‘ঘুমুচ্ছেন ?’
আমি চোখ বন্ধ করে যেভাবে পড়েছিলাম, সেভাবেই রইলাম । এক হাত কপালের ওপরে রাখা, অন্য হাতে ‘হান্ড্রেড লাভ সনেটস’ এর চৌকো মোটা বই । ‘Perhaps not to be is to be without your being.’ কবিতার পৃষ্ঠায় তর্জনী ঢোকানো । কবিতা পড়ছিলাম । হঠাৎ করে একটা জায়গায় এসে আটকে গেছিঃ
“and it follows that I am, because you are:
it follows from ‘you are’, that I am, and we:
and, because of love, you will, I will,
We will, come to be.”
প্রথমে ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে শব্দ লিখে শেষটায় কবি সহজ সমীকরনে চলে গেছেন । একারনেই শেষের এই তুলনামূলক সহজ চিন্তার সাথেও তাল মেলাতে পারছি না । নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে । কিছুক্ষণ মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে ।
‘শন দরকার । বাসায় শন নেই । বাজারে যেতে হবে । খুব জরুরী । ঘুমুচ্ছেন ?’
কি বিশ্রী ভঙ্গিতে কথা বলছে মেয়েটা ! ‘শন দরকার !’ এতো রুচিহীন কথা কোন নববিবাহিতা তার স্বামীকে বলতে পারে, আমার ধারনাতেই ছিল না । তাছাড়া ইজিচেয়ারে শুয়ে হাতে ‘পাবলো নেরুদা’ ধরে কেউ ঘুমুতে পারে এটা ভাবাটাই তো ভয়াবহ অন্যায় । ‘হাবলামি’র লক্ষণ । চটাস করে গালের ওপর একটা থাপ্পড় লাগাতে পারলে ভালো লাগতো । তা সম্ভব নয় । শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে বৌকে মারা যায় না । তাও আবার পুরোনো বৌ না । নতুন বৌ । ছয় মাস ফুরোয় নি বিয়ে হয়েছে । এখনও যার সাথে কথা বিনিময় চলছে ভাববাচ্যে । বিশেষ প্রয়োজনে অথবা মুখ ফসকে মাঝেমধ্যে ‘আপনি’ চলে আসে । যেমন, এখন এসেছে । রাতবিরেতে শন কিনতে বাইরে যাবার মত কেউ ঘরে নেই । জামাইকে ডাকো । জামাই এনে দেবে । জামাইয়ের কোন কাজ নেই । সারাদিন শুয়ে বসে ঝিমায় আর চা খেতে খেতে একই কবিতার বই দশবার করে পড়ে । একারনেই বাড়ির ঝুটঝামেলায় জামাইকে বিরক্ত করা যায় ।
আমি চোখ খুলতে গিয়েও থেমে গেলাম । কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে চলে যাক । রাত নটার বেশী বাজে । গ্রামে এই অনেক রাত । এখন ‘শন’ কিনতে বাজারে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না । শন এমন কোন মহার্ঘ্য বস্তু না যে রাতের বেলা না কিনে আনলে তার আবেদন ফুরিয়ে যাবে । শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলাম এক সপ্তাহের ছুটিতে ‘রিলাক্স’ করার জন্যে । আসাটা ঠিক হয়নি । বরিশাল দেখার মত কিছু না । লঞ্চে আসার সময় তো এলাহী কান্ড । প্রবল বাতাসে লঞ্চ টিনের খেলনা নৌকোর মত দুলছে । লোকজন দৌড়াদৌড়ি । চিৎকার-কান্নাকাটি । আমি আমার জীবনে এতোটা ভয় পাই নি । এক সময় তো মনে হলো নদীতে লাফিয়ে পড়তে হবে । শেষ পর্যন্ত আল্লাহ রক্ষা করলেন ।
তার ওপর জায়গাটা বরিশালের প্রত্যন্ত এক এলাকা । দেশান্তরকাঠী । গ্রামের এক প্রান্তে বিরাট ভগ্ন জমিদারবাড়ির মত বিশাল এক বাড়ি । এটাকে ঠিক আমার শ্বশুরবাড়ি বলা চলে না । নীরুর বাবা মারা যাবার পর নীরুর বড় ভাই আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ঢাকায় তার মামার বাসায় গিয়ে ওঠেন ।
ও আচ্ছা, বলা হয় নি । আমার স্ত্রীর নাম নীরু । বিয়ের কাবিননামায় সাক্ষরের সময় যে নাম শুনেছিলাম তা হচ্ছে ‘জুবাইদা গুলশান আরা’ । অত্যন্ত ভয়াবহ নাম । তারচেও ভয়াবহ হচ্ছে এর স্বভাব । রুচিবোধের ‘র’ও এর ভিতর নেই । আমি বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না । বড়চাচার ব্যবসার খাতিরে করতে হল । বড়চাচার কথাই আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত । তার সাথে নীরুর বড় ভাইয়ের অনেকদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক । ঢাকায় এসে নীরুর ভাই লোহার ব্যবসা শুরু করেছিল । একসময় তার ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠে । সে একটা রিকন্ডিশন্ড ‘প্রাডো’ গাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেলে । ওয়ারীতে জমি কেনে । দেশান্তরকাঠীর এই পুরাতন বসতভিটায় এখন মূলতঃ নীরুর চাচারা থাকেন । তাদের বিশাল একান্নবর্তী পরিবার । বলতে গেলে প্রায় সবাই অশিক্ষিত । সবচে শিক্ষিত ছেলেটি এইট পাশ । তাদের সাথে আমার কথাবার্তা হয় না বললেই চলে । কারন তাদের ভাষা আমি ঠিকমত বুঝি না । অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করে দু-একটা বাংলা শব্দ খুঁজে বের করতে হয় ।
ওঘর থেকে চিকন কন্ঠে এক মহিলা ডাক দিলো, ‘ও নিউর্যা, তত্তরী যাইতে ক’ । কানের ভিত্রে তুলা হাইন্দা গ্যাছে ।’
কি বিশ্রী ডাক । ‘নীরু’ খুব সহজেই ‘নিউর্যা’ হয়ে গেছে । নিউর্যা আমাকে অস্থির ভঙ্গিতে আবার ডাকলোঃ ‘একটু উঠুন না ! এই যে ! শুনছেন ! খেয়ে তারপর ঘুমুবেন ।’
যেই মেয়ে আমার হাতে কবিতার বই দেখতে পেয়েও ভাবে আমি ঘুমুচ্ছি, তার ‘হাবলামী’র শাস্তি হওয়া প্রয়োজন । যদিও এখন মনে হচ্ছে, এই কথা সে ইচ্ছাকৃতভাবেই বলেছে । চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়া, ‘শ্বশুরবাড়িতে ঝিমানোর জন্যে আসেন নি’ । বজ্জাত মেয়ে ।
