সেদিন রাতে রেস্ট হাউজের ছাদে তর্ক জমে উঠল । বিষয়ঃ অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ।
সবার পরিবারে কিছু না কিছু ঘটেছে ; সেগুলো নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল । ভূত বা অশরিরী আত্মা অথবা অন্য যে নামেই বলি না কেন – Paranormal কিছুর অস্তিত্বে সবচেয়ে বিশ্বাস বেশি তন্ময়ের । তন্ময় বড় হয়েছে কক্সবাজার শহরের এক পাশে – মফস্বল গুলোতে এধরনের ঘটনা নিয়ে অনেক গল্প থাকে । সব চাইতে বড় ব্যাপার , আমদের মাঝে ওর-ই কেবল সরাসরি ‘অতিপ্রাকৃতিক’ অভিজ্ঞতা আছে ।
আর বিতর্কের অন্যপ্রান্তে ছিলাম আমি ; ঘটনা থেকে অনেক দূরে থেকেও আমার যুক্তিবাদী মন ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল ।
কেস স্টাডি ১ ঃ
ঘটনা তন্ময়ের । ওর পাশের তিন তলা বাড়িতেতে মামারা থাকতেন । সে বাড়ির দোতলাতে ওর এক মামী গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন । সেই থেকে বাড়ির সবাই তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে দেখতে পান ।
সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল । তন্ময় কোন কাজে মামাদের তিন তলাতে যাচ্ছিল । দোতলাতে উঠেই ও একটু থমকে দাঁড়ালো । জায়গাটা ছিল অন্ধকার ; এবং ওর ভাষাতে ‘অন্য’ কিছুর অস্তিত্ব সে অনুভব করছে । এর পরেই ঘটল ঘটনা টাঃ
কেউ একজন নূপুর পরে করিডর দিয়ে হেঁটে আসছে – নূপুরের শব্দ ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে , কিন্তু তন্ময় কাউকে দেখতে পাচ্ছে না । শব্দটা ঠিক ওর সামনে থেমে গেল – চারদিক ঠান্ডা – ও হঠাৎ নিজেকে ফিরে পেয়ে ছুটে তিন তলাতে মামীদের ঘরে চলে গেল ।
এর পরে থেকে ও সন্ধ্যার পরে সেই দোতলা মাড়ায় নি ।
আমার ব্যাখ্যাঃ
কারো সরাসরি অভিজ্ঞতা কে ব্যাখ্যা করা কঠিন । ওর কাজিনরা ওই ঘরে এক মহিলাকে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত থাকতে দেখেছে । তার পরে ওর এই অভিজ্ঞতা – ওর বিশ্বাস ভাঙ্গানো কঠিন ।
তবে আমার ব্যাখ্যাটা আমি দিয়েছি । আর কিছু না , ও স্ট্রেসড ছিল , ও জানে এখানে নূপুর পরে একজন মারা গিয়েছে – অপমৃত্যু । ওর মন ওকে তাই দেখিয়েছে যা ও দেখতে চেয়েছে ।
‘আর আমার আত্মীয়রা যে দেখেছে সেটা ?’
এই প্রশ্নের জবাব আমার জন্যে দেওয়া কঠিন । আমি বলি , ‘তোর প্রথমে যেমন অডিটরি হ্যালুসিনেশন হয়েছে , ওদের ধীরে ধীরে সেটা ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশানে পরিণত হয়েছে ।’
তর্ক না করলেও অবিশ্বাসী দৃষ্টি নিয়ে তন্ময় তাকিয়ে থাকে । নিজের জীবনের অমন অভিজ্ঞতাকে আমি নিজেও নাকচ করে দিতে পারব কি না, জানি না । ওকে দোষ দিই না ।
কেস স্টাডি ২ ঃ
আবারো তন্ময়ের গল্প । এবার অবশ্য অভিজ্ঞতা ওর খালার ।
তখন ওর খালার বয়েস ১৭-১৮ । ওর খালারা তখন গ্রামে থাকতেন । একদিন রাতে , প্রায় ১.৩০টার দিকে ওর খালা প্রকৃতির ডাকে বাইরে বের হল ; এ সময় সাধারণত ওর নানুও সাথে যান ; কিন্তু সেরাতে ওর খালা একাই বের হলেন ।
প্রায় দেড়-দু ঘন্টা পরে নানু দেখলেন খালা এখনো ফিরে আসেন নি । উনি তন্ময়ের মামাকে নিয়ে বের হলেন ।
খালাকে পাওয়া গেল একটু জংলার মাঝে , কারো সাথে কথা বলছেন তিনি ।
সেই শুরু । আজ বোধ হয় দশ বছর হল , এখনো তিনি কথা বলেন ; দুই জনের সাথে । ওদের নামও আছে ; সারাক্ষন তাদের সাথে কথা বলে সময় কাটান খালা । আপনি গেলে উনি আপনার সাথেও তাদের পরিচয় করিয়ে দিবেন ।
আমার ব্যাখ্যাঃ
এই ব্যাখ্যাটা দেওয়া তুলনামূলক ভাবে সহজ ; সিজোফ্রেনিয়া নামের সাথে সবাই কম বেশি পরিচিত । তবে যেহেতু ওনাকে কখনোই কোন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয় নি – আমার ধারনাকে যাচাই করার সুযোগটা তাই থাকছে না ।
