ইনা সিগারেট ফুকে ধোয়া গুলো উপরে ছেড়ে দিচ্ছে। অবশ্য সিগারেটে আগুন ধরানোর আগে ভদ্র ভাবে আমাকে বলেছিল “ধোয়া টানার অভ্যাস আছে জনাব?” আমিও একটু চুপ করে থেকে ভদ্র ভাবে বললাম “জ্বী না। আমার মা পছন্দ করে না। যদিও আমার আব্বাজান এটা খেতেন। লুকিয়ে লুকিয়ে খেতেন। যেদিন মা দেখে ফেলতেন বা বুঝে ফেলতেন সেদিন বাবাকে রুমে জায়গা দিত না। সেদিন বাবা আমার সাথে ঘুমাতো। সকাল হলে মা আমাকে প্রত্যেক বার বলতো হারামজাদাটাকে তোর সাথে থাকতে জায়গা দিছিস কেন? আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকতাম। কিন্তু আমার মা নাস্তা খাওয়ার সময় আমার বাবাকে ঠিকি বলতেন একা থাকতে কষ্ট হয়েছে? আর সিগারেট খাবা না ঠিকাছে? কিন্তু বাবা খেতেন।” ইনা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। এই রাতের আলোয় তার হাসিটা কেমন দেখায় আমি নিজেও বুজতে পারি না। হাসিটার মাঝে কি যেন একটা আছে। মানুষের ভিতর থেকে যখন আনন্দ বা ভালো লাগাটা বের হয়ে তার মুখে ফুটে উঠে এই দৃশ্যটা দেখতে আমার নিজেরই কেন যেন ভালো লাগে। সে হাসতে হাসতেই বললো “আপনাদের এই ভালোবাসার কথা শুনলে আমার শরীর জ্বলে বুঝলেন? মনে হয় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছেন। আমার শরীরে এমন নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য আপনাকে এখন লাথি দিয়ে তাড়ায় দিতে ইচ্ছে করছে।” আমি চুপ করে থাকি। সে কি সুন্দর করে সিগারেট ফুকে ধোয়া গুলো চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে অনুভূতি তৈরি করছে। মেয়ে মানুষের আবার কেমন অনুভূতি হবে? মেয়ে হোক আর ছেলে হোক তারচেয়ে বড় কথা ও একজন মানুষ। মানুষ হিসেবেই এই অনুভূতিটা নিজের মাঝে তৈরি করে নিচ্ছে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম “এখন মা রাগ করে না। কাউকে কিছু বলে না। যাকে বলবে সে মানুষটা নেই। ” আমি বুঝতে পারলাম ইনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে মাথাটা তুলে ওর দিকে তাকাই। ও সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে অর্ধেক খাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলে “মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আচ্ছা আপনি কি চান বলেন তো? আমাকে কোন ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছেন আল্লাই জানে। মজা নিতে আসছেন। মজা নিয়ে বিদায় হবেন। তা না করে আমার মাথাটা নষ্ট করতেছেন মিয়া। আর আমিও না একটা পাগল তা না হলে আপনার সাথে আসি কি করে?” এই রাতের বেলা রেল স্টেশনে ইনার পাশে বসে বসে মশার কামড় খাওয়া আর গালি শোনা কোন দরকারি ছিল না। আজকে আমার মনটা একদমি ভালো না। সারাটা দিন আমার কেমন যেন কেটেছে। সন্ধ্যা বেলা আমার বন্ধু মিরাজের সাথে যখন দেখা হলো তখন বললো “আজকে একটা মজার ঘটনা ঘটছে জানিস? পাঁচহাজার টাকা ধান্দা হইছে। অবশ্য কি করে ধান্দা করছি এইটা তোরে বলা যাবে না। তুই কি কিছু খাবি? তোরে কোন দিনও কিছু খাওয়াতে পারিনা। তোর বাসায় গেলে আন্টি আমাকে কি যত্ন করেই না এটা ওটা খেতে দেয়। আমার তখন অনেক কান্না পায়রে। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার মাকে আমি খুইব কইরা ঘেন্না করি এটা তুই ভালো করেই জানিস। কিন্তু এটাও জানি সব মা এক রকম হয় না। তোরে মন থেকে আজকে খাওয়াবো চল।” আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ছোট বেলা ওর যখন চার বছর তখন ওর মা বিয়ের আগের প্রেমিকের সাথে চলে যায়। ওর বাবা পরে আর একটা বিয়ে করে। অবশ্য সৎ মা ওকে প্রথম প্রথম আদর করলেও পরে খুব নানা কারনে মারতো। তারপরে মিরাজ ওর নানির কাছে বড় হয়। ও আমাকে প্রায় বলে জানিস দোস্ত আমার একটা ইচ্ছা আছে কোন একদিন এই মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। তাকে জিজ্ঞেস করবো কেন এমনটা করেছে? এমন কাজটা করার আগে একবারো আমার মুখটা আপনার চোখে ভাসে নাই? এই কাজটা করার আগে আপনার বুকটা কেপে উঠে নাই? ” আমার মন খুব খারাপ। আমি খুব শান্ত ভাবেই বললাম “দোস্ত মন ভালো নাই” মিরাজ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে “নিলা তোর সাথে আজকে কিছু করছে তাই না? তোরে বেটা আগেই বলছি এই মাইয়া সুবিধার না। শালী একটা খারাপ। এই মাইয়ার লাইগা তুই এতো কষ্ট পাস কেন আমি এটা ভাইবা বুঝি না। বেটা আমাকে দেখ এসব মেয়ে ছেলে আমার কাছে কোন দাম নেই। পুরুষ মানুষ একটা মেয়ের জন্য মন খারাপ করবে এটা ভাবতেই তো আমার ঘেন্না পায়। তুই না আমার বন্ধু। আমার সাথে চইলা তুই কিছু শিখতে পারস না?