দোকানটা আমার বেশ পরিচিত।কিন্তু দোকানদার মামার সাথে খাতিরটা এখন অব্দি যুতসই পর্যায়ে নিয়ে ঠেকাতে পারিনি।
দোকানের একমাত্র কাঠের চেয়ারটাতে বসে তাকে আটার বস্তা খুলতে দেখা যাচ্ছে।তাই একটা পটেটো ক্র্যাকার্স খেতে খেতে মামার সাথে আলাপ জমানোর চিন্তাটা তৎক্ষণাৎ বাদ দিতে হলো।
দোকানের সামনে সিঁড়ির মতো একটা জায়গায় বসা একজন বয়স্ক লোকের দিকে অধমের চোখ পড়লো। আজকাল বাঙালী জাতির সহ্যশক্তির তারিফ করতে হয়।এই গরমেও গলায় মাফলার পেঁচিয়ে তিনি দিব্যি বসে আছেন।চোখে বেশ পুরনো ডিজাইনের মোটা কালো রঙের চশমা,ক্লিন শেভড।কাবু হাতে আলগোছে একটা প্যাকেট ঝুলছে।আপাদমস্তক দেখলে বেশভূষার কারনেই হয়তো লোকটাকে কিম্ভুতকিমাকার বললেও ভুল কিছু বলা হবে না।
ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো হয়তো কারো জন্যে অপেক্ষা করছেন।আগ বাড়িয়ে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি ঠিক এমন সময় হঠাৎ তাঁকে উঠে দাঁড়াতে দেখলাম।তাঁর ইতস্তততা নিয়ে অতো ঘাঁটিয়েই বা আমার কি লাভ।
পাশের ইলেক্ট্রিক পোলে ঠেস দেয়া লাঠিটা নিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলেন।এই দৃশ্যপটে আমি নতুন কিছু খুঁজতে গিয়ে আশাহতই হলাম বলা চলে।
যাহোক,আবারো পোল মহাশয়ের কাছে ফিরে আসি।নেই কাজ তো খই ভাজ এরকম একটা প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায়।খই এর বদলে আমি ইলেকট্রিক পোলটার দিকে মনোযোগ দিলাম।
এখান থেকে গলির মুখ পর্যন্ত নাহয় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা যাক।আপেক্ষিকতার হিসেবে ধরলে সময়টা বেশিই মনে হবে।কাজেই নিজ স্বার্থেই যথেষ্ট ধীরে হাঁটছি।নচেৎ কাঁটাচামচ এর কাঁটার প্রস্থের সাথে হুবহু মিল খাওয়া এমন অলিগলি রাস্তায় নিজেকে কচ্ছপ বানানো খুনজাতীয় অপরাধের শামিল।
এভাবে কতক্ষণ পার করলাম ধারনা করার আগেই তিন চার হাত দূরে রেহান এর অবয়ব স্পষ্ট হতে লাগলো।পরনের শার্টটা নতুন নাকি।যদিও হাঁটার ধরন পরিচিত থাকায় ছেলেটাকে চিনতে বেগ পেতে হলো না।
'কিরে বাকিরা কই?' ইতিউতি তাকিয়ে রেহানের প্রশ্নের তীর স্বাভাবিকভাবেই আমার দিকেই আসলো।
'মন অলরেডি সাজেকে,খালি প্ল্যান না কি হ্যান ত্যানের জন্যেই ঢাকাই পইড়া আছি রে..’আমার কাঁধের ওপর অতল এর হাত পড়ল।
'আচ্ছা,শোন, টিকিট কনফার্মড।তোরা খালি...’ দীর্ঘ প্রতিক্ষীত ট্যুর নিয়ে মাথায় যা কিছু টুকে রাখা ছিলো তার সবকিছু আমি উগলে দিতে থাকলাম।
২.
'নারে,ছেলেটারে আজকাল মানাতে পারিনা। ভয় হয় জানিনা এভাবে কতোটা আগলে রাখতে পারবো....’রেহনুমা কথা শেষ করতে পারলেন না। লাইন কেটে গেলো।
টেলিফোনে কথা বলতে বলতে ঠিক পেছনেই ছেলের উপস্থিতি টেরই পাননি।
'কখন এলি?তা তোদের ট্যুর কদ্দূর কি হলো রে বাবা?"উৎসুক কন্ঠে ছেলের কাছে রেহনুমার জিজ্ঞাসা।
'পরশু রওনা দিচ্ছি, হোপ সো" রেহানের সোজাসাপ্টা উত্তর।
'কেনাকাটা কিছু লাগবে নাকি?'
'না,বাবা করে দিয়েছে।'তাচ্ছিল্যের সাথেই রেহনুমার প্রশ্নের উত্তর করল রেহনুমাপুত্র।
'রেহান!আমি যেটা চাইনা সেটা তুমি করতে যেয়ো না।ওই লোকটা,ওই লোকটা....’ক্ষনিকের মধ্যেই রেহনুমা প্রচণ্ড রাগে কথার খেই হারিয়ে ফেললেন।
'হি'জ মাই ফাদার,মা।আই কান্ট ডিনাই হিম....।'বলেই গটগট করে রেহান পিসির মনিটরে চোখ রাখলো।
যেন বিকল্প কোন সিদ্ধান্ত শোনার ইচ্ছা তার একেবারেই নেই।
৩.
বিকাল চারটা বেজে সতেরো মিনিট।সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড।
আমাদের কাউন্টার থেকে কয়েক গজ দূরে সিগারেট ফুঁকছি।আজ অবশ্য পরশুর সেই চিপাগলির বিচিত্র কিছুর সাক্ষী হতে আমার সাথে অতল আগেভাগেই এসে পৌঁছে গেছে।সাজেকের টান বলে কথা।
চারটে ত্রিশে সামনে যে বাসটা রয়েছে ওটার ইঞ্জিনের ঘন্টি বাজার কথা। ইতিমধ্যেই যযাত্রীদের কেউ কেউ পপকর্ণ, ঝালমুড়ি দিয়ে মুখের ঘন্টি বাজানো শুরু করে দিয়েছেন।সাধে কি আর বাঙালী জাতি ভোজনরসিক এর খাতায় নাম তুলেছে।
বাসা থেকে বের হবার সময়ে বিটিভির তিনটের সংবাদ এর নিরপেক্ষ দর্শক ছিলাম।না,নিউজ প্রেজেন্টার একজন সুন্দরী মেয়ে বলে নয়,মূল উদ্দেশ্য ছিলো হাতঘড়ির সময় কাটায় কাটায় মিলিয়ে নেয়া।কোন ভুলচুক হওয়া চলবে না।
আর তাই যদি হয়,তবে বলতে পারি,পরের ছয় মিনিটে রেহানের দেখা না মিললে ওর সিটটা খালি রেখেই স্টারলাইনের ইঞ্জিন স্টার্ট হবে।
'ওই দ্যাখ রেহান আসছে...'
অতল এর কনুই এর গুতো খেয়ে আমার রাজ্যের কুচিন্তায় সমাপ্তি টানতে বাধ্য হলাম।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে অতল রেহান দুজনেই কাঁধ মিলিয়ে আগে চলতে শুরু করলো।
আমি এক হাত পেছনে থেকেই ওদের সঙ্গ দিচ্ছি।সামনে শেফা স্টোরে সেদিনের বুড়ো লোকটার পষ্ট অবয়ব অতল এর পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৩৬