কেস স্টাডি ৩ ঃ
এই ঘটনাটা সুমনের কাজিনের ।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেছে । হঠাৎ তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । উপায় না দেখে সুমনের কাজিন , সজিব একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিল ।
ঝড় যেন বেড়েই চলেছে । হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠছে ক্ষনিকের জন্যে । উপরের দিকে তাকাল এবং এমনি এক বিদ্যুতের ঝলকে চোখ পড়ল লোকটাকে ।
অনেক বয়স্ক , চেহারাটা বিভৎস – সজিব এটুকুই বলতে পেরেছিল পরে । গাছের উপর থেকে ওর নাম ধরে ডাক ছিল ; এক পর্যায়ে হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটি ধরার জন্যে । ঝড় মাথায় করে ছুটতে থাকে সজিব । এবং বাসায় কোন মতে পৌছেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ।
পূর্ণ স্বাভাবিক হতে প্রায় এক মাস সময় লাগে ওর ।
আমার ব্যাখ্যাঃ
ঝড়ের রাত আলো-আধারির খেলা । মানুষের মন অনেক শক্তিশালী । প্রথম কেস এর মত এখানেও একই কথা বলা যায় । গাছের শাখা-প্রশাখা , ডাল-পালা মিলে একটা আকৃতি হয়ত ঠিক-ই দেখেছে ; কিন্তু বাকিটা শ্রান্ত মন তৈরি করে দিয়েছে ।
শেষ কেসঃ
এটা আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা । অবশ্য কোন অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা নয় … তবে এই ব্যাপারটা হয়ত উপরের কেস গুলোতে আমার ব্যাখ্যাকে শক্তিশালী করবে ।
তখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি । ছোট বেলা থেকেই সব কিছু নিয়ে চিন্তা করতে ভাল লাগত । তার উপর অনেক বই পড়তাম । আসলে এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার । চোখের সমস্যা (মাইওপিয়া) ধরতে এত সময় চলে গেছে , আউটডোর গেমসে সমবয়সীদের চাইতে আমি অনেক পেছনে । কম্পিউটার আর বই ছিল নিত্যসংগী ।
আর ছিল আমার ফ্যান্টাসী । সারাদিন ধরে নিজের বানানো জগৎগুলোতে ডুবে থাকতে ভালবাসতাম । ধীরে ধীরে আমার কল্পনার জগৎ বাস্তবকে গ্রাস করে ফেলতে থাকল ।
আমি আমার রুমে হাঁটতাম, ( এখনো হাটি) , আর আমার ফ্যন্টাসিগুলো নিয়ে ভাবতাম । সমস্যা হল তখন - যখন আমি বাস্তব আর কল্পনাকে এক করে ফেলতে শুরু করলাম ।
যেমন , হয়ত আমি হেঁটে যাচ্ছি ; পথে কারো সাথে দেখা হল – আমাকে কিছু বলল , আমিও জবাব দিলাম হাসিমুখে ।
একদিন আবিষ্কার করলাম , আমি এই ছোট আলোচনাগুলোতে – আমি মাঝে মাঝে উত্তর গুলো দিচ্ছি কল্পনার জগতেই – বাস্তবে আমি একটা কথাও বলিনি ।
সাথে সাথে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, no more fantasy . ফ্যান্টাসী গুলোকে ঝেড়ে ফেলতে কষ্ট হয়েছে অনেক , আসলে কখনোই সেগুলো সম্পূর্ণ ভাবে চলে যায় নি ; কিন্তু আমার সমস্যাটা থেকে বের হয়ে আসতে পেরছি অবশেষে ।
একটু ছাড় দিতে হয়েছে ।
যে আমি আগে সামান্য ছোট্ট ব্যাপারগুলোকেও বেশ গুছিয়ে বলতে পারতাম – সামান্য ঘটনাগুলো নিয়ে গল্প বানিয়ে ফেলতাম , সেটা এখন আর পারি না । যে আমি সেই এগার-বার বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখে ফেলছিলাম , আজকে এখানে বসে সামান্য একটা পোস্ট করতে পারি না !
কিছু লিখতে চাই – সেটা ভেতরে আটকে যাওয়া যে ভীষণ কষ্ট !
মন্তব্যঃ
এ ধরনের অভিজ্ঞতা থাকতে পারে আপনার – অথবা আপনার কোন কাছের মানুষের । ‘অন্য কিছু’ তে বিশ্বাস থাকুক অথবা না থাকুক , ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলি । আর কিছু হোক বা না হোক, একটা ছোট খাট আড্ডা তো দেওয়া যাবে !