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। একটু চুপ করে থেকে ওর গালে একটা থাপ্পড় মেরে বলছিলাম “ওকে খারাপ বলবি না খবরদার।” আমার বন্ধু আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি বললাম “ওর শিউলি ফুল অনেক পছন্দ জানিস। আজকে সকালে ওকে ভার্সিটিতে আমি শিউলি ফুল দিয়েছিলাম। ও নিয়েও ছিল। আমার খুব ভাল্লাগছিল জানিস এইটা ভেবে যে আমার দেওয়া ফুলটা নিয়েছে। কিন্তু মিনিট দশেক পর দেখলাম ও আমার দেওয়া শিউলি ফুলের মালাটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ব্যাপারটায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি খুব। এমন কেন করলো? ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য কি আমার দেওয়া ফুলটা নিয়েছিল? আমার অবহেলা বিষয়টা একদমি ভাল্লাগেনা। আমি কেন যেন এটা মেনে নিতে পারি না।” এরপর মিরাজ বসা থেকে উঠে আমাকে বললো “আমার সাথে চল। আমার সাথে গেলে এইসব আউল ফাউল চিন্তা মাথায় আসবে না। কি সব বালছাল নিয়া মন খারাপ করস। তোর মন ভালো হয়ে যাবে চল।” তারপর ও জোরমূলক ভাবেই ইনার কাছে নিয়ে এসে বলে “আমার বন্ধুটার মন খারাপ তাই তোমার কাছে নিয়া আসছি।” ইনা একটু হেসে মিরাজকে একটা গালি দিয়ে বলেছিল “শুয়রের বাচ্চা, তোমাগো শুয়র যখন চেইতা যায় তখন আমাগো কথা মনে পড়ে। তোমরা শুয়রের বাচ্চা সবি এক দলের” আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। মিরাজকে বললাম এসব কি বলছে?” মিরাজ আমাকে আকুতি মিনতি করে বললো “দোস্ত তুই একটু থাক আমি আসতেছি। কোন ব্যাপার না। মাইয়া ভালো কিন্তু মাঝে মইধ্যে ঝাল মরিচ হইয়া যায়।” কিন্তু মিরাজ আসেনি। আমি কিছুক্ষন ইনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইনা আমাকে নানা ভঙ্গিতে ইশারা করে বললো “নতুন তাই তো?” আমি কিছুই বলিনি। পরে একটু চুপ করে থেকে বুঝালাম “দেখেন আমি এরকম না। আমি জানতমই না আমাকে এখানে নিয়ে আসবে। আমি একটু বসতে পারি? কিছুক্ষন পরই চলে যাবো। কিন্তু জানেন সত্যিই আমার মনটা খারাপ।” ইনা আমার দিকে চুপ করে কেমন একটা চোখে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষন বসার পর আমি কেন যেন ইনাকে বললাম “আপনার সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে পারি? কিন্তু এখানে আমার খুব অস্বস্থি লাগছে।” তারপরই ইনা কি মনে করে যেন আমার সাথে বাহিরে বের হয়েছে। আমার সাথে কেন বের হলো আর আমি কেনই বা এমন কথা বললাম আমি জানি না। রাতের জোৎস্নামাখানো আলোটা যখন ওর শরীর ছুয়ে দিল আমার কেন যেন খুব মায়ামায়া লাগছিল। আমি অনুধাবন করলাম এমন মায়ামায়া মেয়েটা কেন এমন হলো? কিন্তু আমার মাথায় কিছুই আসে না।
আমি ইনার সাথে এই রেল পথের মাঝখানে খুব শান্ত মনে হাটছি। একটা অচেনা অজানা মেয়ের সাথে। ব্যাপারটা কি সুখর? ইনা আমাকে বললো “আমার না মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয় কারও সাথে এইভাবে হাটতে। চোখে চোখ রাখতে। একজন মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচতে। নিশ্বাস নিতে। এই সুন্দর পৃথিবীর মাঝে একটা অসুন্দর মন নিয়ে পৃথিবীর অদ্ভুত রুপ দেখতে আমার একদম ইচ্ছে করে না জানেন। পৃথিবীর সৌন্দর্য যখন দেখি তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। মনে হয় এই দেখার অধিকার আমি রাখি না। আজকে আপনাকে দেখে আমার কেমন যেন লেগেছে। স্কুলে থাকতে আমি খুব চাইতাম একজনকে। খুব ভালোবাসতাম। আপনি দেখতে ঠিক তার মত। আপনাকে দেখে আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠেছে।” আমি ইনার দিকে তাকাই। মেয়েটার চোখে জল। আমি ইনাকে বলি “জীবনটা এমন কেন হলো?” ইনা চোখের জল মুছে হাটতে হাটতেই বললো “অন্যদিন শোনাব হ্যাঁ? আমি জানি যদিও আপনি আর আসবেন না।” আমি ইনাকে একটা ভরসা দিয়ে বললাম “আমি অবশ্যই এসে আপনার পাশে আবার হাটবো।” ইনা শুধু তার মায়ামায়া চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি আর কিছু বলিনি।
সকাল বেলা আমি ঘুমের মাঝে আচ করতে পারলাম আমার মুখের উপর পানির ফোটা টুপ টুপ করে পড়ছে। যখন চোখ খুললাম আমি দেখলাম মা আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না করছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে বললাম “কিছু হয়েছে? কান্না করছো কেন?” মা কিছু বলে না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম “আজকেও ঘুমাওনি তাই না? বাবা ঘুমের মাঝে এসে তোমাকে বিরক্ত করে?” মা কান্না করতে করতেই বললো “তোর বাবা প্রতিবার আমার ঘুমের মাঝে এসে বলে “জাহেদের মা আমার একদম একা ভাল্লাগেনা এখানে। মানুষটা আমাদের ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি গেলো কেন? তোর বাবা আমায় ঘুমের মাঝে প্রায় ডাকে চল যেতে।” এই মুহুর্তে আমার কি বলা উচিৎ আমি জানি না। আমার ভিতরটা কেমন করে উঠে। আমি মাকে জড়িয়ে কান্না করতে করতে বলি “আমারও এখানে ভালো লাগে না। একদম ভাল্লাগেনা মা। এই শহরটা কেমন যেন বিষন্ন টাইপের। শহরটার মাঝে তাকালে আমি নিজেকে খুজে পাই না। শহরটা কেমন যেন অপরিচিত মনে হয়। কিছুদিন পর খালার বাসায় গিয়ে ওখানের আলো বাতাস নিজের মাঝে মাখিয়ে আনবো।