বরিশালের মেয়েগুলো বজ্জাত প্রকৃতিরই হয় । যশোরে পুলিশ লাইন স্কুলে পড়বার সময় হামিদা বানু নাম করে এক বদরাগী ম্যাডামকে পেয়েছিলাম । আমরা ডাকতাম হামানদিস্তা । তার বাড়ি ছিল বরিশাল । হামানদিস্তার মত হারামী মহিলা আমি এ জীবনে দেখিনি । শার্ট খুলিয়ে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল তার শাস্তি দেয়ার ধরন । আমাদের কম্বাইন্ড স্কুল ছিল । মেয়েদের ক্ষেত্রে শাস্তি হতো কানে ধরে হাইবেঞ্চে দাঁড়ানো । ক্লাস টেনে থাকতে আমাদের ‘Enemy of the poets’ ওরফে আশফাক একবার হামানদিস্তার হাতে পড়লো । সে কিছুতেই তার শার্ট খুলবে না । দুহাতে পঞ্চাশটা বেতের বাড়ি নিয়ে সে সন্তুষ্ট মুখে ক্লাস শেষ করেছিল । এর যথেষ্ট উপযুক্ত কারনও ছিল । আশফাকের পছন্দের মেয়েটি আমাদের সাথে এক ক্লাসেই পড়তো । আয়েশা নাম ছিল ওর ।
আয়েশা । শুধু ‘অপূর্ব রূপবতী’ শব্দগুলো দিয়ে আয়েশাকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না । তার মুখ, তার চাহনী, তার কথা- সবকিছুতেই বিস্ময়মাখা সৌন্দর্য মিশে ছিল ! চোখে ছিল ‘জন্ম-কাজল’ । ছোটবেলা থেকেই লম্বা বেনী দুলিয়ে ক্লাসে আসতো । আর আমরা ছেলেরা হা করে তাকিয়ে থাকতাম । ক্লাসের সবাই জানতো আয়েশার কোন কোন রঙের কানের দুল আছে, সে কোন পায়ে পায়েল পরে... ইত্যাদি । আমি যদিও ভাব নিয়ে তাকাতাম না । এমন ভাব করতাম যেন এরকম মেয়ে রাস্তায় বেরোলে অহরহই দেখতে পাওয়া যায় । কিন্তু আমিও জানতাম, শংখগ্রীব আয়েশার গলার নীচের দিকে একটা অপূর্ব তিল আছে । ডানদিকের ভ্রূর পাশেই একটা দাগ । হয়তো অযাচিতভাবেই দূর্ঘটনাবশতঃ কেটে গিয়েছিল শৈশবে কখনও । তবু চাঁদের কলঙ্কের মতই ঐ দাগই যেন তার ‘রূপ’কে ‘অপরূপ’ করে তুলেছিল । হাসলে মনে হতো সমস্ত পৃথিবীকে সাথে নিয়ে হাসছে ...
আয়েশার জন্যে কিইনা করেছিল আশফাক ! আয়েশাকে দেখার জন্য একবার সারারাত ওর বাড়ির বারান্দার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল । শেষ রাতে বৃষ্টির মত হলো । তাতেই পরে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে একাকার । রোজ একটা করে প্রেমপত্র আয়েশার ব্যাগে পাওয়া যেতো । কি প্রক্রিয়ায় আয়েশার ব্যাগে ঐ ‘জিনিস’ চালান করা হতো সেই গূঢ় রহস্য কেবল আশফাকই বলতে পারবে । সবগুলোই ন্যাঁকা-ন্যাঁকা কিম্ভুত বাক্যে সুসজ্জিত । মধ্যিখানে আবার ইংরেজী দু-চার লাইনের কবিতাও থাকতো । হয়তো ফ্রস্ট অথবা কীটস্ -
Therefore on every morrow, are we wreathing
A flowery band to bind us to the earth ...
কার কাছ থেকে যেন আশফাক গোপন তথ্য পেয়েছিল আয়েশা কবিতার বড় ভক্ত । মজার বিষয় হচ্ছে, আশফাক কবিতা দু’চক্ষে দেখতে পারতো না । সে বলতো কবিতা দেখলেই নাকি তার চোখে ‘বেদনা’ হয় । এই বেদনা মনের বেদনা নয় । বেদনার উৎস কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতা ‘তরু’ ।
এই যে বিটপী-শ্রেনী হেরি সারি সারি-
কী আশ্চর্য শোভাময় যাই বলিহারি !
কেহ বা সরল সাধু-হৃদয় যেমন ...
সিক্সে থাকতে সারা রাত বসে বসে খুব কষ্ট করে এই কবিতা সে মুখস্ত করেছিল হাবীব স্যারের ভয়ে । হাবীব স্যার বাংলা পড়াতেন । জাদরেল লোক । সকালে স্কুলে হাবীব স্যার পড়া ধরতে আশফাকের কাছে আসতেই আশফাকের মুখচোখ কোটরে সেঁধিয়ে গেলো । স্যার ওর দিকে বেত তাক করে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘পড়া করিস নাই !’
‘করেছি স্যার ।’
‘বল । ‘তরু’ কবিতার শেষ পাঁচ লাইন বল ।’
আশফাক মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘স্যার, পুরোটা বলি ?’
‘পুরোটা বলবি কেন গাধা !’
‘পুরোটা ছাড়া পারবো না স্যার ।’
‘আচ্ছা । বল দেখি !’
আশফাক শুরুতেই গুবলেট করে ফেলল । ‘বিটপী-শ্রেনী’ হয়ে গেল ‘তরুগণ’ । ‘হেরি সারি সারি’ হয়ে গেলো ‘সারি সারি হেরি’ । প্রথম লাইন বলার পর যখন দ্বিতীয় লাইন বলতে যাবে, তখন সে আটকে গেল । কবিতায় ‘হেরি’র সাথে কোন শব্দের মিল ছিল বলেই তার মনে পড়ছে না । শেষটায় জেনেশুনে সে ‘বলিহারি’কে ‘বলিহেরি’ বানিয়ে দিল । স্যার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুইতো বিরাট গাধা ! কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার না মরে থাকলে তোর আবৃত্তি শুনে নিজে দৌঁড়িয়ে মুদির দোকানে যেতেন । ‘ইঁদুর-মারা বিষ’ কিনতেন । তারপর বিষ খেয়ে আবার আত্মহত্যা করতেন । তুই হচ্ছিস কবিতার শত্রু । কবিদের শত্রু । Enemy of the poets । বই বের করে গুনে বের কর কবিতায় ক’টি অক্ষর আছে । যতগুলো অক্ষর । ততগুলো ডান্ডার বাড়ি । নচ্ছাড়ের ঝাড়বংশ ।’
গুনে শেষ লাইনের চন্দ্রবিন্দুসহ ১৭৭ টি অক্ষর পাওয়া গেলো । স্যার চশমার টেম্পল টিপস দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, ‘ওয়ান সেভেন্টি সেভেন প্লাস টু, ওয়ান সেভেন্টি নাইন । ১৭৯ টা বেতের বাড়ি খাবি । বল । কোথায় খেতে চাস ? হাতে নাকি পশ্চাদ্দেশে ?’
