একটা মেসেজ পেয়ে বেশ অবাক হলাম- আমার নাস্তিক কলিগ কয়েকদিন আগে যার সঙ্গে সালাম দেয়া নিয়ে আমার তুমুল ঝড়গা হয়েছিলো মেসেজটি সে পাঠিয়েছে। শিমু চলে যাওয়ার পর থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি। দু’দিন ধরে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে আছে। পাল্টা মেসেজে নিজের ভালো মন্দের খবর না দিয়ে জানতে চাইলাম- দু’দিনে করোনায় কত জন মারা গেছে।
কলিগ অপন্যা (ছদ্মনাম) বলল, ৪৩ জন, আজকাল কিছুর খোঁজ খবর রাখছেন না, না-কি?
আমি বললাম, না, আজকাল নিজেরই খোঁজ খবরই নেই আর দেশ...
অপন্যা বলল, কেন কি হয়েছে?
আমি বললাম, কিছু না, আমাকে সালাম দিলেন না যে?
অপন্যা হাসির ইমোজি পাঠালো।
এক দুই কথা করে আমাদের অনেক কথা হলো। খুব দ্রুতই যেন আমরা অতিতের ঝগড়ার কথা ভুলে গিয়ে ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। আমার তাই ধারণা। তবে ঝগড়ার দিন আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এই জীবনে আমাদের আর কথা হবে না।
আমি বললাম, অপন্যা! আপনাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম আপনি কিন্তু ততটা না
অপন্যা বলল, আপনিও, আচ্ছা আপনার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন?
আমি বললাম, ঘুমাচ্ছি
অপন্যা বলল, সন্ধ্যার সময় কেউ ঘুমায়? দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেছেন?
আমি বললাম, না
অপন্যা বলল, কেন?
আমি বললাম, এমনি
অপন্যা বলল, কিছু একটা তো হয়েছেই, ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, আর আপনি কিন্তু আমাকে কম খারাপ বলেছেন
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে কিন্তু আমার এতো কথা হওয়ার কথা ছিলো না
অপন্যা বলল, হু, ঠিক বলেছেন। তবে আমার কেন জানি মনে হলো আপনাকে একটা মেসেজ দি
আমি বললাম, কেন, এমনটি মনে হলো কেন?
অপন্যা বলল, অফিস খুলুক, সে কথা পরে বলব
আমি বললাম, কেন আমাকে মেসেজ দিতে ইচ্ছে করল সেটা না হয় আমি বলে দি?
অপন্যা বলল, হু বলেন
আমি বললাম, সেদিন আপনি জোরে জোরে চিৎকার করেছিলেন। কথা আমি শুরু করলেও ঝগড়া আপনি শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশি কথা শুনেছিলাম আমি। আর আমরা সেদিন চাইলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেই কথা বলতে পারতাম।
অপন্যা বলল, হতে পারে
আমি বললাম, অপন্যা! ওয়েট আমি আসছি, এক মিনিট
অপন্যা জিজ্ঞেস করল, এই এক মিনিটে কি করলেন?
আমি বললাম, সিগারেট ধরালাম
অপন্যা বলল, আপনি স্মক করেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে
আমি বললাম, কষ্ট হলেও কিছু করার নেই
মেয়ে জিনিসটা আমার জীবনে কখনই ছিলো না। শিমু প্রথম, শিমুই শেষ। এই শিমুর জন্যই একজন শত্রু আজ আমাকে উপদেশ দিচ্ছে। আমিও সব ভুলে গিয়ে তার কাছেই সব শেয়ার করছি। অপন্যা আমার কষ্টের কথা শুনে আমাকে হুমায়ূন স্যারের একগাদা উপদেশ ও উক্তি পড়ে শোনালো। নাম্বার চাইলে আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। একবার বলে দিলেই হতো নেট থেকে পড়ে নিতাম। মেয়েটা হঠাৎ করে এতো দরদ দেখাচ্ছে কেন কে জানে। মেয়ে মানুষ বোঝা আসলেই মুশকিল কি বাত।
হঠাৎ ফোন কেটে গেলো। আমার ফোনে কখনও ব্যালেঞ্চ থাকে না। তাই ব্যাক করতে পারলাম না। উঠে লম্বা একটা গোসল দিলাম। দুই দিনেই যেন পৃথিবীটা বদলে গেছে। করোনা, আম্ফান ও শিমু। সবাই বীভৎস। সবাই প্রবল প্রতাপে পৃথিবী ও মানুষকে ধ্বংস করতে চায়, ধ্বংস করেছে বা করছে। একদিন যার হাসির প্রশংসা করতাম আজ তাকে বীভৎস তাকে বীভৎস বলছি। ছিহ।
আমি বোধ হয় এক হাতে তালি বাজাবার চেষ্টা করেছি। মেয়েদের আবেগ টাকার বাতাসে সত্যি উড়ে যায়। অপন্যা বলল, একদিন নাকি অনেক মেয়ে আমার প্রেমে পড়বে। শুনে হাসিই পাচ্ছিল। অপন্যা মেয়েটিকে আমি যতটা জ্ঞানী মনে করতাম ততটা না। একটি সরল শিশুর মতোই মনে হলো।
everything has an expiry date
যাইহোক, আমরা সবাই একদিন মরে যাবো। আজ হোক আর কাল হোক মরতে আমাদের হবেই। মৃত্যুই বোধ হয় পৃথিবীর সবথেকে সত্যি একটা বস্তু। মানুষ পৃথিবীতে আসছে, খাচ্ছে দাচ্ছে, পৃথিবীতে কিছুটা উন্নতি সাধন করছে, মরে যাচ্চে। ভালো মানুষও মরছে, খারাপ লোকও মরছে। অনেকে বলে অমরত্বই হলো আসল। শুধু যে, ভালো মানুষ অমর হয় তা কিন্তু নয়। পৃথিবীতে কতো কতো খারাপ লোকই না অমর হয়ে আছে। খারাপ কাজ করেও অমর হওয়া যায় এবং ঢের বেশি অমর হওয়া যায়।
ভালো মানুষ হওয়ার দরকার কি? শুধুই কি অমরত্ব? খারাপ লোক হলে বা ক্ষতি কি?
