দৃশ্য-১
বৃহস্পতিবারে দুপুরের ঘড়িতে যখন ঠিক বারোটা বেজে ওঠে, সাইফের ক্লাস ঠিক তখনই শেষ হয়। আচমকাই শান্ত ক্লাস হৈ হুল্লোড়ে ভরে ওঠে। কারণ আজকে থেকেই শুরু হচ্ছে ওদের শীতকালীন ছুটি। আসন্ন ছুটিতে কার কী পরিকল্পনা, কে কোথায় ঘুরতে যাবে, এসব গল্প করতে করতে পুরো কলেজটাই যেন রাস্তায় নেমে আসে! সময়ের সাথে সাথে কলেজের সদর দরজায় ভীড় কমতে থাকে, যে যার বাসার দিকে ছুটতে থাকে। সাইফের বাসা কলেজ থেকে খুব বেশি দুরে নয়, হেটে গেলে হয়তো ২০-২৫ মিনিটের রাস্তা, আর রিকশায় ১০-১৫ টাকার ভাড়া । ও হেটে যেতেই ভালোবাসে! তাহলে বন্ধু-সহপাঠীদের সাথে গল্প করতে করতে চলে আসা যায়। চারিদিকটা ভালমত দেখা যায়। আজকে সাইফ বন্ধুদের সাথে মসজিদ মোড়ের রাস্তাটা ধরেছে, রাস্তাটার নাম দুদিন আগেই দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে নাম সহকারে বিশাল একটা সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে! দুদিন আগেও এ রাস্তার নাম ছিল গিরিঙ্গির মোড়। এক কালে এলাকার সব গিরিঙ্গিবাজরা এই মোড়ে আড্ডা দিতো। দিন বদলেছে, মানুষ বদলেছে, তাই এলাকাবাসী সুন্দর একটা নাম দিয়েছে মোড়ের।
-দেখ সাইফ, ওই পিচ্চিটা বিড়ালের বাচ্চাটাকে কী কষ্ট দিচ্ছে!
বন্ধুর কথায়, তার আঙুলের ইশারার দিকে তাকালো সাইফ, একটা টোকাই দড়িতে বাঁধা একটা ফুটফুটে বিড়ালছানাকে ডাঁটাচ্ছে, শাষাচ্ছে, হাত তুলে এমন ভঙ্গি করছে যেন মারবে! সাইফ পশু-পাখি খুব ভালোবাসে, এদের উপর কোন অত্যাচার সহ্য করতে পারে না। সাইফ এগিয়ে গিয়ে টোকাইটার হাত থেকে বিড়াল ছানার গলায় বাধা দড়িটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো!
- এভাবে কেউ নিরিহ প্রাণীদেরকে অত্যাচার করে? এখন যদি আমি তোমার গলায় দড়ি বাধিয়ে ঘুরে বেড়াই, মারি তখন কেমন লাগবে? ওরা কথা বলতে পারেনা বলে, অনুভুতি প্রকাশ করতে পারেনা বলে ওদের উপর নিষ্ঠুরতা চালাবে?
সাইফের হঠাৎ আক্রমনে টোকাই ছেলেটা যেন ভয়ে ভেতরে সেধিয়ে গেল। সাইফকে দেখলেই বোঝা যায় বড় ঘরের ছেলে, ওর মত টোকাই কেমন করে ওর সাথে লাগতে যায়। সাইফ বিড়ালের বাচ্চাটাকে সাবধানে কোলে তুলে নিলো,
-ইস এই শীতে বাচ্চাটার সারা গাঁ ভেজা, নিশ্চয়ই পানিতে চুবিয়ে কষ্ট দিয়েছো? আর কখনো যেন এমন না করতে দেখি।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় টোকাইটাকে পেছনে রেখে বন্ধুদের সাথে হাঁটা শুরু করলো সাইফ। ওদিকে সাইফের গায়ের ওম পেয়ে বিড়াল ছানাটা গুড়গুড় করা শুরু করে দিয়েছে
দৃশ্য-২
সোনাই মনটা খারাপ করে সাইফদের বাড়ির থেকে কিছু দুরে দাড়িয়ে আছে, মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে আছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে পেটের দায়ে মায়ের সাথে শহরে আসে সে, শহরের বস্তিতে হয় আশ্রয়। মাস ছয়েক আগে ওর মাও রোড এক্সিডেন্ট করে মারা যায়। তারপর থেকে আশ্রয় বলতে রাস্তার ফুটপাত, আর এক দেড় মাস হলো সঙ্গী বলতে একমাত্র তুলসী! তুলসী ওর পোষা বিড়াল ছানার নাম, রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। বৃষ্টির জলের তোড়ে প্রায় ভেসে চলে যাচ্ছিলো, কোনমতে রক্ষা করেছে সোনাই। তারপর থেকে দুই ভাসমানের দোস্তি, সব সময় একসাথেই থাকে দুই ভাসমান প্রাণ। কিছুক্ষণের জন্যে একটু ব্যস্ত হয়েছিল সোনাই, ঘুরে দেখে তুলসী নাই! অনেক খুজে পরে দেখে রাস্তার পাশে ড্রেনের মধ্যে পড়ে ট্যা ট্যা করছে। তুলসিকে উঠিয়ে আশরাফ চাচার হোটেল থেকে পানি নিয়ে ধুইয়ে দিয়েছিল সোনাই। পরে এই