আশফাক ঘেমে নেয়ে কোনমতে মৃদুস্বরে বললো, ‘স্যার দুটা প্লাস হলো কোথা থেকে ?’
‘বেকুবটা বলে কি ? কবিতার নাম ‘তরু’তে কয় অক্ষর ?’
‘দুই’
আশফাকের কথা স্যারের বেত ওঠানোর বাতাসের ‘সাঁই’ শব্দে ঢাকা পড়ে গেলো । তখন শুধু স্যারের ছন্দময় ‘এক-দুই—’ আর বেতের শব্দই কেবল ক্লাসের আকাশ বাতাস জুড়ে । বাসায় পৌঁছেই আশফাক প্রথম যে কাজটি করলো সেটি হচ্ছে তার বাংলা বই বের করা । বইয়ের ‘তরু’ অংকিত পৃষ্ঠাটি সে শতখন্ডে কুচিকুচি করে ছিঁড়ল । তাতেও রাগ না মেটায় অন্যান্য কবিতাগুলিকেও ছেঁড়া হলো । তারপর কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তবে তার শান্তি । ভাবাই যায় না আমাদের সেই ‘কবিতার জাতশত্রু’র লেখা প্রেমপত্রে শুধুমাত্র আয়েশার জন্য কীটস্রাও জায়গা পেয়ে গেছে ! আয়েশা ছাড়া এমন ম্যাজিক পৃথিবীতে আর কোনো মেয়ের পক্ষে কি করা সম্ভব ছিল ? হয়তো ছিল, হয়তো ছিল না ।
কলেজ পাট চুকিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যখন উঠবো উঠবো করছি, আয়েশা আমাদের সবার চোখের সামনেই কি এক অদৃশ্য মায়াবলে যেন আরও বেশি রূপবতী হয়ে যেতে লাগলো । তাকে দেখলে মনে হয় স্বর্গের শাপগ্রস্থা অপ্সরী । যেকোন মুহূর্তে শাপমুক্ত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাবে । সবাই তখন পঙ্গপালের মত যশোর ছেড়ে ঢাকায় চলে আসছে । ঢাকা ভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর এসবের অ্যাডমিশন । বহু ভালো ছাত্রের পদপিষ্ট হয়ে শেষমেষ আমার ঠাঁই হল ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজী সাহিত্যে । ওতেই অনার্স ভর্তি হলাম । আশফাক ভর্তি হলো দর্শনে । আশফাকের মত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র দর্শনে পড়বে ভাবাই যায় না । বিষয় আর কিছুই ছিল না । আয়েশা দর্শন পড়তে ঢাকায় এসেছিল ।
আশফাকের বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি প্রলয় কান্ড । ‘ফিন্যান্স পেয়েও কেউ পায়ে ঠেলে ? এই ছেলে যে নির্বোধ হবে তা আগে থেকেই জানা ছিল ।’ ইত্যাদি... সে দর্শনে ভর্তি হবার জন্যে গৃহত্যাগ পর্যন্ত করলো । গৃহত্যাগী বুদ্ধ আমার মেসে উঠে এলো । আমি তখন মেসেই থাকছি । বড়চাচার বাসায় উঠবার চেয়ে মেসের স্বাধীনতা আমাকে বেশী টেনেছিল । বড়চাচাকে বললাম হলে সিট পাচ্ছি । হলে থাকাটা জরুরী । হল তো দূরের কথা হলের পাশের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেও ভয় লাগতো । এই বুঝি কেউ ধরে ফেলে যে আমি জুনিয়র । পলিটিক্যালি ক্ষমতাবান বড়ভাইদের হাত ছাড়া ভার্সিটির হলে বিছানা মেলে না, এটা তখন স্বতঃসিদ্ধ । মেসে যে একেবারে খারাপ ছিলাম তা নয় । ভাল ছিলাম । আসলে বেশীই ভাল ছিলাম । এই প্রথম ‘মহান স্বাধীনতা’র স্পর্শে মন দ্রবীভূত হলো । গভীর রাত পর্যন্ত মেসে আড্ডা হয়, তাসের আসর চলে । টুয়েন্টি নাইন । তুরুপের নক্কা আসলে কার হাতে লুকিয়ে আছে এই তখন আমাদের নতুন খুঁজে পাওয়া জীবনের মহৎ রহস্য । আমরা রাতের পর রাত রহস্যভেদ করে চলি ।
এসবের ফাঁকে দিনের বেলা আশফাক প্রতিদিন আয়েশার হুডতোলা রিকশার পেছন পেছন সাইকেল নিয়ে ঘুরঘুর করতো । তার সাথে আমাকেও থাকতে হতো । আমি, কাজল আর শুভ । বাতাসে মাঝে মাঝে আয়েশার উড়নার কিছুটা অংশ চাকার দিকে ভেসে যেতো । আমি আশফাককে বলতাম, ‘আরে, উড়না পেঁচিয়ে যাবে তো । ডাক দিয়ে বল্ !’
‘পাগল নাকি তুই ! এখন ডাক দিতে গেলেই ধরা খাবো ।’
‘এটাই তো ভাল । ও যদি না-ই বুঝলো তুই ওর পেছনে ঘুরিস তাহলে ঘুরে লাভটা কি ?’