নিজের কষ্টের কথাটা কোনোদিন সুন্দর করে বলতে পারলাম না। আমি মনে হয়, ভালোবাসাটাও বোঝাতে পারি না।
শৈশবে আমার খুব ভালো একটা বন্ধু ছিলো। তার নাম ছিলো আমার ছোট ভাইয়ের নামে- আল আমিন। আলামিনের বাবা ছিলো না। আমাদের এতো ভালো সম্পর্ক ছিলো যে, আমরা একে অপরকে রেখে কিছু খেতাম না। দু’জনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আজীবন একসঙ্গে থাকবো। এরপরের বছরই আমি খুলনা থেকে বাগেরহাট চলে আসি। নানুবাড়ি থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাই। তার কয়েক বছর পর ঢাকায় চলে আসি আর এভাবেই আমাদের বিচ্ছেদ হয়। আজও আলামিনের কথা মনে আছে। অনেক অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। কিন্তু একফোটা কষ্ট নেই। তবে খারাপ লাগে একারণে যে, ছেলেটি টাকার অভাবে পড়তে পারেনি। এখন সে গার্মেসে কাজ করে।
শিমু আমার প্রথম প্রেম এটা বললে ভুল হবে। এর আগেও আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। এখন বাসি কিনা বুঝতে পারি না। মেয়েটি আমার দুই বছরের বড়। প্রায় তিন বছর যাবৎ মেয়েটিকে শুধু দেখেছি। কোনোদিন বলতে পারিনি ভালোবাসার কথা। মেয়েটির সঙ্গে কথা যে হয়নি তা নয়। অনেক কথা হয়েছে, হাসি তামাশা হয়েছে, লুডু খেলা হয়েছে, কাছ থেকে দেখাও হয়েছে শুধু বলা হয়নি। খবর পেয়েছি কয়েকদিন আগে এক বিদেশি ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। মেয়েরা নাকি চোখ দেখেই সব বুঝতে পারে। অনেকবার আমাদের চোখাচোখি হয়েছে। মেয়েটি কিছু বুঝতে পেরেছে কিনা আজও জানিনা।
শিমুর সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে আর সে আমার তিন বছরের বড়। কিন্তু বিয়ে-শাদির ব্যাপারে আমার কোনও আপত্তি নেই। শিমু নাকি তার ভাইকে আমাদের প্রেমের কথা বলেছে। সত্যি কতটুকু আমি জানিনা। ফেসবুক থেকে প্রেম, কি হাস্যকরই না লাগছে। তাইনা? আমারও কাছেও লাগছে। একটু হেসেনি, হা হা হা। তবে আমাদের সম্পর্কটা অনেকদিনের। স্যোশাল সম্পর্ক হলেও একসময় এটি আর স্যোশাল থাকেনি।
অপন্যাকে বলেছিলাম, আমার না সব মেয়েকে এখন কেন জানি ঘিন্না লাগছে। যদিও একজন নারীই আমাকে জন্ম দিয়েছে। পরের কথাটা বলেছি এজন্য যে, ওটা না বললে খুব লজিক্যাল মেয়েটিও এখন আমাকে এই একটি কথাই শোনাতো।
আমি আবার বললাম, অপন্যা আপনাকে কিন্তু একদিন ইনশাল্লাহ বলতে শুনেছিলাম।
অপন্যা বলল, এবিষয় নিয়ে এখন আমি আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না। আগে অফিস খুলুক।
আমি বললাম, অফিস খোলার দেরি আছে। অফিসের ৭ জনের করোনা পজেটিভ। সবাই সিনিয়র সাব-এডিটর।
অপন্যা বলল, হু জানি
আমি বললাম, চাইলে আমরা মেসেঞ্জারেই মাঝে মাঝে ঝগড়া করতে পারি। তবে মনে রাখবেন, হেরে গেলেও আমরা আমাদের বিশ্বাস থেকে সরে আসবো না
অপন্যা বলল, কেন?