ভার্সিটির ক্যান্টিনে নিলার সাথে দেখা হতেই আমি একটা বোকা টাইপের হাসি দিয়ে বললাম “ভালো আছো?” সে মাথা নেড়ে বুঝালো ভালো আছে।আমি ওকে আর কিছু বলি না। ও জানে আমি আর কিছু বলবো না।এই সময়টায় ও ক্যান্টিনে আসে।কিছু খায় গল্প করে। আর আমি গাধার মত চুপ করে অন্য আরেকটা সিটে বসে চা খাওয়ার অযুহাতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার ভালো লাগে ওকে দেখতে ভীষন ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ও যখন হাসে কি চমৎকার লাগে ওকে। ও হাসলে ওর ছোট ছোট চোখ গুলা বন্ধ হয়ে যায়। এমনটা আমি শুধু ওকেই দেখেছি। আমি তখন উদ্ভেগপূর্ণের মত ওর চোখের পাপড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার তখন মনে হয় পৃথিবীটা অনেক সুন্দর অনেক।এই সুন্দর পৃথিবীর ঝকঝকে নীল আকাশটায় বৃষ্টিরা খেলা করে পথ ঘাট নদীর মাঝে নেমে পড়ে।আমার তখন ইচ্ছা হয় টুপ করে নদীর মাঝে ঝাপিয়ে পড়ি।এসব ভাবতেই আমার ভিতরে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে। আমি যেই আরেক সিটে গিয়ে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে খাবো আর ওকে দেখবো তখন ও ডাক দিয়ে বললো “জাহেদ শুনো।” আমি ওর কাছে গিয়ে আরেকটা বোকার মত হাসি দিয়ে বলি “কিছু বলবে?” ও একটু সময় নিয়ে বললো “একটা কথা বলি কিছু মনে করো না হ্যাঁ? তুমি জানো আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।আমাকে রোজ মটর সাইকেল করে ভার্সিটিতে দিয়ে যায় আবার নিয়েও যায় সব কিছু তুমি জানো কিন্তু তারপরও আমাকে এমন করে কেন চাও? যদিও তুমি কখনো বলোনি।কিন্তু আমি বুঝি। তুমি জানো আমার খুব খারাপ লাগে।তোমাকে যখন আমি অবজ্ঞা করি, দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে চলি কিন্তু পরে আমি খুব অনুতপ্ত হই।আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়।তোমার চাওয়াটা অনেক দামী। তা না হলে আমার এমন খারাপ লাগার কথা না। আমার একদম ভাল্লাগেনা।” আমি কি বলবো বা আমার কি বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারিনা।আমার জন্য কি সত্যি নিলার মন খারাপ হয়? আমি চাইনা কখনো আমার জন্য তোমার মন খারাপ হোক এবং চাইতামও না।আসলে আমারই দোষ এসব জানা সত্ত্বেও আমার কেন তোমাকে ভালো লাগে? কেন আমার মাঝে তোমাকে নিয়ে ভালো লাগা তৈরি করতে হবে। এই ভালো লাগাটা খুব অন্যায়। আমি খুব দুঃখিত নিলা।আমি আর কখনো তোমার সামনে আসবো না।এমন করে তাকাবোও না।যদি কখনো তোমার সামনে ভুল ক্রমে চলে আসি নিজেই নিজেকে সাবধান করে দিব। আমি নিজেকে ভিতরে ভিতরে স্বাভাবিক করে এইটুকুই বললাম “আমি কি পাগল? অন্যের জিনিসের দিকে নজর দিব? এমন জোকস করো না কেমন?” এটা বলেই আমি চলে আসি।আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।আমার আকাশটায় তখন বৃষ্টি নামে আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টি।আমার এই বৃষ্টিকে দেখা যায় না।শুধু নিঃশব্দে ঝিড়িঝিড়ি করে বুকের ভিতর টুপটুপ করে পড়ে।
চারদিন পর মিরাজ আমার সাথে দেখা করে বললো “দোস্ত আমার মায়ের ঠিকানা বহু কষ্টে পেয়েছি। যাবি আমার সাথে সিলেট শহরে?” আমি ওকে না করিনি। ওর চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছি ও কি রকম ছটফট করছে। তার মনে জমানো কত প্রশ্ন। এই প্রশ্ন গুলো যেন ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে চায়। বলতে চায় কাউকে তার ভিতরের জমানো রাগ/অভিমানের কথা গুলো। রাত্রি ঠিক দুইটা বাজে। ট্রেনের ঝকঝক আওয়াজে আমার ঘুম আসে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুরো শহরটাকে যেন আধাঁরে ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকি। সবুজ বাতি জ্বলতে থাকা পোকা গুলোকে দেখি। ওদের এমন জ্বলতে থাকা দেখে আমার নিলার কথা মনে পড়ে। এই মেয়েটাও সারাক্ষণ আমার মাথার মধ্যে এইভাবে জ্বলতে থাকে। এসব ভাবতে ভাবত কখন যে ভোরের নিভো নিভো আলো আমার চোখে এসে পড়লো বুঝতে পারলাম না। মিরাজ বললো “দোস্ত সারা রাত একটুও ঘুমাইনাই। তুইও ঘুমাস নাই আমি খুইব কইরা খেয়াল করছি। নিলা মেয়েটারে অনেক ভালোবাসিস তাই না?” আমি এই কথার কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “চল নামি” তারপর কয়েকজন মানুষকে ঠিকানার কথা জিজ্ঞাস করাতে ওরা কি বললো আমরা কিছুই বুঝলাম না। শুধু হাত দিয়ে যে ইশারা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল সেটাই বুঝেছিলাম। মিরাজের মায়ের বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে সকাল ৯টা বাজে তখন। বাড়িটার দিকে আমরা দুজনে খুব তাকিয়ে আছি। চারপাশে ওয়াল করা আর টিনের চাল। বাড়ির সামনে একটা উঠোন। উঠানের চারপাশে বাউন্ডারি। উঠোনের ঠিক উত্তর দিকে একটা বারো কি তেরো বছরের মেয়ের চুলে একজন মহিলা বেনি করে দিচ্ছে। মিরাজ তা দেকে একটু কেপে উঠে আমাকে বললো “দোস্ত আমাকে একটু ধরবি?” আমি মিরাজকে শক্ত করে ধরে বলি “তুই এখানে থাক। আমি সামনে গিয়ে কথা বলে একটু দেখি। তোর এভাবে সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।” উনার সামনে গিয়ে আমি একটু দাঁড়িয়ে থেকে সালাম দিয়ে বললাম “আমি অনেক দুর থেকে আসছি। আমরা দুজন এই শহরটায় নতুন। আমার বন্ধু বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছে। জাফলং যাবার পথটা কোনদিকে বলতে পারেন? পথ গুলিয়ে ফেলেছি। অনেকটা ভিতরে চলে আসছি। “উনি এমন কথা শুনে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর মেয়েটার দিকে একবার তাকালো। তারপর উনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কোন দিকে দিয়ে যেতে হবে। আগে কোথায় যেতে হবে। আমি বললাম “এই কথাটা কি আপনি আমার বন্ধুটাকে একবার বলবেন? সে আমার কথা বিশ্বাস করে না।” আমি জানি এই রকম করে বলাটা একদম ঠিক হয়নি। কিন্তু উপায় ছিল না। উনার মেয়ে বাসার ভিতরে চলে যায়। মিরাজের সামনে এসে উনি কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন। মা ছেলের অভিমানের এই ঝড়ের মাঝে আমার থাকতে ইচ্ছে করছে না। তবুও আমি একটু দুরে দাঁড়ালাম। যেই উনি কিছু বলতে যাবে মিরাজ কেমন করে যেন তাকিয়ে বললো “আপনি হয়তো আমাকে চিনবেন না। যাকে এইভাবে ফেলে আসছেন তাকে নিশ্চয় ভুলে যাওয়ার কথা। আমি শুধু একটা কথা জানতে আসছি। যাকে গর্ভে ধারন করেছিলেন তাকে এইভাবে ছুরে ফেলে দিলেন কেন? এই প্রশ্নটা আমার মাথায় সারাক্ষন ঘুরতে থাকে। এই প্রশ্নটা আমাকে ঠিকমত ঘুমাতে দেয়না।” উনি কেমন করে যেন উঠলেন কথাটা শুনে। মিরাজের দিকে কি নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে থাকলেন। একটু ছুয়ে দিতে চাইলেন কিন্তু পিছিয়ে গেলেন” মিরাজ একটা চিৎকার দিয়ে বললেন “উত্তর দিচ্ছেন না কেন?” উনি তারপরও চুপ করে রইলেন। চুপ করেই চোখ দিয়ে জল ছাড়িয়ে দিয়ে বললেন “আমার ছেলেটা। কত বড় হয়ে গেছো তুমি।” আমার কেন যেন খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। উনি একটু থেমে আবার বললেন তুমি যে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবিনি। কিন্তু আমার মন প্রায় বলতো তুমি একদিন আসবে এবং আমাকে ঠিক এই প্রশ্ন গুলো করবে। তোমাকে কি বলবো আমি জানি না। তোমার বাবাকে বিয়ে করে আমি সুখি ছিলাম না। ভালোবাসা কি সে জানে না। সে শুধু জানে শরীরটাকে ভালোবাসতে। আমি এমন ভালোবাসা চাইতাম না। মাঝে মাঝে আমার গায়েও হাত তুলতো। তুমি তখন অনেক ছোট। কতবার ভেবেছি সব ছেড়ে মরে যাই। কিন্তু পারতাম না তোমার জন্য। আমার খুব কষ্ট লাগতো সারাটা দিন, তোমাকে ফেলে আসাতে। যাকে আমি ভালোবাসতাম সেই আমার এতো কিছু জেনেও আমার হাতটা আবার ধরলো। কেন যেন হাতটা ছাড়তে আর ইচ্ছে করেনি। আমি জানি আমি খুব অন্যায় করেছি তোমাকে ফেলে আসাতে। তোমাকে এইভাবে ফেলে আসা আমার উচিৎ ছিল না। যেটার ক্ষমার যোগ্য না আমি। সব মানুষেরই একটা স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার আছে।” মিরাজ একটু কাঁদলো। তারপর কান্না করতে করতেই বললো “শুয়রের বাচ্চাটাকে তো আমি বাপ বলেও পরিচয় দেই না। আমি কে সে তো আমাকে চিনেই না। আপনারা সবাই স্বার্থপর, এক একটা ভয়ংকর স্বার্থপর। আপনাদের এই চাওয়া পাওয়ার জন্য, স্বাধীনভাবে চলার জন্য আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলেন কেন? সবাই যখন বাবা মায়ের সাথে স্কুলে আসতো, কোথাও যেত, নিজ হাতে ওদের খাওয়াই দিত আমি তখন চুপ করে এগুলা দেখে ভিতরে ভিতরে কাঁদতাম এখনো কাঁদি। আপনাদের কাউকে আমি ক্ষমা করবো না। কখনো করবো না। আমি আপনাদের ঘৃনা করি।” এটা বলেই মিরাজ আর একটুও দাঁড়ালো না। আমি শুধু উনার কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকালাম।
