মা এবার বাড়ী যেয়ে তোমার সাথে বেশি সময় দিতে পারিনি। আমি কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসছি শুনে নিশ্চয়ই তুমি অনেক খুশি হয়েছিলে। কিন্তুু আমার বাংলাদেশে আসাটা তো তোমাকে দেখার জন্য নয় । আমি এসেছিলাম, আমার একমাত্র কন্যাকে বিয়ে দেয়ার জন্য।
দাড়াও! একটু দাড়াও!! আমার বিছানার পাশের টেবিল লাইটটা নিবিয়ে আসি। মা, এখানে এখন রাত দুইটা। আমার বিছানায় শুয়ে আছে আমার স্ত্রী রোজ। আমি যখন কম্পিউটারের কিবোর্ড এ কাহিনীগুলো লিখছি তখন আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে।তারা ঘুমাক, তাদের না জানিয়েই আমি লেখে যেতে চাই আমার ভিতরের কথাগুলো।
দেশে আসার দিনই আমি ওকে বলেছিলাম। চল আমাদের বাড়ী যাই। না, তার এক কথা প্রথমে ওদের বাড়ী যেতে হবে। কি আর করব। তার ভাইয়ের উত্তরার বাড়ীতেই প্রথমে উঠলাম এবং সেইদিন দুপুরেই আমরা চলে গেলাম ছেলেমেয়ের নানা বাড়ীতে। অনেক দিন পর বাংলাদেশে আসার কারনে তুমি মনে করেছিলে আমি সবার আগে তোমার কাছেই যাব। কিন্তু আমি পারলাম না মা। শুধু ওদের মামার মোবাইল থেকে তোমার সাথে কথা হল। আমার কথাগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল। নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছিলে আমার পাশে আমার প্রাণের প্রিয়তমা রয়েছে। হায়রে দুনিয়া! ছেলে তার মায়ের কাছ থেকে পৃথক হয় তাও আবার এই ভাবে। মা, তুমি অসুস্থ ছিলে এটা আমি জানতাম। আমি বুঝতে পারছিলাম তোমার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা । তোমাকে সারাজীবন তো আর সময় দিতে পারিনি। শেষ সময়টুকু তোমার পাশে থাকব এটাই ছিল আমার সুপ্ত ইচ্ছা।
আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাইছিলাম সেই প্রথম দিন থেকেই। দীর্ঘ চারদিন পর তোমার সাথে দেখা করার অনুমতি মিলল। একজন প্রবাসী হিসাবে আমি আমার পরিবার নিয়ে প্রাইভেট কার যোগে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার প্রিয়তমা সেটা হতে দিল না। তার একটাই কথা, এত দুরের রাস্তা যেতে হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ। বাংলাদেশের নরমাল বাসে করেই আমি গেলাম আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আমাকে, আমার ছেলেমেয়ে কে দেখে তুমি যে কি পরিমান খুশি হয়েছিলে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সময় তুমি ছিলে শয্যাশায়ী। সেই অবস্থায় তুমি আমাকে দোয়া করলে। তুমি এতই অসুস্থ ছিলে যে, আমাদের সাথে কথা বলতেও তোমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু গতবার তোমাকে যখন দেখেছি তখনও ছিলে কতটুকু স্বাভাবিক। তুমি হেসে হেসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলে। কিন্তু আজ, তুমি পারলে না।
মা, তোমার মনে আছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়ের কথা। সেই সময়গুলোতে আমি সারাক্ষন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। খুব কমই বাড়ী আসতে পারতাম। যখনই বাড়ী আসতাম তখন তুমি তোমার সাধ্যমত আমার পছন্দের রান্নাগুলো করার চেষ্টা করতে। টিউশনি করেই আমাকে চলতে হত। পড়াশুনা আর টিউশনির ফাঁকে যখনই সময় পেতাম তখনই আমি তোমার কাছে ছুটে যেতাম। আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট এর পর আমি জানি মা তুমি অনেক অনেক খুশি হয়েছিলে। আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এর টিচার হয়েছিলাম। মা, এই টিচার হওয়াই কি আমার জন্য কাল হল?