‘দোস্ত্ ! লাভ হচ্ছে গিয়ে ওর আশেপাশে থাকা । যদি ধরা পড়ে যাই, আশেপাশে থাকার সুযোগটাও হারাবো ।’
কিন্তু আমরা একদিন ধরা পড়েই গেলাম । ধরা পড়াটা ক্ষতির না হয়ে বরং লাভের হলো । ‘Enemy of the poets’ এর সাথে ‘Lover of the poetry’র পরিচয় হয়ে গেলো । প্রথমে পরিচয় । তারপর বন্ধুত্ব । তারপর কোথায় গড়িয়েছিল আমি ঠিক জানি না । তবে প্রতিদিন ক্লাসের পরপর দুজনকে একই রিকশার হুডের নিচে বসে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো । হাতে কখনও আইসক্রীম, কখনও চিপসের প্যাকেট ।
আশফাকের মুখে আয়েশার কত গল্পই না আমরা শুনতাম ! আয়েশার খালামনির গল্প । খালামনির বাসায় অনভ্যস্ত পরিবেশে তাঁর নতুন জীবন । তার ঘরের ঝুলবারান্দার জন্য সাতটি অদ্ভুত জাতের ক্যাকটাস কেনার গল্প । তার দুটো পালা কচ্ছপের গল্প । বড়টার নাম কুট্টুস, ছোটটার নাম পুট্টুস । সারাদিন বারান্দার ঘুপসিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকাই যাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ । শুধু খাওয়ানোর সময় তাদেরকে পানির মধ্যে ছেড়ে দিতে হয় । তখন তাদেরকে শেক্সপীয়ার শোনাতে হয় । নইলে খেতে চায় না । কিছুতেই খাবে না । মাথা খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবে । বের করতে গেলে কামড়ে রক্ত পর্যন্ত বের করে দেয় । একটা কবিতাই এরা প্রতিদিন শোনে । The Phoenix and Turtle । শুনতে শুনতে তারা কিছুক্ষণ মনের আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়ায় । এরপর খাওয়াদাওয়া শুরু করে । আমি প্রথমটাতে শুনে ভীড়মি খেয়েছিলাম । বলে কি ? ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হয়েও এমন কবিতার নাম প্রথম শুনলাম । আশফাক বলল, ‘তোর ইংরেজীতে পড়াটা ঠিক হয় নি । পড়া উচিত ছিল আয়েশার । দুনিয়ার হেন কাব্য কবিতা নাই যা সে জানে না । কি শেক্সপীয়ার ! কী জীবনানন্দ !’ আমি এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলাম যে ঐদিনই নীলক্ষেত গিয়ে খুঁজে খুঁজে কবিতাটা বের করে পড়লাম ।
Here the anthem doth commence:—
Love and constancy is dead;
Phoenix and the turtle fled
In a mutual flame from hence.
So they loved, as love in twain
Had the essence but in one;
Two distincts, division none;
Number there in love was slain.
‘Number there in love was slain’ । বাক্যটা গদ্যে হলে কি ‘There was number slain in love’ হতো ? এর মানে কি ? ভালবাসায় ডুবে সংখ্যা হারিয়ে গেলো ! আশফাককে ক্ষেপানোর জন্যে এই কবিতা খাবার সময় হলেই তার আশেপাশে বসে পড়ে শোনানো হতো । সে যদিও ক্ষেপতো না । উলটো তাকে ক্ষেপাতে গিয়ে আমার-ই খাবার সময় কবিতা পড়ার রোগ হয়ে গেলো ।
কত মায়াময় ঘটনা আয়েশাকে ঘিরে ! আয়েশা মানেই রূপকথার একটা জগৎ । একটা মোহময় অচেনা গল্প । বারংবার শুনতে শুনতে যে গল্প আমাদের মুখস্ত হয়ে গেছে । আয়েশার রবীন্দ্রসঙ্গীতের গলাও নাকি অসাধারন । এই প্রতিভায় পৃথিবীলোকের মধ্যে আয়েশা দ্বিতীয় ।
আমি শুনে অবাক হয়ে বললাম, ‘দ্বিতীয় কেন ? প্রথম কে ? বন্যা ?’
আশফাক আমার চেয়েও অবাককন্ঠে বললো, ‘বন্যা কে ?’
‘রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা । ঐ যে টিভিতে গান গেয়ে বেড়ায় ।’
‘আরে দুত্তোর ! ঐটা কোন কন্ঠ হলো ? প্রথম হচ্ছে গিয়ে নীরা ।’
‘নীরা কে ?’
‘আছে একজন । তুই খালি নীরার ভয়েসে একবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবি । হাঁসফাঁস করতে থাকবি, বুঝলি ?’
‘হাঁসফাঁস করবো কেন ?’
‘শুনে মনে হবে অন্য ভুবনের গান- এইজন্যে হাঁসফাঁস করবি । চিত্তানন্দে মরে যেতে ইচ্ছা করবে । আয়েশারটা শুনলেও করবে । কিন্তু একটু কম । এইজন্যেই আমি এখনও বেঁচে আছি । নীরা মেয়েটার চেহারাও মাশাল্লাহ । আয়েশার চেয়েও ঝলসানো ।’
আমি বুঝলাম আশফাক গুল মারছে । আয়েশার চেয়েও রূপবতী মেয়ে আছে নাকি ? যদিও সে সাধারনত ছেলেদের সঙ্গে গুলবাজি করে না । মেয়েদের সঙ্গে করে । আমি হাত উলটে বললাম, ‘চাপাবাজি না করলে পেটের ভাত হজম হয় না তোর ?’
আশফাক চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, ‘এক লক্ষ টাকা বাজি দোস্ত এক লক্ষ টাকা । আমার কথা বিশ্বাস না হলে চল । আজকেই পুরান ঢাকা যাই । ওদের বাসা হচ্ছে গিয়ে তোর পুরান ঢাকায় । নারিন্দা রোড ।’
‘তোর সাথে দেখা হল কিভাবে ?’
‘বেড়াতে এসেছিল আয়েশার খালামনির বাসাতে । কেমন দূর সম্পর্কের লতায়-পাতায় আত্মীয় । সৌভাগ্যবশতঃ আমি ছিলাম তখন ওদের বাসায় ।’
‘তুই আয়েশাদের বাসাতে যাওয়া-আসা শুরু করলি কবে থেকে ?’
‘এই- হয়ে গেলো বুঝলি ? প্রথমে ভাবলাম রিস্ক নেয়াটা ঠিক হবে না । একবার বাসার লোকজন চিনে গেলে প্রেম-ট্রেম আর হবে না । ঝঞ্ঝাট । পরে দেখলাম, প্রেম এমনিতেই হবে না । তারচে বরং ...’
‘তোদের প্রেম হবে না মানে ? এই যে সারাদিন একসাথে ঘুরে বেড়ানো, একসাথে হৈচৈ করা – এগুলো কি ?’
আশফাক ইতস্ততঃ করে বলল, ‘এগুলি বন্ধুত্ব । আয়েশার মত মেয়ে আমার চাইতে অনেক বেশি কিছুর যোগ্য । তোর কাছে কি মনে হয় না, আয়েশা অন্য জগতের মেয়ে ? রূপকথার কোন রাজকন্যা ? সত্যি করে বল । মনে হয় না ?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম । কিছু বললাম না অবশ্যি । সব কথা বলতে নেই ।
আশফাক বলল, ‘আয়েশা হচ্ছে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথার রাজকন্যা । যে বিশটা জাজিম আর বিশটা পালকের তোশকের উপর শুয়েও বলতে পারবে তার নিচে কয়টা মটরশুঁটি আছে । আয়েশার মত মেয়েকে বিয়ে করতে হলে তাকে ফারএওয়ে দেশের রাজপুত্র হতে হবে বুঝলি ?’
