাশি স্থানীয় জনতা তার কর্মক্ষেত্রে খানকাহ (আশ্রম/আখড়া) আর মৃত্যুর পর কবরের ওপর দরগাহ বা মাজার গড়ে তোলে, যা উদীয়মান সমাজের স্নায়ুকেন্দ্র হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জাগতিক, ধর্মীয় ও মানসিক নানাবিধ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
.
বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন
হাসান মাহমুদ
[অবশ্যই পাঠ্য একটি বই]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ সকাল ১০:৩০