মা, তোমার কাছে দুই দিন থাকার পরই আমাদের ফিরতে হল উত্তরার সেই বাসাতে। আমি নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে গেলাম। ওর এককথা তোমাকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে মেয়ের বিয়ের জন্য, মায়ের সেবা করার জন্য নয়। আমি আমার একমাত্র কন্যার বিয়ের জন্য আমার পরিচিতদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলাম। জান মা, আমি এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে গেলাম। আমাকে ও এই অসুস্থতার মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় পাঠাত। আমার পুরানো বন্ধু বান্ধব থেকে শুরু করে ইউনির কলিগদের কাছে গিয়ে একটা পাত্রের জন্য বলতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও থেকে সাড়া পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যে তুমি বার বার আমাকে দেখা করতে বলছিলে ।আমি ওকে এটা বলতেই ওর কথা আগে মেয়ের বিয়ে তারপর অন্য কিছু। কি করব, কান্না ছাড়া অন্য কিছুই আমার করার ছিল না।
মা, তোমার মনে আছে যেইদিন আমি রোজ কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম? সেইদিন এটাকে তুমি ভাল চোখে নিতে পারোনি। আমি তোমাদের অগ্রাহ্য করেই বড়লোক হওয়ার আশায় বড় পরিবারে বিয়ে করলাম। আমার বড় হওয়ার আশা আজ আমাকেই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মা, আমি তো আমার জীবনের শেষ দিনগুলো বাংলাদেশের মাটিতে কাটাতে চেয়েছিলাম। রোজ এর কারনে আমি আজ কানাডার সিটিজেন । অনেক কিছুই আমি পেয়েছি। কিন্তু সবুজ মাঠ এর ধানের ক্ষেত আমি এখানে পাইনি । হয়ত আমার শেষদিনগুলো কানাডাতে কাটাতে হবে। তুমি তো জান, আমি অনেক সহজ সরল ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় এর পড়াশুনা আর অন্য কোন কিছুর দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় ছিল না আমার।
মা, অবশেষে আমরা আমার মেয়ের পাত্র পেয়ে গেলাম। ঢাকার এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ওর সাথে আমাদের প্রথম দেখা হয়। মা, ছেলেটি ছিল আমার মত । একেবারেই সহজ সরল। টুকটাক কথা বলেই আমাদের ছেলেটিকে পছন্দ হল। এই ছেলে পেয়ে তো রোজ খুশিতে আদখান। আমার মেয়ের সাথে ছেলেটির কথা বলার ডেট ঠিক করলাম। ওরাও বসল একটি চাইনিজে । কিন্তু না, ছেলে তো আমার মেয়ের সাথে কথা বলে বেকে বসল। যাও একটি ছেলে পেলাম, সেও আবার বেকে বসল। এই দিকে তোমার কাছে যাওয়ার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে গেলাম। এবার ছেলেটির সাথে কথা বলার দায়িত্ব দেয়া হল ওদের মামাকে। তিনি সেই পরিবারের সাথে কথা বললেন। হা, আমাদের তাড়াহুড়া আর বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখিয়ে তাদের রাজি করানো হলো। যেদিন আমি, আমার ছেলে এবং ওদের মামা মিলে ওদের বাড়ী গেলাম সেদিন যাওয়ার সময় আমি দেখে গেলাম আমার মেয়ে কম্পিউটারে কি যেন লেখছে। আমি প্রচন্ড দু:খে শুধু এই টুকুই বল্লাম, আমরা বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে ভালটাই নিয়ে যাব।