আমি চোখ টিপে বললাম, ‘তাহলে নীরাকে বিয়ে করতে হলে কোন দেশের রাজপুত্র হতে হবে ?’ আশফাক হাসলো । আমি একটু থেমে বললাম, ‘আয়েশার সাথে থাকতে থাকতে তুইতো লিটারেচারের উপর পিএইচডি করে ফেলেছিস !’
আশফাক এবার হো-হো করে হেসে উঠে বলল, ‘তোর কথা আমি প্রায়ই আয়েশাকে বলি বুঝলি ? ভেরী ফানি অ্যান্ড পোয়েটিক ম্যান । চল ! তোকে নিয়ে একদিন ওর সঙ্গে দেখা করে আসি ।’
আয়েশার সাথে যেদিন দেখা হলো সেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে । গুড়গুড় করে বাজ পড়ছে । আমি শার্টের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে কাকভেজা হয়ে মধুর ক্যান্টিনে ঢুকলাম । দেখি আয়েশা আর আশফাক বসা । চা খাচ্ছে । সিঙারা খাচ্ছে । আমি ঢুকতেই আশফাক ডাক দিলো, ‘অ্যাই ! অ্যাই অন্তু !’
আমি মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলাম । বড় বিব্রতকর অবস্থা । শেভ করিনি চার-পাঁচদিনের মতো । মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে আয়েশার দিকে তাকাতে সাহস করলাম না । আশফাককে বললাম, ‘একটু তাড়া আছে রে ! যেতে হবে !’
‘আরে দুত্তোর ! বস্ না ! কি তোমার কাজ বড় ! বসে পড় ।’
আশফাক আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকে তো তুমি চেনোই । আমাদের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র সাইফুল হাসান অন্তু । তোমরা বসে গল্প করো । আমি বরং চট করে ওর জন্য চা-সিঙারা নিয়ে আসি ।’
আমাকে আপত্তির ভঙ্গি করার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে আশফাক চলে গেলো । টেবিলে মুহূর্তের সময়টুকুও বছরের মত মনে হলো । প্রচন্ড আড়ষ্টবোধ করতে লাগলাম । আয়েশা হঠাৎ করেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেক কবিতা পড়া হয়, তাই না ?’
আমি মাথা তুলে আয়েশার দিকে একবার তাকাতেই পাথরের মত হয়ে গেলাম । ভগবান বুদ্ধ আম্রপালীকে দেখে কেন তার শিষ্যদের চোখ চেপে ধরেছিলেন এখন বুঝতে পারলাম । এতো কাছ থেকে এতো সৌন্দর্য দেখবার ক্ষমতা আমার আছে কি ? কেমন মাতালের মত লাগতে লাগলো । আয়েশার কথাগুলো বারবার ঘুরেফিরে এসে কানে বাজছে । টলতে টলতে হঠাৎ কিভাবে যেন সমস্ত জড়তা কেটে গেলো । নির্বিঘ্নে বহু পরিচিত জনের ভঙ্গিতে বললাম, ‘আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, আপনার সঙ্গে প্রথম যেদিন কথা হবে, আপনাকে দুটো প্রশ্ন করবো ।’
আয়েশা চুলের গোছা পেছনে সরাতে সরাতে বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘প্রশ্ন কেন ?’
‘কুইজের মত আর কি ! দেখার ইচ্ছা- কবিতার ব্যাপারে আশফাকের মুখে আপনার যে জ্ঞানের বিশালতার কথা শুনি তা ঠিক কিনা ।’
‘প্রশ্ন করার আগে ‘তুমি’তে চলে আসো । এক স্কুলে, এক কলেজে, এক ইউনিভার্সিটিতে পড়ে ‘আপনি-আপনি’ ধরনের হিপোক্রেসির কোন মানে হয় না, ঠিক তো ?’
আমি তখন অবাক হয়ে ভাবছি, মেয়েটা এতো কঠিন একটা কথা এতো সহজে অকপটে কি করে বলে ফেলল ! আশফাক এক হাতে চা আর এক হাতে আলুর চপ নিয়ে ফিরে এলো । টেবিলে রাখতে রাখতে বললো, ‘সিঙ্গারা শেষ । ঠান্ডা ঠান্ডা পেয়ে সবাই আজ সিঙ্গারার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে । হাহাহা ।’
আয়েশা মিষ্টি গলায় বলল, ‘আশফাক চুপ ! অন্তু এখন আমাকে কুইজ ধরবে ।’
‘কি ধরবে ?’
‘উফ্ আশফাক, চুপ করে থাকো তো ! আমার টেন্সড লাগতেছে । কেন যেন মনে হচ্ছে আমি পারবো না । অন্তু ! শুরু ।’
আমি বললাম, ‘প্রথম প্রশ্নঃ ‘Love is blind’ প্রথম কে লিখেছিল ?’
আয়েশা হেসে ফেলল । বিরাট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলোঃ
'
‘And he chose her, on his own authority;
For love is blind always, and cannot see.’
আমি ভেবেছিলাম কি যেন আমার জন্যে প্রশ্ন সাজিয়ে রেখেছো !! চসার ফ্রম মার্চেন্টস টেল । দ্বিতীয় প্রশ্নটা কি ?’
আমি বিব্রতকন্ঠে বললাম, ‘পাবলো নেরুদার আসল নাম কি ?’
‘আসল নাম মানে ?’
‘আসল নাম মানে আসল নাম । বাবা মায়ের রাখা নাম ।’
আয়েশা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘পাবলো নেরুদার আসল নাম যে পাবলো নেরুদা না, এটাই তো প্রথম শুনলাম ।’
আমি হাসলাম, ‘সাহিত্যবিশারদ ! এটা না জানা তো বিশাল বড় অপরাধ !’
‘তাঁর আসল নাম কি ছিল ?’
‘তোমাকে সেটা বলা হবে না তোমার অপরাধের শাস্তি হিসেবে ।’
আশফাক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘বললাম না, আমাদের অন্তু অনেক জানে !’