দুষ্টুমী আর বোকামীর জন্যে বকা দিচ্ছিল তুলসীকে, এমন সময় এক বড় লোকের ছেলে এসে যা তা বকা ঝকা করে তুলসীকে কেড়ে নেয়। ভয়ে প্রথমে কিছু বলতে না পারলেও, দুর থেকে ছেলেটাকে অনুসরণ করে এই বাসার সামনে এসে পৌছেছে সোনাই। গত ৩ ঘন্টায় কয়েকবার উকি ঝুকি মেরেছে বাড়ির ভেতরে, তুলসীকে দেখতে পায়নি। ভেতরে কোথাও নিয়ে গেছে তুলসীকে। এর মধ্যে শেষবার উকি দেয়ার সময় বাড়ির দারোয়ান আবার দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ক্লান্ত লাগছে খুব, এই ঝামেলায় পড়ে দুপুরে খাওয়ার কথাও মাথায় আসেনি। এখন অভুক্ত পেটের দুর্বলতায় মাথা ঝিম ঝিম করছে। সোনাই একটু এগিয়ে গিয়ে সাইফদের বাড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লো, তন্দ্রায় চোখ নেমে আসছে। কতটুকু সময় ঝিমিয়েছে বলতে পারবে না সোনাই, পায়ে কিছুর পেলব স্পর্শে আর পরিচিত ম্যাও ম্যাও শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সোনাই এর, চোখ মেলে দেখে তুলসী এসে পায়ে মাথা ঘষছে! চট করে দেখে নিলো ও আশে পাশে কেউ আছে কি না? এর পর তুলসীকে কোলে তুলে দৌড় শুরু করলো সোনাই, এই বাসা থেকে যথেষ্ট দুরে না পৌছালে থামবে না ও...
দৃশ্য-৩
গিরিশ কাকার উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে সাইফের। গিরিশ কাকা ওদের বাসার দারোয়ান। বিড়ালছানাটাকে খাইয়ে দিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে নিজে খেয়ে ঘুমিয়েছে উঠে দেখে ছানাটা নেই। বাসা থেকে একটা জলজ্যান্ত বিড়ালের বাচ্চা গায়েব হয়ে গেল, আর উনি নাকি সদর দরজা দিয়ে কোন বিড়ালই বের হতে বা ঢুকতে দেখেন নাই। আর বাসার কাজের বুয়াটাও কেমন, বাসা ঝাড়ু দিয়ে ময়লা বের করে দরজাটা ঠিকমত লাগাবে না? তাহলেই তো বিড়াল ছানাটা বের হতে পারে না। সাইফকে মন বেজার করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে গিরিশ কাকা কাঁচুমাঁচু হয়ে বললেন, “আংকেল, এতো ছোট একটা বিড়ালের বাচ্চা, বের হয়া গেছে হয়তো। খেয়াল করতে পারিনি।”
সাইফ প্রশ্ন করলো, “আশে পাশে কাউকে ঘুর ঘুর করতে দেখেছেন?”
গিরিশ কাকা একটু ভেবে উত্তর দিলেন, “একটা পিচ্চি ছেমড়া এসে বারবার ঘুরঘুর করছিলো, আমি পরে তাড়ায় দিয়েছি।”
“তার মানে মনে হয় ওই টোকাই ছেলেটাই..” মনে মনে ভাবলো সাইফ, “না জানি কত অত্যাচার করছে বিড়ালের বাচ্চাটার উপরে, আল্লাহ্ই মা’লুম!”
“আসসালামু আলাইকুম, তারিফ?” মোবাইল হাতে নিয়ে বন্ধুকে কল দিলো সাইফ, বিড়ালছানাটাকে উদ্ধার করাই লাগবে!
দৃশ্য-৪
এপেক্সের শো রুম থেকে একটু সামনে গেলে যে ওভারব্রিজটা পড়ে, তার ঠিক পাশে ফুটপাতের একটু ভিতরে বন্ধ ঔষধের দোকানগুলোর সামনে রাত কাটায় সোনাই। ওর মতো আরো অনেক ছিন্নমূল নাগরিকের আশ্রয়স্থল এ এলাকা। মাঝে মাঝেই পুলিশের লাত্থি গুতো খেতে হয়, কিন্তু জায়গাটা বেশ। এক পাশে বিল্ডিংয়ের একটু ঘের থাকায় রাতে ঠাণ্ডা বাতাস একটু হলেও কম পড়ে গায়ের উপর। কিন্তু আজকে মনে হয় ঠাণ্ডা একটু বেশীই পড়েছে। কিছুক্ষণ আগেই তুলসীকে গরম দুধ খাইয়েছে করীম চাচার চায়ের দোকান থেকে। তুলসীকে প্রতিদিন দুধ কিনে খাওয়াতে পারে না সোনাই। কিন্তু আজকে হল বিশেষ দিন, আজ একটু হলেই হারাতে বসেছিলো, তুলসীকে। তাই আজকে তুলসীর জন্যে এত্তো যত্ন! ঘুমের সকল আয়োজন করে তুলসিকে শুনিয়ে বললো সোনাই, “আমার যখন অনেক টাকা হবে, তখন তোরে আমি আস্ত ইলিশ কিইনা খাওয়ামু দেখিস!” তুলসিকে নিজের গায়ের পাশে বসিয়ে ওকে ঘিরে শুয়ে পড়লো সোনাই, “তোর নাম তুলসি কেন জানিস?”
