অফিস থেকে সাধারণত বাসায় যাই। বাইরে ঘোরাঘুরির অভ্যাস একদম নেই। বাসায় যাব মনে করেই অফিস থেকে বের হলাম। কিন্তু বাদ সাধল একটা মোবাইল কল। এই কলটা অন্য যেকোন কল থেকে আলাদা।
রফিক সাহেব অনেকদিন থেকে অসুস্থ। অসুস্থতার প্রথম দিকে তাকে দেখতে যেতাম। কিছুদিন আগে অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় উনাকে উত্তরার একটা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে। তার এখন অন্তিম সময় চলছে। অনেকটা সেই কারণেই, আমাকে অনেক করে যেতে বললেন ভাবী।
রফিক সাহেব আর আমি একই সাথে বিমানবন্দরের চাকুরীতে জয়েন করি। দুজনেরই তখন তরুণ বয়স। অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে তার সাথে। মাসের আয় তত বেশি না হলেও ব্যাচেলর হওয়ার কারণে ভালই চলে যেত আমাদের। অনেকবারই রফিক সাহেবের গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছি। আপনি আপনি করে কথা হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল স্কুলের বন্ধুদের মতোই ঘনিষ্ঠ।
রফিক সাহেব বিয়ে করলেন, আমিও। দুইজনের বাসা খুবই কাছাকাছি। দুইজনেরই ছেলে সন্তান হয়েছে। ওরা পড়াশুনা করছে। ওদের জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখতে হয়। কম বেতনের চাকরীতে পোষাতে পারছি না। তখনও রফিক সাহেব আমার কাছে আপন ছিল। দুই জনে অফিস শেষে রাস্তায় হাঁটতে যেতাম । বিভিন্ন ধরনের কথা বলতাম। কি করা যায়? এতো অল্প পয়সা দিয়ে তো আর চলা যায় না।
এরপর অনেকটা হঠাৎ করেই রফিক সাহেব বদলে গেলেন। তার সাথে আমার সেই সুন্দর সম্পর্কটাও পাল্টে গেল। আমার কাছের মানুষটি আমার থেকে দুরে সরে গেল। প্রিয় বন্ধুর সাথে আর দেখা হয় না। রফিক সাহেব এখন অনেক ব্যস্ত। চোরাচালানী দলের লোকদের সাথে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন। এতে তার কিছু উপরি ইনকাম হয়। আর আমি আছি আমার আগের অবস্থাতেই। তিনি উত্তরায় বাড়ি কেনেন। ছেলেকে রাজউক কলেজ মোটা বেতনে ভর্তি করান। আর আমি টাকার অভাবে সরকারী কলেজে আমার ছেলেকে পাঠাই। দুই পরিবারের মধ্যে যাতায়াতটা কোনও অংশে কম ছিল না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বিভিন্ন ঈদে তাদের বাসায় পুরো পরিবার নিয়ে যাওয়া হত।
আমার মিসেসকে দিয়ে রফিক সাহেব এর মিসেস কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই টাকা উৎস নিয়ে উনাদের মতামত কি? অবৈধ টাকা ইনকাম করা তো ঠিক না। তার মিসেস যে উত্তর দিলেন তা হল এই রকম - আমার হাজব্যান্ড বিভিন্ন কর্মচারীর রোষ্টারিং এর দায়িত্ব পালন করেন। এই রোষ্টারিং এ কেউ যদি খুশি হয়ে কিছু দেয়, সেই টাকা নেয়াটা দোষের কিছু না। আর আমার হাজব্যান্ড কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করছেন না।
আমার ছেলে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি কোচিং করতে থাকে আর রফিক সাহেব এর ছেলে কোন কোচিং না করে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। আমি দেখি কিছুই বলি না, বলতে পারি না। ওনাদের টাকা আছে তারা ছেলেকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করাবেন। আর আমার এত কম টাকা পয়সা যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি নাম নেওয়াও আমার জন্য অন্যায়।