ব্যস । সেই থেকে আয়েশার সঙ্গে আমার নিগূঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল । বন্ধুর প্রেমিকাকে ভালবাসা যায় না । তা সেই প্রেম বেঁচেই থাক আর মরেই যাক না বা কেন । নইলে হয়তো বলেই বসতাম আয়েশাকে । এমনই মেয়ে ছিল আয়েশা । আজ কতকাল হয়ে গেল, তবু ‘আয়েশা’ নামটা আমার কাছে অন্যরকম জাদুকরী একটা নাম । ‘আয়েশা’ নামের কারো কথা শুনলেই মনে হয়, ‘আহারে ! কি চমৎকার নাম মেয়েটার ।’ আমার নিজের মেয়ে হলে আমি নিশ্চয়ই তার নাম আয়েশা রাখবো । এখনও পাবলো নেরুদা পড়তে পড়তে কেন যেন মনে হয়, হয়তো আমার প্রথম প্রেমিকার নাম ছিল আয়েশা !
আর তার পাশাপাশি যদি আমার স্ত্রীর মুখটা রাখি, কেমন একটা তীব্র যন্ত্রনা হয় বুকের বাম পাশটায় । নীরু রূপসী । হ্যাঁ, বেশ রূপসী । কিন্তু বড় কাটখোট্টা । ‘মায়া’ জাগানিয়া কোন কিছুই তার বৃত্তের পরিধিতে নেই । ক্যামেস্ট্রী নামের কাটখোট্টা সাবজেক্ট তাকে আরও রূঢ় করে তুলেছে । তার অহংবোধও আমার কাছে অসহ্যকর ! বিষয়টা এমন যেন হিউমিনিটিজের ছাত্র বলে আমরা কিছুই বুঝি না । যা বোঝার সায়েন্সের ছেলেমেয়েরাই বোঝে । তাকে যদি জিজ্ঞেস করি বলতো, ‘‘হান্ড্রেড লাভ সনেটস’ বইটা নেরুদা সাহেব কার জন্যে লিখেছিলেন ?’ সে অবশ্যই বলতে পারবে না । আচ্ছা আয়েশা কি পারতো ?
ওঘরে আমার সেলুলার ফোন বেজে চলেছে । কেউ একজন রিসিভ করলো । খুব সম্ভবতঃ নিরু । অন্যের ফোন ধরার বাজে স্বভাব তার মধ্যে আছে । নিরু মোবাইল হাতে নিয়ে আমার পাশে এসে শান্তকন্ঠে বললো, ‘আপনার এক বন্ধু । আশফাক ।’
আমি তৎক্ষনাৎ চোখ খুললাম । নীরু হয়তো ভাবছে, লোকটা নির্লজ্জ । এতোক্ষণ আমার কাজে ডাকলাম । একটা রা পর্যন্ত করে নি । আর বন্ধুর ফোন এসেছে শুনে উঠে বসেছে । তা ভাবুক । নীরু কি ভাবছে না ভাবছে তা আমার এসে যায় না । নীরু এমন কোন ফ্যাক্টর নয় ।
‘হ্যালো !’
‘শোন । অন্তু ! আমি ডিসির হাট বাজারে এসে পথ এলোমেলো করে ফেলেছি । এখানকার লোকজনও ঠিকানা বুঝতে পারছে না । তোর শ্বশুরবাড়ির কথা কি বললে চিনবে ?’
‘এতো জলদি চলে এসেছিস কি করে ? তোর না সকালে পৌঁছুবার কথা ?’
‘দুত্তোর ! ঐ ইতিহাস পরে বলা যাবে । এখন তুই বাড়ির নামটা বলে ফ্যাল ...’
‘তুই বাজারেই দাঁড়া । আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি ।’
কথায় কথায় ‘দুত্তোর’ বলা আশফাকের স্বভাব । সে এতোদিন ইটালিতে ছিল । দেশে ফিরেছে মাত্র দুদিন আগে । ঢাকায় এসেই আমাকে ফোন । আমি তখন বরিশালে । আমার কথা শুনে সে বললো, ‘গ্রামে আমার একটা ট্যুর দেয়ার প্লান আছে । তোর শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠলে উনারা কি মাইন্ড করবেন নাকি ?’
আশফাক আগের মতন পাগলই আছে । এখনও বিয়ে করেনি । আয়েশার শোকে নয় নিশ্চয়ই । আমি আলনা থেকে ইস্ত্রী করা খয়েরী পাঞ্জাবিটা তুলে নিলাম । দাওয়া থেকে হারিকেনটা তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম । এখন টর্চলাইট খুঁজবার সময় নেই ।
বাজারের দক্ষিন কোনায় এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে আশফাক পিরিচে ঢেলে ঢেলে চা খাচ্ছে । আমাকে দেখে ব্যাগ সরিয়ে বসার জায়গা করে দিয়ে বললো, ‘গুড়ের চা । বেশ ভালো লাগছে । খাবি নাকি ?’ যেন একটু আগেই ওর সাথে আমি তাস খেলা শেষ করে মেস থেকে নিচে নেমে চায়ের দোকানে এসে বসেছি । কি অদ্ভুত ! আশফাক আগের চেয়ে সাস্থ্যবান হয়ে গেছে । সামনে থেকে কিছু চুল পড়ে গেছে । আরও কোথাও যেন সামান্য পরিবর্তন হয়েছে । মৃদু আলোতে ঠিক ধরতে পারছি না ।
আমি বললাম, ‘চা খাবো না । চল । আগে বাড়িতে গিয়ে ফ্রেস হ’ । লং জার্নির উপরে আছিস ।’
আশফাক সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো । ব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো । আমি ওর হাত থেকে ব্যাগ টেনে নিলাম । ও সহজেই ছেড়ে দিয়ে হাসলো । জায়গায় জায়গায় কাদা জমে আছে । বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল । এক হাতে ব্যাগ আর এক হাতে হারিকেন ধরে কাদাভর্তি উঁচু নিচু মেঠোপথ বেয়ে বেয়ে আমি সাবধানে হাঁটতে লাগলাম । মাটির রাস্তা । তার ওপর খুব বেশি পিচ্ছিল হয়ে আছে । চারপাশে জঙ্গলের মতো । ঝিঁঝিঁ পোকার মাথা ঝিমঝিম করানো সহস্র গান । আজ বোধহয় পূর্ণিমা । মেঘলা আকাশে বিশাল বড় একটা চাঁদ উঠেছে । তবে আলো খুব বেশী নেই । গাঢ় মেঘে আকাশ ভর্তি । মনে হচ্ছে মাকড়সার ঝুলের আঠার মধ্যে আটকে একটা আলোর ঝারবাতি দুলছে । এপাশ-ওপাশ, এপাশ-ওপাশ । এই আছে । এই নেই ।
আশফাক পুরোনো বাক্যালাপের রেশ ধরে বললো, ‘জার্নির ওপর থাকলেও খারাপ লাগছে না বুঝলি ? যা দেখছি তাতেই মুগ্ধ হচ্ছি । বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকে বাস করেও কত কিছু জীবনে দেখিইনি ! ছ’মাসের সময় নিয়ে এসেছি । এবার খালি ঘুরবো । বরিশাল কিন্তু বেশ ভালো জায়গা । লঞ্চ ভ্রমনের মত আনন্দময় জার্নি যে আর নেই –এটা ঢাকা-বরিশালের লঞ্চে চড়লে বোঝা যায় । জলজ্যোৎস্না দেখতে দেখতে এলাম । আহা ! নদীতে চাঁদের আলো থৈ থৈ করছে । তার ওপর অজস্র লন্ঠন । টিমটিম আলো । নৌকায় চিৎ হয়ে মাঝিরা ঘুমুচ্ছে । সব কেটে কেটে রাত ভোর করে চলছে রাত্রিগামী লঞ্চ । তোদের এখানে ‘আগুনমুখো’ বলে একটা জায়গা আছে না ?’