জান মা, আমার মেয়ের জন্য অনেক অনেক পাত্র খুজেছি। কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন কোথাও আমরা ওর জোড়া মিলাতে পারিনি। এবারকার ছেলেটির সাথে আমি বেশি কথা না বললেও আমার ছেলে ও তার মামা কথা বলেছে। তারা যেকোন মূল্যে এই রকম সহজ সরল ছেলেকে চায়। যাতে আমার মত করে তাকে ডমিস্টিক করে রাখতে পারে। মা, আমি মনে করেছিলাম, আমার মেয়ে অন্তত আমার মত হবে। নিজেকে সৎ হিসাবে তার হবু বর এর কাছে উপস্থাপন করবে । তার সত্যগুলোকে তুলে ধরবে। কিন্তু মেয়েটিও তা পারেনি। অবশেষে অনেক কথা কাটাকাটির পর আমরা বিয়ে ঠিক করলাম। তাও আবার এক সপ্তাহ পর। এর মধ্যে যা কিছু করার সবই করতে হবে। সব আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত দেয়া। বিয়ের কেনাকাটা, কত কি কাজ? তোমার সাথে দেখা করার ছুটি তো আমি পাচ্ছি না।
হা, আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলাম। সহজ সরল সেই ছেলের সাথেই আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিলাম। রোজ এতে যে কি পরিমান খুশি হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিয়ের পরের দিনই আমার ছুটি । আমি ছুটি পেয়েও গেলাম। তোমার কাছে এসে দেখি তোমার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। তুমি আগের মত একটু আধটু কথাও বলতে পারছিলে না। শুধু হাতে ইশারায় আমাকে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খাচ্ছিলে। আমি তোমাকে ঢাকা নিয়ে আসব সেটা করারও সময় নাই। কিই বা করতে পারি আমি। আজ যদি রোজ এর মা অসুস্থ থাকতো তাহলে সে ঠিকই বড় কোন হসপিটালে তার মাকে ভর্তি করত। কিন্তু আমি তোমার পাশে বসে বসে গুলোকোজ এর পানি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছি না। মা, তুমি হাতের ইশারায় আমার মেয়েকে আর তার জামাইকে দেখতে চাইলে। পরদিন সকালে ওদেরকে আমি নিয়ে আসলাম আমার বাড়ীতে। তুমি আমার নববধুর বেশে মেয়েকে দেখলে তার সাথে সাথে দেখলে আমার মেয়ের জামাইকে। তুমি আমার মেয়ের জামাইকে জড়িয়ে ধরলে। ধরার পাশাপাশি তোমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। তুমি বুঝতে পারছিলে, তোমার মত আরেক মায়ের বুক খালি হচ্ছে। হায়রে দুনিয়া, এভাবেই কি দিনের পর দিন মায়েরা তাদের সন্তানদের হারাবে!
তোমার অন্তীম সময়গুলোতে আমি তোমার কাছেই ছিলাম। কালেমা পড়ছিলাম আমি। তুমি শুধু চেয়েছিলে। হয়ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার ছোটবেলার কথাগুলোই ভাবছিলে। মা, তুমি চলে গেলে আমাকে ছেড়ে। আমার আত্মার সম্পূর্ণ আবেগকে উজার করে আমি কেদে উঠলাম।মা, আমি তোমাকে ভাল কিছু দেখিয়ে বিদায় দিতে পারিনি। আমার মত অযোগ্য ছেলে যেন কোন মা পেটে না ধরে। শুধু দুনিয়ার লোভে পড়ে কোন ছেলে যেন বিয়ে না করে।
মা, আজও আমি ঠিক হতে পারিনি। বাসায় বেশিক্ষন থাকতে পারি না। আমার মেয়ে বাংলাদেশে থাকা স্বামীর জন্য ছল ছল করে চেয়ে থাকে । আমি তার চোখে তোমার সেইদিনের কান্নাগুলো দেখতে পাই। আমি মসজিদে বসে বসে তোমার জন্যই দোয়া করি। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা...
[এই গল্পটা একান্তই আমার কল্পনার। এর সাথে কারো জীবনের কোন অংশের মিল থাকতেও পারে। কেউ এতে দু:খ পেয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাচ্ছি। ]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ৯:৩৯