ঢাকা শহরটার দিকে মাথা তুলে তাকালে এখন আমার কেমন কেমন লাগে। মনে হয় আকাশটা ভেঙ্গে পড়বে। মা আমাকে বলে “তোর জন্য পিঠা বানাচ্ছি। ভাপা পিঠা। তোর বাবার অনেক পছন্দ ছিল। এখন বাসা থেকে বের হোস না। কোথাও বের হলে খেয়ে বের হোস।” আমি মাকে কিছু বলি না। মা আমার জন্য পিঠা বানায়।এই রাতের শহরে আমার রুমের ভিতরে নিঃশব্দতা ভর করে। আমি চুপ করে চারপাশটাকে দেখি। আমাদের মানুষের জীবনে অবহেলা জিনিসটা যখন তাড়া করে বেড়ায় তখন চারপাশের জগৎটাকে এমনিতে ভালোলাগে না। শহরটাকে তখন পর পর মনে হয়। ইনার কথা আমার মনে পড়ে। মেয়েটাকে বলেছিলাম আবার দেখা করবো। আজ না হয় একবার দেখা করি। পিঠা বানানো হলে আমি মায়ের বানানো পিঠা খাই। মা আমার খাওয়া দেখে। এই দেখার মাঝে মা কি যে আনন্দ পায় আমি মায়ের মুখ দেখেই বুঝি। মা আমাকে বলে “তোর খালা ফোন করেছিল। ইবনাতের সাথেও কথা বললাম। মেয়েটা জোর করছে যাওয়ার জন্য। আর শোন মিরাজকে দেখলে আসতে বলিস।পারলে সাথে করে নিয়ে আসিস। ছেলেটার জন্য আমার মায়া হয়।” আমি মাকে হুম নামক শব্দ উচ্চারন করে একটা কাগজে দুটো পিঠা মুড়িয়ে বের হয়ে পড়ি। তখন সন্ধ্যা সাতটা। অনেক খুঁজাখুঁজি আর অপেক্ষার পর যখন ইনার সাথে দেখা হলো ইনা খানিকটা অবাক হয়েছে আমাকে দেখে। আমাকে বললো “আমি তো ভাবলাম আপনি আর আসবেন না। কিন্তু এলেন কেন? আমি একটা খারাপ মেয়ে।” আমি ইনার চোখে তাকিয়ে বলি “আপনি যে কাজটা করেন সেটাকে আমি ভালো বলবো না।এই কাজটা সমাজের চোখে খারাপ। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনার মনটা একদম পবিত্র।এই পবিত্র মনটার সাথে কথা বলা যায়।” ইনা আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলো।আমি তাকে পিঠা দুটো দিয়ে বললাম “আমার মা বানিয়েছে। আসার সময় ভাবলাম আপনার জন্য নিয়ে আসি। আমার মা কিন্তু খুব ভালো পিঠা বানায়।” আমার কথাটা ইনা কেমন করে যেন গ্রহণ করলো। আমি তার চোখে জল দেখি। সে চোখের কোনের জল মুছেই বললো “আপনি মানুষটা অনেক ভালো জানেন। এমন মানুষ গুলো আমাকে যদি একটু সাহায্য করতো আমার জীবনটা এমন হতো না।” ইনা পিঠা গুলো কি তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে কথা গুলো বলে। আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকি। আমার কেন যেন মনে হয় ঢাকা শহরে যে আলো গুলো এখন জ্বলছে এই আলো গুলো বেদনার আলো। এই আলো গুলোর মাঝে মানুষের মিছে হাসিটা দেখা যায়। আলো যখন নিভে যাবে মানুষ গুলো তখন নিশ্চয় আঁধারে হাউমাউ করে কাঁদবে। ইনা আবার বলতে লাগলো “জানেন পিঠা খেয়ে আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে। আমি তখন অনেক ছোট। আমি বাবা আর মা। এই তিন জন মিলেই ছিল আমার পরিবার। মায়ের তেমন কেউ ছিল না। আমি ছিলাম বাবার রাজকন্যা। রোজ রাতে আমাকে ভাত নিজের হাতে খাইয়ে দিত। আমার না চকলেট অনেক পছন্দ জানেন। আমার বাবা রোজ কাজ থেকে ফিরার সময় আমার জন্য চকলেট আনতো। আমাকে বলতো “আম্মাজান ঠিক মত পড়বা। তোমারে অনেক বড় হইতে হইবো। অনেক বড়।” আমার চাচারা ভালো মানুষ না। আমার বাবা ছিল ওদের সৎ ভাই। আমি তখন ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস এইটে উঠি। আমি রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি দেখি আমার চাচারা আমার বাবার সাথে কি নিয়ে যেন চিৎকার চেচামেচি করছে। বাবাকে জানের হুমকি দেয়। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ভীষন ভয় লাগছিল। পরে জানলাম জায়গা জমি নিয়ে ওরা ঝামেলা করছে। আমি বাবাকে বলি “আমাদের কিচ্ছু দরকার নেই বাবা। ওদের দিয়ে দাও। ওরা মানুষ না।” আমি বাবার চোখে পানি দেখি। আমার না আমার বাবার চোখে পানি দেখলে একদম সহ্য হতো না। মনে হতো একটা ঝড়ো বাতাস আমাকে উড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এই ঝড়ো বাতাসটা যে সত্যি সত্যিই উড়িয়ে নিবে কে জানতো?” ইনা এইটুকুই বলে থামে। আমি একটু শান্ত ভাবেই বললাম “তারপর?” ইনা আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বললো “বাবা কোন ঝামেলাই করেনি। বসতঘর আর একটা জমি রেখে বাবা ওদের সব কিছু দিয়ে দেয়। তারপর হঠাৎ করেই একদিন বাবার কি যেন একটা অসুখ হয়। আমাদেরকে পর করে বাবা অসুখটাকে একদম আপন করে একেবারেই হারিয়ে গেলেন। এরপর থেকেই আমাদের ভালোবাসার ঘরে অভাব ঢুকতে শুরু করে। কতদিন না খেয়ে ছিলাম। চাচারা একটুও দেখতেন না। মা ঐ জমিতেই যা পারতেন চাষ করতেন বা কখনো কাউকে দিয়ে করাতেন। এরপর একটা ভয়ংকর দিন আসলো আমার জীবনে। আমার নিজ চাচাতো ভাই আমাকে একেবারেই শেষ করে দিল। আমি কি কষ্টই না পেয়েছিলাম। কাউকে মুখ দেখাতে ইচ্ছা করতো না। মা গ্রামে বিচার চাইলো। কেউ মায়ের কথা শুনেনি। এর ঠিক পর দিনই মা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। বললো নতুন করে আবার বাঁচবে। কিন্ত বাঁচলাম কই? যে বাড়িতে জায়গা মিললো সে বাড়ির সাহেবই কিছুদিন পর আমার জীবনটা আবার শেষ করলো। আমাকে ভয় দেখালো আর এটা প্রতিনিয়তি চলতে থাকলো। আমি তখন ছোট তো ঐ সাহস কি আমার ছিল? আমার এই ছোট্ট জীবনে এতো কষ্ট সহ্য হয়নি জানেন। একদিন যখন মা জানলেন তারপর দিনই আমার মা গলায় ফাসি দিলেন।