বৌদ্ধসভ্যতার ঐতিহাসিক কেন্দ্র ময়নামতিতে জাদুঘর রয়েছে। এখানে আছে বৌদ্ধযুগের তরি গৌতমবুদ্ধের মূর্তি, মুদ্রা, বেলেপাথরের মূর্তি। শালবন বিহারে প্রাপ্ত সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর মূর্তি, প্লেট, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। বিহারের আশপাশে বেড়াতে আরো বেশি আনন্দ। বিহারের ধ্বংসাবশেষ ভিক্ষুদের কক্ষগুলো দেখে প্রাচীনযুগে ফিরে যাবেন। বারবার তাকিয়ে থাকা শুধু পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ময়নামতি দেখতে পুরো একদিন লেগে যাবে। আরো আছে শালবন , সারি সারি শাল গাছ।
ঘুরে আসুন লালমাইঃ
জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ছুটতে ছুটতে মানুষ এখন এতো বেশী যান্ত্রিক হয়ে গেছে যে,যন্ত্র দ্বারা তৈরি বিনোদন স্থানও তাদের আকর্ষন করেনা। আর তাইতো একটু প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য মানুষ ছুটে যেতে চায় প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতির রুপের সান্নিধ্যে এসে জুড়োতে চায় তাপিত জীবনের সকল অস্থিরতা। জীবনে কতো দর্শর্নীয় স্থানই না দেখেছেন ঠিক নেই? কিন্তু আজ যে স্থানে আপনাদের বেড়ানোর আমন্ত্রস জানানো হচ্ছে তা অনেকেই অচেনা এবং অজানা। কুমিল্লা উপজেলার দক্ষিক প্রান্তে শহর থেকে সড়ক পথে মাত্র ১৫ কি মি দূরে অবস্থিত প্রকৃতির লীলাভূমি লালমাই পাহাড়। লাল মাটির পাহাড়ের গায়ে শিশির সিক্ত সবুজ ঘাস, কোথাও কাঁশফুল, পাহাড়ি আকাবাকা পথে পাহাড়ি কূলবধূদের কলসি কাঁখে পানি নিয়ে ঘরে ফেরা, ফলজ-বনজ গাছগাছালির সবুজ বনায়ন-এসব মিলিয়ে অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন লালমাই পাহাড়। এপাহাড়ের নামকরনের পিছনে একটি মজার পৌরাণিক কাহিনী চালু আছে। বলা হয় প্রাচীনকালে বিন্দাচল পর্বতে মহামায়া চন্ডী মহাসুর সতী রুপে স্বর্গ মর্ত পাতাল নিপীড়নকারী শন্ডু নিশন্ডু নামক এক মহাসুরকে নিধনকল্পে এক ঘোরতর যুদ্ধে নামেন। সে যুদ্ধে বেশ কিছু অসুর ঘন রথ জঙ্গলে আবৃত এ দুর্গম দ্বীপে পালিয়ে আসেন। মা মহামায়া তখন প্রবল ক্রোধান্বিত হয়ে বায়ুবেগে এ দুর্গম দ্বীপে পাহাড়ের কোলে আশ্রায় নেওয়া অসুরদের নিধন করেন। মায়ের দেহতাপে পাহাড়টির মাটি লাল হয়ে যায়। কিন্তু মাটি লাল হয়ে যাওয়ায় এর নাম পরিবর্তন হয়ে লালমাই পাহার নামে পরিচিতি পায়। এ স্থানে যেতে সড়কপথের যোগাযোগই ভালো।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-চাদপুর রেলপথে লালমাই স্টেশন থাকলেও এখানে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের কোন বিরতী নেই। আর তাই ঢাকা-চট্রগ্রাম,ঢাকা-চাঁদপুর বাসযোগে এসে লালমাই বাজারে নামতে হবে। লালমাই বাজার থেকে পশ্চিম দিকে একটু হেঁটে গেলেই দেখতে পাবেন সবুজ গাছ-গাছালি ঘেরা লালমাই আঞ্চলিক স্বাউট
প্রশিক্ষন কেন্দ্র। এবার উত্তর দিকে ইটের সলিং করা সড়ক ধরে হাটুন টাক্কু টিলা এলাকায় প্রায় দেড় কি.মি পথ। সড়কের দু পাশে সারি সারি কাছগাছ আর লালমাটির তৈরি করা সড়কটি উচু নিচু স্থান অতিক্রম করার আনন্দটাই আলাদা। টাঙ্কু টিলাটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২০০ ফুট উপরে। এ টিলার উপর সম্প্রিতি পাওয়া গেছে গ্যাসক্ষেত্র। আর এর নামকরন করা হয়েছে লালমাই গ্যাস। এটি এখনো চালু করা হয় নাই, না করা হলেও উত্তোলন করে জ্বালিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। পাহাড়ের মাথা কেটে সমান করে কূপের এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা বেষ্টণী দেওয়া হয়েছে নেট তারের। অপনি ভেতরে ঢুকতে পারবে না । তবে চারিদিক ঘুরে দেখতে পারেন। ছবি তুলতে পারেন।
পাহাড়ের উপর গ্যাসফিল্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চায়ের স্টল রয়েছে। ইচ্ছা করলে চা পানের সঙ্গে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন । তবে বেশী দেরি করবেন না। গ্যাসক্ষেত্রের টিলার ১০০ ফুট দক্ষিনে সমতল ভূমিতে রয়েছে কেরোসিন তেলের খনি।