‘সেটা আবার কি ?’
‘আরে পাঁচটা নদীর মোহনা । এখানকারই কোন একটা নদীপথে । ঝড়ের সময় নাকি নদীর ঢেউগুলো লাল হয়ে যায় । কি অবাক ব্যাপার ! তুই এখনও দেখিসনি ?’
‘বরিশালে এটা আমার প্রথম আসা । তুই এসব শুনলি কার কাছ থেকে ? নিশ্চয়ই চাপা ।’
‘আরে নাহ্ । আয়েশা চাপা মারার মত মেয়ে না ।’
আমি থমকে দাঁড়ালাম । পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করে সিগারেট ধরালাম । তারপর আশফাকের দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আয়েশা কার কাছ শুনেছে ?’
‘ও আবার কার কাছ থেকে শুনবে ? ওর বাড়ি বরিশাল না ??’
আমি চমকে বললাম, ‘ওর বাড়ি তো যশোর !’
‘আরে কি যে বলিস ! ওর আসল বাড়ি বরিশালের কোথায় যেন ! আংকেল যশোরে চাকরী করতেন । সেই হিসেবে যশোরে থাকা ।’
‘ও আচ্ছা । ওর সাথে তোর যোগাযোগ আছে ?’
‘কথা হয়েছিল দুবার । স্বামীর সাথে সিলেট থাকে । স্বামীটা সুবিধার না । চাকরির দিক থেকে ভালোই । ডিবিতে আছে । ফারএওয়ের রাজপুত্রের মতই চেহারা । হাহাহা । আমি বলছি মন মানসিকতা বা চরিত্রের দিক থেকে । অভিয়াসলি আমি সবটা জানি না । যখন সিলেট যেতে চাইলাম তখন আয়েশার ভয়েস টোন শুনে কিছুটা আন্দাজ করলাম । আয়েশা তো আবার খুব সেনসেটিভ মেয়ে তাই পুরোটা ভেঙে জিজ্ঞেসও করি নি । তবে যেটুকু বুঝলাম... খুব আপসেটিং ব্যাপার । আয়েশার মত মেয়েকে ওর জামাই সহ্য করতে পারে না । হয়তো মারধোরও করে ।...’
‘কি বলছিস এইসব ?’
‘সবার জীবনের পুরোটাই তো আর কবিতার মত হয় না । তোর কথা চিন্তা কর । তোর সাথে কথা বলেই আমি বুঝেছি, বিয়ে করে তুই সুখী না । ঠিক কি না বল ?’
আমি নীরবে সিগারেট টানতে লাগলাম । অন্ধকারে সিগারেটের আলোই দেখা গেল শুধু । আশফাক গাঢ় স্বরে আবৃত্তি করলোঃ
এখানে তোমরা তবু থাকিবে না ?
যাবে চলে তবে কোন পথে ?
সেই পথে আরো শান্তি – আরো বুঝি সাধ ?
আরো বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাংখার ঘর !
যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোন রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাংখার ঘর !
বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর ।
আমি বললাম, ‘চল । হাঁটা শুরু করি ।’
‘আয়েশার সাথে তোর যোগাযোগ নেই ! আশ্চর্য !’
আমি কিছু বললাম না । আশফাক আবার বললো, ‘তুই কি আয়েশাকে কোন চিঠি লিখেছিলি নাকি ?’
আমি হাতের সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেললাম । আশফাক হেসে বললো, ‘ঐ চিঠি পড়েই নাকি সে ধরে ফেলেছে আজ পর্যন্ত আমি তাকে যতগুলো চিঠি দিয়েছি সেগুলোর পত্র লেখক আসলে তুই ।’
‘তোকে কিছু বলেছে ?’
‘হুম । বললো, তুই বোধহয় ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলি । আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে ইন্ডাইরেক্টলি প্রোপোস-ট্রোপোস করেছিল নাকি ? ও বললো, প্রোপোস করলে ভালোই হতো । হয়তো ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলতাম । গ্রেট লস্ করেছিস তুই । হাহাহা । তবে একই কথা, বন্ধু ! ‘যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোন রূপান্তর’ ।’
আমরা দুজনেই হাসতে লাগলাম । আশফাক বললো, ‘আজকে কিন্তু সারারাত বাইরে বাইরে ঘুরবো ।’
‘পাগল নাকি ? এই রাতের বেলা ? তুই আজকে ফ্রেস ঘুম দে । কালকে ঘোরা যাবে ।’
‘আচ্ছা । তোর আপত্তি যখন । চল । খিচুরি খাওয়াতে পারবি ?’
‘ট্রাই করে দেখতে পারি ।’
অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমি অতীতের জগতে হারিয়ে গেলাম । সেই সব সময় চোখের পাতায় জমা হতে লাগলো যখন বড় বড় Essasy আর উপপাদ্যের অনুসিদ্ধান্ত মুখস্থের অবসরে আশফাকের হয়ে বড় বড় প্রেমপত্র লিখে ফেলতাম । আমার মনে হতো আয়েশা বুঝি আমারই প্রেমিকা । অন্ততঃ আমার চিঠিগুলো তো সে পড়ছে । কোন একদিন তাকে পেয়েই আমি গাইবোঃ ‘আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে, তুমি জানো না...’
উঠোনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে কে যেন গুনগুন করে গাইছে । রবীন্দ্রসঙ্গীতঃ
আজি বিজন ঘরে
নিশীথ রাতে
আসবে যদি শূন্য হাতে ...