বিভিন্ন সময় বিপদে আপদে তার থেকে ধার নিয়ে আমি চলতাম। মানুষটি আজ ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত । তাকে দুই বার ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছূ হয়নি। তার কাছে যেয়ে তার গত দিনের ভুলের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেব। আমি রিক্সায় করে যাচ্ছি আর ভাবছি মানুষটির কথা।
রফিক সাহেবের ছেলে শাহীনের সাথে যখনই দেখা হত তখনই দেখতাম সে মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করছে। অনেকটা জড়তা নিয়ে বলত, আংকেল স্লামালাইকুম। তার বড় চুল আর হাতের ব্রেসলেট দেখে বোঝাই যেত, কতটুকু পেকে গিয়েছে ছেলেটি। একবার দেখলাম তার হাতে অনেক বড় একটি মোবাইল। আমি জিজ্ঞাসা করাতেই বলল, আংকেল এটা আইফোন। আমার ফ্রেন্ড এর কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। কি বলব নিজের ছেলেকে ভর্তি কোচিং এর জন্য ৮ হাজার টাকা দিতেই আমার খবর হয়ে গেছে সেখানে এই ছেলে ব্যবহার করছে অর্ধলক্ষ টাকা দামের মোবাইল!! নিজের ছেলে হলে কিছু বলা যেত, অন্যের ছেলে সহ্য করে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই করার নাই আমার।
উত্তরা মেডিক্যালে আমি রিক্সা থেকে নামলাম। কেবিন নাম্বার আগেই জেনে নিয়েছিলাম। চলে গেলাম সোজাসুজি তার কেবিনে। ভাবী আমাকে দেখে জায়গা খালি করে দিলেন। একটা চেয়ার টেনে বসলাম। রফিক সাহেব শুকিয়ে গিয়েছেন। বলা যায়, একবারে শুকনা কাঠ। তার রক্ত নিয়মিত পরিবর্তন করতে হচ্ছে। শাহীন তাই হাসপাতালের বাহিরে। বাবার জন্য রক্ত জোগাড় করছে। বিভিন্ন বিষয় এ তার সাথে কথা বলছি। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তার ছেলের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডমিশন এর ব্যবস্থা করছেন। বিশদিনের মধ্যেই ছেলে চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া। তার কাগজপত্র নিয়ে এত দিন টেনশানেই ছিলেন। আজকে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই তো বিশ দিন পর চলে যাবে ছেলেটি।
কথা বলার মাঝামাঝি ভাবীর মোবাইলে কল আসল। ভাবী বাইরে চলে গেলেন । আমি রফিক সাহেব এর হাতটা ধরে বসে রইলাম। কত আপন মানুষ আজকে বিদায় এক বারে দ্বারপ্রান্তে। ভাবী ওপাশ থেকে মোবাইলে কান্নায় ভেংগে পড়লেন। আমি দ্রুত বাইরে চলে গেলাম। মোবাইলটি কানে দিয়ে জানতে পারলাম। শাহীনের বয়সী একজনের লাশ রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন পুলিশ। তার পকেটে ডাইরী থেকে তারা এই নাম্বারটি পেয়েছে। আমরা কেউ থানায় যেয়ে যেন লাশটি শনাক্ত করি। সম্ভবত ছিনতাইকারীর হাত থেকে দামী মোবাইল বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছে ছেলেটি।
দ্রুত থানার উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। আবারও রিক্সা নিলাম। যাওয়ার সময় ভাবছি, পুলিশের করা ফোনটি যেন মিথ্যা হয় । আল্লাহ আমি যেন লাশ ঘরে যেয়ে শাহীনকে না দেখি। আমি দেখতে চাই শাহীন বেঁচে আছে। রিক্সায় বসে থাকা আমার দু’চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে অশ্রু। আমি বলছি আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও..............
http://sonarbangladesh.com/article.php?ID=3762