তুলসি বললো, “ম্যাও?”
“আব্বা মারা যাওয়ার আগে আমরা যেই বাড়িতে থাকতাম, সেইটার উঠানের মধ্যখানে একখান তুলসি গাছ ছিলো। গাছটারে আমি অনেক ভালা পাইতাম!” সোনাই দেখলো তুলসী কাপছে, “কিরে ঠাণ্ডা লাগতাছে নাকি তোর? আমার পরনের ছোয়েটারটা তো খুব টাইট, মায়ে বাইচা থাকতে ৩ বছর আগে কিইনা দিছিলো। যদি পারতাম তাইলে তো তোরে ভিতরে ঢুকাই রাখতাম!” আবার কি যেন ভাবলো সোনাই, “দ্বারা ব্যবস্থা করতেছি!” পরনের সোয়েটার খোলা শুরু করলো সোনাই...
দৃশ্য-৫
সেই বিকেল থেকে এলাকার গলি ঘুপচি ধরে খোজা শুরু করেছে সাইফ আর তারিফ এখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে! ইতিমধ্যে যেখানে বিড়ালসহ ছেলেটাকে প্রথম দেখেছিলো সেখান থেকে বাজার -ঘাট, বস্তিসহ বিভিন্ন স্থান ঘোরা শেষ ওদের। না পেয়েছে বিড়ালটাকে, না ছেলেটার খোঁজ। বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞেস করেও ছেলেটার সন্ধান পাওয়া গেলো না। “বন্ধু, আর খোজা লাগবে না, বাসায় চল। অনেক রাত হয়ে গেছে! আম্মু ইতিমধ্যে আমাকে দু’বার কল দিয়ে দিয়েছে!”
“দাড়া, শেষ চেষ্টা, ওই যে লোকটা আসছে ওনাকে জিজ্ঞেস করেই চলে যাবো!” একজনকে আসতে দেখে বললো সাইফ। “চাচা, আপনি কি কোন বিড়ালছানাসহ একটা ছেলেকে দেখেছেন?”
“ও, মনে হয় সোনাই নামের পোলাডার কথা বলতেছো তোমরা। আরেকটু আগাইলেই পাইতে পারো ওরে, রাইতে ওই সামনের ফুটপাতের উপর ঘুমায় ও।” আঙুল দিয়ে ইশারা করলো লোকটি।
দ্রুত পদচালনা শুরু করলো ওরা দু’জন। বিড়ালটাকে যে করেই হোক উদ্ধার করতে হবে শয়তান ছেলেটার কবল থেকে!
দৃশ্য-৬
স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে সাইফ আর তারিফ। চোখের সামনে যে দৃশ্য উপস্থিত তার জন্যে ওদের দুজনের কেউই উপস্থিত ছিলো না। ফুটপাতে খুঁজে খুঁজে সোনাইয়ের কাছে এসে দেখে, বিড়ালটা একটা সোয়েটারে ভালভাবে মোড়ানো অবস্থায় ঘুমোচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে সোনাই নামের ছেলেটার সোয়েটার ওটা, কারণ পাশেই সোনাই ঘুমিয়ে আছে। নিজের সোয়েটার খুলে দিয়ে, তালি মারা গেঞ্জিটার উপরে পলিথিনের তলা কেটে বানানো সোয়েটার পরে ঘুমাচ্ছে। গুটিশুটি মেরে আছে, যাতে শীত কম লাগে। নিজের গালে তপ্ত অনুভুতি পেয়ে টের পেল সাইফ অজান্তেই দু’চোখ দিয়ে অশ্রুফোটা নেমে এসেছে। পাশে তাকিয়ে দেখলো তারিফ জামার হাতায় চোখ মুছছে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো সোনাইয়ের মতো অনেক মানুষ শুয়ে আছে এখানে, নামমাত্র শীতবস্ত্র নিয়ে। “চল বন্ধু এবার তবে বাসায় যাই!” বন্ধুর আহ্বান শুনে ফিরে যেতে উদ্যত হল সাইফ। কিছুদুর যেয়ে আবার ঘুরে দাড়ালো, তার পদযুগল আবার তাকে বহন করে সোনাইয়ের পাশে নিয়ে আসলো, ঘুমন্ত সোনাইয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলো, তারপর নিজের গায়ের শীতপোষাক খুলে সোনাইয়ের উন্মুক্ত শরীর ঢেকে দিলো। অস্ফুস্ট স্বরে বলে উঠলো, “তুই আমার থেকে অনেক ভালরে ভাই!”
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০১