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । কোথা থেকে যেন একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে । খুব সম্ভবত কাঁঠালীচাঁপা ফুলের । চারদিক মৌ মৌ করছে । জ্যোৎস্না আর কাঁঠালিচাঁপার গানের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে । আশফাক ফিসফিস করে বলল, ‘মার্ভেলাস ! দোস্ত্ । আমি কি শুধু একাই মুগ্ধ হইতেছি ? নাকি তুইও ? কে এই মেয়ে ? আয়েশা তো দেখি ওয়ান ডাউনে নেমে যাবে । এই মেয়ে নীরার চেয়েও ভালো গায় । আল্লার কসম ।’
আমি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে পিছনে দাঁড়ালাম । নীরু চমকে পিছনে তাকিয়েই গান থামিয়ে দিলো । আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি । সে ইতস্ততঃ ভঙ্গিতে বললো, ‘আপনার জন্যে ভাত ঢাকা দিয়ে রেখেছি । চলুন ।’
আশফাক এগিয়ে এসে নীরুর দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বললো, ‘তুমি নীরা না ? হোয়াট আ সারপ্রাইজ ! তুমি এখানে কিভাবে ?’
নীরু বলল, ‘আমিও তো আপনাকে দেখে অবাক । আপনি কোথা থেকে আসলেন ?’
‘কোথা থেকে আসলাম মানে ? আমি এসেছি অন্তুর শ্বশুরবাড়িতে ।’
আমার ঘোর কাটিয়ে বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগলো যে আমার স্ত্রী ‘নীরু’ই রূপকথার আরেকটি চরিত্র নীরা । যাকে দীর্ঘ ছয় মাস খুব কাছ থেকে দেখেও বুঝে উঠতে পারিনি এ সত্যিই একজন রাজকন্যা । যে বিশটি জাজিম আর বিশটি পালকের তোশকের উপর শুয়েও বলতে পারবে তার নিচে থাকা মটরশুঁটির সংখ্যা কত !
আশফাক মুগ্ধ গলায় বলল, ‘আমি তো ভেবেছিলাম নীরা বুঝি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিযোগীতায় দ্বিতীয় হয়ে গেলো । হাহাহা ।’
নীরু ভ্রূ নাচিয়ে অপরিচিত ভঙ্গিতে হাসিমুখে বলল, ‘There is only one of everything…’
‘মার্গারেট অ্যাটৌড ?’, আমি ঘোরলাগা গলায় বললাম ।
নীরু আবারও চমকালো । আশফাক বললো, ‘গান দিয়ে হতে পারে কিন্তু কবিতা দিয়ে কিছুতেই আমাদের অন্তুকে পেছনে ফেলা যাবে না । There is only one of everything । হাহাহা । তো, একটা গানের আসর হয়ে যাক । নাকি ?’
‘আজ হবে না । বাসায় তুলকালাম । ছোটচাচীর কানে কটনবারের তুলা ঢুকে গেছে । পুরোই উলট-পালট অবস্থা । সে চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘর মাথায় তুলেছে ।’
‘আরে এই প্রবলেম তো আমি মিনিটে সল্ভ করবো । চলতো দেখি !’
‘আপনার কাছে কি শন জাতীয় কিছু আছে নাকি ?’
‘শনের বাপ আছে । হাহাহা । চলো ।’
নীরু আশফাককে ভেতরে দিয়ে গেল । আমি বাইরে উঠোনে বসলাম । আমার কাছে এই প্রথমবারের মত উঠোনটাকে বড্ড ভালো লাগতে শুরু করলো । গ্রামটাকেও । ইচ্ছে করলো আশফাককে নিয়ে সারা রাত গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াই । আবছা এই পূর্ণিমার আলোয় স্নান করতে করতে গাইঃ ‘আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে, তুমি জানো না...’
নীরু কখন এসে আমার পিঠের ওপর হাত রাখলো টের পেলাম না ।
‘চলুন । আশফাক ভাইকে খেতে বসিয়ে দিয়েছি । আপাতত ভাত, ডিম ভাজা । সে খিচুরী খেতে চেয়েছিল । ভাবছি চড়িয়ে দেবো । বেচারা এতো লং জার্নি করে এসেছে । আপনি খেতে চলুন ।’
আমি নীরুর হাত ধরে আমার পাশে বসালাম । অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এই প্রথম তাকে ‘তুমি’ সম্বোধনে নরম গলায় বললাম, ‘বলতো, ‘হান্ড্রেড লাভ সনেটস’ বইটা নেরুদা সাহেব কার জন্যে লিখেছিলেন ?’
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ম্যাতিলদে উরূত্তিয়া ।’
‘নেরুদা ম্যাতিলদের একটা অদ্ভুত পোর্ট্রেট করিয়ে তাকে উপহার দেয়ার গল্পটা জানো ?’
‘না ।’
‘ম্যাতিলদে আর নেরুদার গোপন প্রেম ফাঁস হয়ে গেলে নিজের দেশ চিলিতে নেরুদার অপমানিত হওয়ার বেশ সম্ভবনা ছিল । তাই তিনি স্যান্টিয়াগোতে ম্যাতিলদের জন্যে একটি বাড়ি তৈরী করে দিলেন । ম্যাতিলদে বিখ্যাত গায়িকা ছিলেন । এই গায়িকার প্রতি গোপন প্রেমে অধীর হয়ে তিনি ম্যাতিলদের একটি পোর্ট্রেট করিয়েছিলেন । পরে স্যান্টিয়াগোর বাড়িটিতে ছবিটি পাওয়া যায় । অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, পোর্ট্রেটটিতে ম্যাতিলদের দুটি মুখ । একটি মুখ শ্রোতার চিরচেনা প্রিয়মুখ গায়িকা ম্যাতিলদের । অপরটি সবার অচেনা নেরুদার ভালবাসার ম্যাতিলদের । পোর্ট্রেটটিতে আর একটি গোপন ছবি আঁকা ছিল । ম্যাতিলদের দীর্ঘ লাল চুলের নীচে নেরুদার মুখ, যা পরে আবিষ্কৃত হয়েছিল । আমার ইচ্ছে আমি তোমার জন্যে অমন একটি পোর্ট্রেট করাই ।’
অনেকক্ষন কেউ কোন কথা বললাম না । চুপচাপ পাশাপাশি বসে আছি দুজন । নীরুই প্রথম নীরবতা ভাঙলো, ‘আমি অত ভালো শিল্পী নই !’
আমি আমার ভাঙাচোরা কন্ঠ জোড়া লাগিয়ে গাইতে শুরু করলামঃ
আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে ।
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুল গন্ধ
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ
তুমি জানো না...
বুকে রেখেছি তোমার নাম
রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রান !
আকাশ থেকে গলে গলে অজস্র জ্যোৎস্নালোক ঝরতে লাগলো আমাদের দুজনের উপর । আমার সঙ্গে গলা মেলাতে গিয়ে নীরার চোখ ধরে এলো । এখন বৃষ্টি হবে । জীবনের অনিন্দ্যতম বৃষ্টি ।