আমি বললাম, কারণ হলো, আমরা যার যার ধর্ম নির্দিষ্ট করেই নিয়েছি
অপন্যা বলল, নাস্তিকতা ধর্ম নয় বরং উদারতা
আমি বললাম, তাহলে উদারতা কি? নাস্তিকতা ছাড়া উদার হওয়া যায় না?
অপন্যাকে বললাম, আপনার মন মানসিকার অনেক লোক আছে আমাদের ব্লগে। যারা মনে করে ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়ে গাল দেওয়াই হলো নাস্তিকতা। এদের অনেকেই হয়ত শিব লিঙ্গের পুজো করে থাকবে। কারণ, আমি এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যারা নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে আবার তারা শিব লিঙ্গের পুজোও করে। অপন্যা! চাইলে আপনিও ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন।
অপন্যার মতো মেয়েরা লাভ খুঁজবে এটাই স্বাভাবিক। ব্লগে আস্তিক নাস্তিকদের কাদা ছোড়াছুড়ি হয়। এটির মাধ্যমে আপনি আপনার নিজেস্ব চিন্তা-ভাবনা ছড়িয়ে দিতে পারবেন। অনেক ভালো ভালো লেখা পাওয়া যায়। এগুলো থেকে কিছু শিখতে পারবেন। ভালো গল্প কবিতা পড়তে পারবেন। আবার গল্প, কবিতা ও উপন্যাস লেখতেও পারবেন। এখানে সব তবকার মহাজ্ঞানী, পণ্ডিত ও বিশ্লেষক আছে যারা আপনার লেখা পড়ে মন্তব্য করবে। তাতে নিজের ভুল শুদ্ধ হবে ও শুদ্ধতা ছড়িয়ে যাবে।
অপন্যা বলল, আচ্ছা এসব তর্ক-বিতর্ক বাদ দেন। আমি একটা জিনিস বুঝি, তা হলো এই তর্ক যেদিন থেকে শুরু হয়েছে তা কিয়ামত পর্যন্ত আর শেষ হবে না
আমি হাসির ইমোজি পাঠিয়ে বললাম, কিয়ামত ব্যাঙ্গ করে বলছেন নাতো?
অপন্যা বলল, মেয়েটির সঙ্গে কি আপনার একদম ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?
আমি বললাম, না, তবে আপনার কথা সত্যি হলে সে কয়েকদিনের মধ্যে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবে না। আমি চাই সবসময় আমাদের সম্পর্ক অটুট থাকুক। আমাদের কথাবার্তা হোক। কিন্তু বিয়ের পর মেয়েটির বেশির ভাগ সময় বিদেশে কাটবে। এটা অবশ্য যোগাযোগ রাখার ক্ষেত্রে কোনো বাধা না তবে ইতিমধ্যে সে কথাটা বলে ফেলেছে। এবং বোঝাতে চেয়েছে এই জন্য সে বেশি যোগাযোগ করতে পারবে না।
অপন্যা বলল, আপনারা বন্ধু হয়ে থাকতে পারেন। গালফ্রেন্ড বন্ধু হলে খুব ভালো বন্ধু হয়।
আমি বললাম, অপন্যা! আপনি একটু আগে বললেন, আমি একহাতে তালি বাজাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাজাতে পারিনি। এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। শিমুর সঙ্গে বন্ধু মানে...।
অপন্যা বলল, হয়ত মেয়েটি সত্যি আপনাকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
আমি বললাম, এই মেয়েকে বিয়ে করতে হলে আমারও অনেক ধকল পোহাতে হত বা হবে। প্রেম ভালোবাসার মধ্যে সবসময় বাধা থাকেই। এটা জয় করেই শান্তি আসবে। কষ্ট ছাড়া শান্তি প্রত্যাশা ভুল এটা ওতো একটু আগে আপনি বললেন।
অপন্যা Wait লিখে চলে গেলো। আমি বসে রইলাম। কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে বুঝতেই পারিনি। দু’দিন আগে ঈদের দিন পোশাক পরিস্কার করে ছাদে সুকাতে দিয়েছিলাম। কেবল মনে পড়লো। কাল সকালেই আবার ধুতে হবে। নিজের পায়ে পায়ে বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে কপাল খানিক কেটে গেছে। খুব ব্যথা করছে এখন। আমি আম্মুর কাছে কিছু লুকোই না। ইদানীং লুকোতে শুরু করেছি। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। অপন্যা মেয়েটির সঙ্গে এসব অহেতুক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। আমি আসলেই খারাপ। নিজের বিষণ্নতার সময়েও পুরোনা ঝগড়া ভুলতে পারিনি। ঈদের দিন আমার এক বড় ভাই এবং স্যার খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন। পরে খাবো বলে রেখে দিয়েছিলাম। খাবারগুলো পচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। ভাবছি এখনই যদি আমার মৃত্যু হয়ে যেতো। আবার ভাবছি আল্লাহ রাগ করে যেন মৃত্যু না দিয়ে দেন। মৃত্যু চাইলে ঈশ্বর রাগ হন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২০ রাত ১:৫৫