অবশ্য এখন আর এখান থেকে তেল উত্তোলিত হয় না। স্বধীনতার আগে আন্তরর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তেলের মূল কূপের মুখে সীসা ও অন্যান্য ধাতব পদার্থের মাধ্যমে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এখনো রয়েছে কূপের অবস্থান, রিজর্ভ টাংকি ইত্যাদি। এবার ঝটপট চলে আসুন আবার বালুপথ মাড়িয়ে গেলেই হাতের ডানপাশে নজরে আসবে ক্ষতবিক্ষত একটি পাহাড়। এটি হচ্ছে লালমাই ফায়ারিং স্পট। এখানে বাংলাদেশ পুলিশ, আনসার,ভিডিপি সদস্যদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। আপনি ঘুরে দেখতে পাবেন পাহাড়ের গায়ে বিধে আছে অজস্র গুলির অংশ। পাহাড়টির ওপরে উঠলে দেখতে পাবেন ছোট বড় অসখ্য টিলা আর দানব অসুরের হাড়ের বিরাট বিরাট অংশ মাটির সঙ্গে মিশে আছে। ইচ্ছে করলে পাহাড়ি পথ ধরে হাটতে পারেন। তবে বেশিদূর যাবেন না। লোকলয়ের বাইরে ছিনতাইকারীর ভয় রয়েছে পাহাড়ের পাশে বাড়িগুলোতে অসংখ্য বাঁশঝাড়। এ বাঁশঝাড়ে চড়ুই পাখির কিছির মিচির শব্দে আপনি মোহিত হবেন। পাহাড়ে উঠানামা করতে সাবধানতা অবলম্বন করবেন। নতুবা পা ফসকে পড়তে পারেন। এবার ফায়ারিং স্পট থেকে দক্ষিনে দিকে পাহাড় কাটা রাস্তা হয়ে ১ হাজার ফুট অতিক্রম করে এলেই দেখতে পবেন সামনে চাঁদপুর মহাসড়ক। বাম পাশে লালমাই বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র এবং ডান পাশে লোটাস কামাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক।
আপনি চাঁদপুর মহাসড়ক ধরে ১ হাজার ৫০০ ফুট পশ্চিমি বরুড়া সড়ক ধরে গেলে দেখতৈ পাবেন লালমাই পাহাড়ের প্রায় ৩০০ ফুট উপরে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান চন্ডীমুড়া মন্দির।
ময়নামতি, লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণাংশের পাহাড়-টিলা ঘেরা চণ্ডিমুড়া। এ এক নির্জন প্রকৃতিতে অনন্য তীর্থস্হান। পাহাড়ের কোলে সুষমামণ্ডিত চণ্ডিমুড়া মন্দির হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মহতীর্থস্হান হিসেবে সমাদৃত। এ মন্দিরে শ্রীশ্রী চণ্ডীদেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কথিত আছে, সপ্তম শতাব্দীতে এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মহীয়সী রানী প্রভাবতী দেবী এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আধ্যাত্মিক মননে বিশ্বাসী ও বিদুষী ছিলেন। রানী প্রভাবতী দেবীর মাতা মায়াচণ্ডীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে মায়ের আরাধনা করেছিলেন।
চণ্ডিমুড়া মন্দিরে যাওয়ার পথে দেখবেন সবজ-শ্যামল রূপ। নির্জন পথ দিয়ে এখানে আসার সময় চারিদিকের দৃশ্য দেখে শুধুই মুগ্ধ হবেন।
ইংরেজ কবরস্থান:
বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিসৌধ (কুমিল্লা)
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গেলে দেখবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিসৌধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈনিকদের মধ্যে শহীদ ৭৩৬ জন সৈনিককে এখানে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছর ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে কর্মরত কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত এবং প্রতিনিধিরা এখানে এসে গভীর শ্রদ্ধাভরে শহীদদের স্মরণ করেন। প্রতিটি সমাধিসৌধের গায়ে রয়েছে পাথরের নামফলক। স্মৃতিসৌধের প্রতিটির উচ্চতা প্রায় একই সমান। ফুলগাছের সমারোহ এর সর্বত্র। ময়নামতি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধিগুলো পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য একজন গাইড এখানে পাবেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে সমাধিসৌধগুলো দেখে নিন।
কিভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য সড়কপথে পরিবহন রয়েছে। মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যে কুমিল্লায় পৌঁছা যায। ইচ্ছে করলে রেলপথে ট্রেনে যেতে পারেন। তবে সময় বেশি লাগবে। রাত কাটানোর জন্য কুমিল্লায় আবাসিক হোটেলেরও অভাব নেই।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৪