আমি কি করবো তখন বলেন? কতদিন না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ছিলাম।” আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো হঠাৎ ইনার কথা শুনে। আমি বললাম “প্লিজ থামেন আর বলতে হবে না।” ইনা চোখ মুছে একটু হাসলো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। ইনা বললো “আপনার মায়ের বানানো পিঠা ভালো হয়েছে। উনাকে আমার সালাম দিবেন কেমন?” আমি বললাম এই পথটা থেকে ফিরে আসা যায় না? আমি কথা দিচ্ছি ইনা আপনাকে আমি যথেষ্ট হেল্প করবো।” ইনা চুল গুলো একটু ঠিক করে বললো “একটা সত্য কথা বলবো?” আমি হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। ইনা বললো “যেদিন আপনাকে দেখলাম। আপনার সাথে হাটলাম। সময়টা পার করলাম তারপর থেকেই একটা মানুষ হিসেবে আবার বাঁচতে ইচ্ছা হলো। সেদিনের পর থেকেই আমি আর এই কাজটাতে যাইনি। একটা ছেলে আছে জানেন। আমার থেকে দু এক বছরের ছোট হবে। ছেলেটা আমাকে খুব চায়। আমার এতো কিছু জেনেও আমাকে নিজের করতে চায়। আমি বার বার ওকে ফিরিয়ে দেই। জানেন আজকেও আমি খুব বকা দিয়েছি ওকে।ছেলেটা আমার কাছে এসে কান্না করে। ছেলেটাকে আমি ঠকাতে চাইনা। ওকে কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে না।” আমি বললাম “আর ছেলেটাকে কষ্ট দিবেন না ঠিকাছে? আপনার নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভ কামনা ইনা।”
আমি মানুষটা কেমন জানি। ঝাপসা চোখে স্বপ্নের ছায়া হয়তো দেখা যায় না। কিন্তু এই ঝাপসা চোখেই স্বপ্নের ছায়াকে খুঁজি এবং প্রতিবারই ব্যর্থ হই।এই ব্যর্থ হতে হতে নিল আকাশের শূন্য দৃশ্য গুলো নিজের চোখে আঁকি।আজ একমাস হলো আমি নিলার সামনে যাইনা।যেতে ইচ্ছে করে না।আমার জন্য একটা মানুষ কষ্ট পাক সেটা আমি মোটেও চাইনা।এই না পাওয়ার উষ্ণতা আমার শরীরে যখন বিষাদ ছায়া হয়ে আসে আমার তখন শহরটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে। বসে বসে এসব যখন ভাবছি তখন ইবনাত এসে বললো “আজকে না আপনার পাহাড় দেখার কথা।” আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই। ইবনাত আমার খালাতো বোন। আমার থেকে চার বছরের ছোট। তিন দিন হলো মাকে নিয়ে চট্টগ্রামে খালার বাসায় আসছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ওর দিকে আমি তেমন এখন তাকাতে পারি না। কেমন যেন আমার লজ্জা লজ্জা লাগে। ছোট বেলায় আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ট দিন গুলো এই ইবনাতের সাথেই কেটেছে। একদিন আমি ঘুরি উড়াচ্ছিলাম। ও কোথা থেকে এসে কিছুক্ষন আমার পাশে দাঁড়িয়ে নাটাই থেকে সুতাটা টান দিয়ে ছিড়ে ফেলে। আমার ভিতরে ভয়ংকর একটা রাগ তৈরি হয়। আমি রাগে কট কট করে ওর গালে একটা কামড় দিয়েছিলাম। ও কি কান্না। অবশ্য এটার জন্য আম্মার হাতে খুব মার খেয়েছি। ওর বড় আপার নাম লামিয়া। উনাকে আমি ভীষন ভয় খাই। উনার চোখ গুলা অনেক বড় বড়। এই বড় বড় চোখের জন্যই আমি ভয় পেতাম। অবশ্য ও এখন দুই বাচ্চার মা। আমি মাঝে মাঝে ভাবি ওর বাচ্চা গুলোও কি আমার মত উনাকে ভয় পায়?” ইবনাত আমার চুপ থাকা দেখে আবার বললো “কি ভাবছেন? আপনি অনেক বদলে গিয়েছেন এটা কি আপনি জানেন?” আমি এই কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “ছবি গুলো অনেক সুন্দর। তুমি খুব ভালো ছবি আঁকো। যারা ছবি আঁকে তাদের ভিতরটা অনেক কঠিন হয় জানো। ওরা চুপ চাপ স্বভাবের হয়। ওরা প্রকৃতি, রং নিয়ে সারাক্ষন ভাবনায় থাকে। রং নিয়ে খেলা করে। কিন্তু তুমি ঠিক আগের মতই রয়ে গেছো। তোমার আঁকা একেকটা ছবি আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি।” ইবনাত আমার কথা শুনে হাসে। আমি ওর হাসির দিকে তাকাই। সে হাসতে হাসতেই বললো “আপনি দেখছি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে শিখেছেন। আচ্ছা চলেন এখন।”
