“আহা! বছর ঘুরিয়া পুনরায় পূন্যের মাস রমজান হাজির হইয়াছে। তাহার শেষে আবার বহুল প্রতীক্ষিত ঈদুল ফিতর। কলিকালের শহুরে ঈদ আর আমাদিগের বাল্যকালের ঈদের মধ্যে বিশাল তফাৎ বিদ্যমান।”
এই সকল ভাবিতে ভাবিতেই শিশুকালের ঈদের রঙিন স্মৃতি সমূহ চক্ষুপটে ভাসিয়া উঠিল। তন্মধ্যকার একটি ঘটনাই আপনাদের নিকট বর্ণনা করিবো।
শিশুকালের কথা। সেইবার ঈদ হইয়াছিল বর্ষা মওসুমে। ঢাকার উপকন্ঠ মিরপুর হইতে গ্রামীণ গন্ধ তখনও পুরাপুরি দূরিভুত হয় নাই। বৃষ্টির কারনে ঈদের জামাত হইবে মসজিদে। তাই সকালবেলা গোসল করিয়া, নুতন জামা কাপড় পরিধান করিয়া এবং চটিজোড়া বগলদাবা ও আব্বাজির আঙ্গুলখানা হস্তগত করিয়া প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদার উপর দিয়া মসজিদের দিকে রওনা হইলাম। সল্প দূরত্ব অতিক্রম করিতেই দেখিতে পাইলাম এলাকার বিশিষ্ট দুনম্বরি তৈল বিক্রেতা বল্টু খাঁ কর্দমাক্ত দেহে তার ডবল তরমুজ সাইজের ভুড়িখানা দুলাইতে দুলাইতে ফিরত আসিতেছে। আব্বা শুধাইলো, ‘কিগো পড়িলে কি করিয়া?”
“আর কহিয়েন না! ফৈজু পাগলা ধাক্কা মারিয়া ফালাইয়া দিয়াছে।”
ফৈজু হইলো আমাদের এলাকার স্থায়ী পাগল। জানিনা কি জন্য এলাকার মুরুব্বীরা তাহাকে এড়াইয়া চলিতো। আমরা ছোটরা তাহাকে ভালই পছন্দ করিতাম। কারন পাগলা প্রায়ই আমাদিগকে এ গাছ ও গাছ হইতে ফল ফলাদি পাড়িয়া খাওয়াইতো আর নানান কিছিমের গল্প শুনাইতো। “পাগলা আবার খেপিয়াছে!” আব্বা কহিলেন,“কি আর করিবে, যাও তোমার ঐ তেলতেলে গাত্র হইতে দুনম্বরি তৈলসমূহ ধৌত করিয়া নামাজে আসো।”
আব্বাজির টিটকারি শুনিয়া বল্টুমিয়া গজগজ করিয়া হন্টন শুরু করিল। মসজিদে পৌছাইয়াই দেখি আরেক হুলস্থুল। চার-পাঁচজন মিলিয়া অর্ধনগ্ন পাগলাকে লুঙ্গি পরানোর চেষ্টা করিতেছে, আর পাগলা চিৎকার করিয়া কহিতেছে, “আমি পাগড়ি পড়িব! আমি পাগড়ি পড়িব!”
অনুসন্ধান করিয়া জানা গেল ফৈজু উদোম গায়ে শুধু লুঙ্গী পরিয়া ঈদগাহে আসিয়াছিল। অতঃপর এলাকার বিশিষ্ট বখাটে চেংড়া মজিদ তাহাকে পরামর্শ দিয়াছে যে, এলাকার সকল মুরুব্বীরা পাগড়ী পরিধান করিয়া আসিয়াছে, একজন বিশিষ্ট মুরুব্বী হিসেবে তাহারও পাগড়ী পরিধান করা আবশ্যক। তৎক্ষনাৎ সে লুঙ্গী খুলিয়া মাথায় পেচাইতে শুরু করিলে এই বিপত্তি। আব¦া যাইয়া পাগলাকে শান্ত করিলেন। যদি সে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ হইয়া থাকে তাহলে তাহাকে বাসায় নিয়া মনমতো খাওয়ানোর ব্যবস্থা করিয়া দেবেন বলিয়া প্রতিশ্রæতি দিলেন। ফৈজু যে এই প্রতিশ্রæতি কাটায় কাটায় পালন করিবে, আব্বাজী তাহা বুঝিতে পারেন নাই। নামাজ সে শান্তরূপেই পড়িল । কিন্তু নামাজ শেষ হইতেই সে বাহির হইয়া প্রথমে কাঁদায় একপাক গড়ান দিয়া লইলো। উহার পর সফেদ কাপড়ধারী ব্যক্তিবর্গের সহিত কোলাকুলি করিয়া কাঁদা মাখাইয়া দিতে লাগিল। লোকজন দূর দূর করিতেই বলিয়া উঠিল, বাহিরের ময়লাকে তো তোমরা ভালোই ঘৃণা করে, তাহা হইলে ভেতরে যে কাঁদা তাহাকে কেন লালন কর!
ফৈজু সে ঈদের একমাস অতিক্রম না হইতেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। শুনিয়াছি সে মারা যাইবার পূর্ব মূহুর্তে তার ¯^র্গবাসী জন্মদাত্রীকে স্মরণ করিয়া “ মা” বলিয়া ডাকিয়া উঠিয়াছিল।
পূনশ্চ: সে ঈদের পায়েস খাইতে খাইতে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “আচ্ছা পাগলাদা তুমি বল্টু খাঁকে ধাক্কা মারিয়াছিলে কেন?”
“সে আমাকে পাগল বলিয়াছিলো, তাই!”
‘আমরাও তো তোমাকে পাগলা কহিয়াই ডাকি”
পাগলা মধুর হাসি দিয়া কহিয়াছিল, “তোমরাতো আমাকে ভালোবাসিয়া পাগল ডাকো, ঘৃণার সহিত তো নয়।”
পাগলার হাসিখানা এখনও চোখে ভাসে।