ইবনাতের সাথে আমি পাহাড়ের বুকে হাটতে থাকি। মাঝে মাঝে পাহাড়ি বাতাস এসে আমাদের দুজনকে ছুয়ে দেয় আমি তখন ওর দিকে তাকাই। ও কি সুন্দর করে ওর চুল গুলো কানের পিছনে নিয়ে যায়। হাটতে হাটতে পাহাড়ের একদম চূড়ায় এসে একটু দাঁড়িয়ে আকাশটার দিকে যখন তাকালাম ইবনাত বললো “আকাশটাকে এখন অনেক কাছে মনে হচ্ছে না?” আমি শুধু মাথা নেড়ে হুম নামক শব্দ উচ্চারন করলাম।ইবনাত বললো “আপনাকে দেখে না অনেক বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়। এতো চুপচাপ কেন? একটা কথা কি জানেন? আমার প্রায় ইচ্ছা হতো আপনার শহের গিয়ে আপনাকে খুন করে আসতে।” আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম “তার কারণটা নিশ্চয় আমি বুঝতে পেরেছি।তুমি চাইলে আমাকে এই পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে প্রতিশোধ নিতে পারো। এই সুযোগ হাত ছাড়া করো না কেমন?” ও আমার দিকে তাকালো তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আমি মাটিতে বসে পড়ি। তাকে বলি “তোমাদের শহরটা অনেক সুন্দর।একদম কাছ থেকে মাটির গন্ধটা নেওয়া যায়।চোখ বুঝলেই মনে হয় একটা ভালোবাসা জড়িয়ে আছে।এমন ভালোবাসার ছোয়াতে নিজেকে কবি কবি মনে হয়। আচ্ছা তোমাকে না হয় দু লাইন শোনাই…
নিখাদ আবেগে আজ তবু হোক একটা অতৃপ্ত প্রেম
এই রনাঙ্গনে রাতের আকাশ ভরা রুপালি আলোয়
আমার এখনো রাত জাগা হয়…
ইবনাত আমার কবিতা শুনে বললো “আপনি কি আমাকে পটাতে চেষ্টা করছেন জনাব?” এটা বলেই ও হাসতে থাকে।আমি ওর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি।অদ্ভুত ব্যাপার ওর হাসিটা অনেক সুন্দর অনেক। আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। আমার আর বলতেও ইচ্ছে করে না।বিকেল হতে হতে সূর্যটা যখন শান্ত হতে লাগলো চারপাশে একটা গৌধুলি আলো ছড়িয়ে পড়লো। এই গৌধুলি আলোয় পাহাড়টাও অদ্ভুত রুপে সাজে। আমি একবার পাহাড়ের দিকে তাকাই আর একবার ইবনাতের দিকে তাকাই আর ভাবি কাকে বেশি সুন্দর লাগে। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে কেন ভাবছি? এমন ভাবাটা তো উচিৎ না। ঠিক তখনি আমাকে ঘাবড়ে দিয়ে ইবনাত বললো “পাহাড়ের ডাক শুনেছেন?খুব সকালে আর সূর্য যখন অস্ত যায় তারপর থেকেই পাহাড় ডাকতে শুরু করে।আচ্ছা আমার দিকে তাকান। দেখে বলেন কাকে বেশি মায়া মায়া লাগে। এই পাহাড়টাকে নাকি আমাকে।” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। ইবনাত কেন আমাকে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করলো? এই প্রশ্নের উত্তর কি আমার কাছে আছে? আমি বললাম “আমি এখন যেটা বলবো হয়তো এটা বলা আমার মানাবে না। কিন্তু বলি, আমার এখন মনে হচ্ছে তুমি নিজেই একটা শহর। এই শহরটার চোখে তাকালে এই পাহাড় কিছুই না।” ইবনাত আমার কথা শুনে হাসে। অদ্ভুত ভাবে হাসে।
রাতের বেলা খালা আমাকে নিজ হাতে সিমের ভর্তা, টাকি মাছ আর মাসকলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে বলে “তুই মাঝে মাঝে আসতে পারিস না?” আমি খেতে খেতে বলি “তুমি এখনো আমাকে খোকা মনে করো। এই কয়দিনে তোমার যে ভালোবাসা পাচ্ছি এটার মায়া পড়ে গেলে এই শহর ছেড়ে আর যেতে ইচ্ছে করবে না। পরে মা কাঁদবে।” মা আমার পাশে বসে থাকে। খালু আর ইবনাত হাসে আমার কথা শুনে। আমি চুপ করে খেতে থাকি।
চট্টগ্রামে আসার পর সত্যিই আমার সময় গুলো ভালো কাটছে। রোজ সকালে ইবনাত ধোয়া উঠা কফি বানিয়ে আমার সাথে সকাল দেখে। এই সকাল দেখার মাঝে আমি নিজেকে নতুন ভাবে ভাবতে শুরু করি। আজ সকাল সকালই নদীর কাছে এসেছি। নদীর পারে হাটার সময় কিছুক্ষন পর পর নদীর পানি আমাদের পা কে ছুয়ে দিয়ে যায়। ইবনাত এই পানির মাঝে পিপড়ের মত পিলপিল করে হাটে। ওর সাথে যত সময় পার করছি এই অল্প সময়ে ওর সাধারন কথাবার্তা আর দৃশ্যগুলো কেন আমাকে আচ্ছন্ন করছে? আমি আকাশটার দিকে তাকাই। রোদ উঠি উঠি করছে।এই চকচকে রোদ মাখা বালির উপর হাটতে সত্যিই নিজের ভিতর একটা অন্য রকম কাজ করছে।কিন্তু এই ভালো লাগাটা মনের ভিতরে বড় করে না তুলাই ভালো।
যেদিন ঢাকায় আসার জন্য রওনা দিচ্ছিলাম ইবনাতকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।সে শুধু আমাকে ছোট্ট একটা টেক্সট করেছিল “আপনার এই চলে যাওয়াটা আমি দেখতে পারবো না জানেন। এমন কেন হচ্ছে আমি জানি না।খুব ভালো থাকুন।” ঢাকায় আসার পর দিন গুলো কিভাবে কেটেছে। কিভাবে রাত পার হয়ে দিনের আলো আমার চোখকে স্বাক্ষাৎ দিয়েছে আমি বুঝতে পারি না।বুঝতে পারি না সাতটা মাস কোন দিক দিয়ে পার হয়ে গেলো।মিরাজ এখন কোথায় আমি জানি না। মাঝে মাঝে ও এসে দেখা করে আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ভার্সিটেতেও তেমন যাওয়া হয়নি।শুধু পরীক্ষার সময় এ্যাটেন্ড করেছি।আমি ক্যাম্পাসটার দিকে তাকাই।হয়তো আর কয়েক মাস পর আমি এই ভার্সিটি থেকে বের হয়ে যাবো।সবাই যার যার মত ব্যাস্ত হয়ে যাবে।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হাটতে যাবো তখনি আমি নিলাকে দেখি ও কেমন একটা মুখ নিয়ে কিছুটা দুরে আমার দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।আমি নিজেকে সাবধান করে যেই অন্যদিকে চলে যাবো নিলা ডাক দিলো আমায়। ও আমার সামনে এসে একটু ইতস্তত হয়ে বললো “মানুষ গুলো এমন কেন বলো তো?” আমি ওর চোখ দুটোর মাঝে তাকাই। এই চোখ গুলোর মাঝে একটা অপ্রাপ্তির ছায়া দেখতে পাই। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ওর কিছু একটা হয়েছে।আমি বললাম “মানুষ গুলো কেমন?” সে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো “স্বার্থপর অনেক স্বার্থপর।শুধু নিজেরটা ভাবে।অনুভূতি গুলো পেয়ে গেলেই ভুলে যায়।” নিলা হঠাৎ করে কেন এমন কথা বলছে আমি বুঝতে পারি না। আমি বললাম “মানুষ গুলা কেমন আমি জানি না নিলা।কিন্তু আমি মানুষটা অবহেলাকে মেনে নিতে পারি না।আমার ভালো লাগে না।তাই নিজেকে আড়াল করে ফেলি।” সে আমার দিকে কেমন একটা চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো।আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু এর দুদিন পর আমি খবর পেলাম নিলা আত্মহত্যা করেছে। ওর ভালোবাসার মানুষটা ওকে ঠকিয়ে অন্যজনের কাছে ভালোবাসা তৈরি করেছে।আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠলো।এই ভিতরের কষ্টগুলো আমাকে ঠিক মত থাকতে দেয় না।নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল।আমার কি উচিৎ ছিল না নিলার কথা গুলো ভালো করে বুঝার?আমার কি বলা উচিৎ ছিল একদম ভেবো না মেয়ে আমি আছিতো। কিন্তু এই বলার অধিকার কি আমার ছিল? আমার কান্না আসে খুব কান্না আসে।আমি দরজা বন্ধ করে কাঁদি অনেক কাঁদি।আমার দিন কাটে না, রাত কাটে না, আমি এক প্রতিবন্ধির মত একাকি হয়ে আকাশ দেখি। প্রিয় নিলা আমি খুব দুঃখিত তোমাকে বুঝতে না পারাতে।
চার বছর পর আমি চেয়ারে বসে বসে আয়নার গ্লাসে রোদ মাখা বৃষ্টি দেখি। রোদের সময় যখন বৃষ্টি হয় তখন নাকি খেকশিয়ালের বিয়ে হয়।এই শহরে অনেক কিছুই ঘটে।অদ্ভুত এক মায়ার শহর। এই শহরের মায়া গুলো যখন মনে পড়ে তখন ভিতরটা একদম বিষন্ন হয়ে যায়।তখন চারপাশের জগৎ ভালো লাগে না। কিন্তু এসব ভাবলে কি হবে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অফিসে আমি কাজের দিকে মনোযোগ দেই।এর একটু পরেই ইবনাতের ফোন আসে।ওর সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়।এই এতো গুলো বছর ওর সাথে কেমন করে কথা বলেছি শুধুই আমিই জানি।আমি শুধু ওর কথা শুনতাম। চুপ করে শুনতাম। আর ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে কবিতা শুনাতাম। আমার এতো চুপ থাকাটা কিভাবে ও সহ্য করতো আমি বুঝতে পারি না। আমি রিসিভ করে হ্যালো বললাম। ও ওপাশ থেকে চুপ করে রইলো। আমি বললাম “কিছু বলবে?” ও আরও একটু সময় নিয়ে বললো “বাবা মা বিয়ের জন্য পাত্র দেখছে।এসব আমার ভালো লাগে না।আমার ভালো লাগে কারও পাশে বসে পাহাড়ের ডাক শুনতে।নদীর পানি ছুয়ে দিতে।কবিতা শুনতে।এই কবিতাটা শুধু আমার জন্য হবে। সেই কবিতা মাখানো শব্দ নিজের মাঝে বন্দি করে আমার আঁকা ছবির মাঝে রুপ দিতে ইচ্ছে করে।” আমি চুপ করে থাকি।অনুধাবন করি মানুষের চাওয়া পাওয়ার মাঝে কি এমন আছে? যা মানুষকে সামনের এগিয়ে যেতে উৎসাহ করে। আমার চুপ থাকা দেখে সে আবার বললো “আপনি এমনি থেকে যাবেন আমি জানি।নিজে থেকে কখনো বলবেন না। একটা কথা মন দিয়ে শুনেন আমার এই ইচ্ছে গুলো যদি পূরণ না হয় আমি সত্যি আপনার শহরে গিয়ে আপনাকে খুন করে আসবো।” আমি হতভম্ব হয়ে চুপ করে থাকি।কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারি না।আমি আস্তে করে ফোনটা কেটে দেই।আমারও খুব ইচ্ছে করে আমার ভিতরের কষ্ট গুলোকে মুছে এমন অনুভূতিতে জড়াতে।সন্ধ্যা বেলার পাহাড়ের গৌধুলি আলো, নদীর শিতল ছোয়া আামার ভিতরের কান্না গুলোকে মুছে দিবে। আমি জানি না ইবনাত কেন আমাকে এমন করে বললে।তবে কথা দিচ্ছি আমি শিঘ্রই আসছি ইচ্ছের রং ছুয়ে দিয়ে বিকেল বেলার রোদ নিজের করে নিতে একটু অপেক্ষা করো। আমার জীবনের স্বপ্ন গুলো কাউকে যে দেখাতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে এই স্বপ্নের মাঝে কোনটা আলো আর কোনটা আঁধার…
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:৩৪