somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জনৈক মুহিনের অসমাপ্ত গল্প

২৪ শে এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি তোমাকে প্রথম দেখি , লাবণ্য ; ২০ শে নভেম্বর ১৯৯৭ সালে , বিকেল ৪ টা ১৫ মিনিটে ।

সে দিনটার কথা এখনো মনে আছে , যেন দাগ কেটে বসে গেছে অনুষঙ্গে । আমি চাইলেও যেন আকে ভোলার সাধ্য আমার নেই । অথবা ভুলতে কি চাই ? মনে হয় না ।

সেদিন রবিবার ছিল , বাবা বললেন মোড়ের ফার্মেসী থেকে ওষুধ আনতে , বুকের ব্যাথাটা বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ । আমি কলেজ থেকে ফিরে আড্ডাতে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলাম - ভালো লাগছিলো না একগাদা কথা ভাবতে ।

আমি বাসা খেকে বের হলাম । দেখি আমাদের সামনের দোতলা সাদা বাড়িটার রেলিং ধরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

আমি "প্রথম দর্শনে প্রেম" জাতীয় কোন দার্শনিক তত্ত্বে কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না । কিন্তু বিশ্বাস কর লাবণ্য , তোমাকে প্রথমবার দেখার পর আমি সম্পূর্ণ অনুভূতিশূণ্য হয়ে গিয়েছিলাম । আমার মনে হচ্ছিল , যেন পৃথিবীতে কেউ নেই , থাকবার অধিকারও নেই কারো শুধু তুমি ছাড়া । তুমি আনমনা হতে তাকিয়ে ছিলে দূরে , আমার ইচ্ছা করছিল আমি সময়কে ঐ জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিই , শত সহস্র বছর কেটে যাক .. আমি চাইছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম গতকাল কলেজে মার খেয়েছি বাবুভাইদের হাতে , ভুলে গিয়েছিলাম আমার বুক পকেটে দুটি ময়লা দশ টাকার নোট , আমার একমাত্র টিউশনিটা বন্ধ হয়ে গেছে , ভুলে গিয়েছিলাম বাবার জন্য ওষুধ কিনতে হবে ... আমার মনে ছিল না কিছুই ।

আজো চোখ বন্ধ করলেই দেখি , তুমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে ।

লাবণ্য , জানো সেই রাতে আমার জ্বর এসেছিল । সারারাত কি এক অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছে , জানিনা এমন কেন হয় । এখনও জানিনা । প্রেম - ভালোবাসা আমার কাছে বরাবরই সস্তা মনে হত , এখনও হয় । কিন্তু আমি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারিনা সেই অনুভূতিকে , সেই রাতটিকে ।

আমি তোমাকে চিনিনা , জানিনা তুমি কে , কোথায় পড়ো .. কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল এসব জানার কোন প্রয়োজনও আদৌ আমার নেই , আমার এটাও একবার মনে হয়নি তুমি কোন রাজকন্য আর আমি রাজপুত্র্র ... আমার শুধু মনে হচ্ছিল যদি আর একটিবার ঐ চোখজোড়া দেখতে পারতাম - ব্যাস , আর কিছু চাই না ।

তারপরদিন সকাল খেকে আমার জীবনটা নতুন করে শুরু হল । আগে নিজের জন্য বাঁচতাম ., তোমার জন্য বাঁচতে শুরু করলাম ।

আগে আড্ডার মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতাম , এখন মন পড়ে থাকে বাসায় । বন্ধুরা প্রথমে চিন্তিত হল , এরপর বিরক্ত হয়ে গেল । সস্তা নেভী সিগারেটের নীলচে ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে নিতে আমি ভাবতাম তোমার কথা । তুমি কলেজ থেকে ফেরার সময় হলে এলোমেলো হাঁটতাম রাস্তায় , তোমাদের রেলিং এর দিকে তাকাতে তাকাতে ব্যাথা হয়ে যেত চোখ ।

পাড়ার বন্ধুরা মাঝে মাঝেই তোমাকে নিয়ে আসত আড্ডায় । প্রাণপণে চেষ্টা করতাম প্রসঙ্গ বদলাবার , চেষ্টা্ করতাম প্রমাণ করতে তোমার নাক বোঁচা , যাতে কেউ তোমায় নিয়ে না ভাবে ।

যেন তুমি আমার ব্যক্তিগত কোন বকুল ।

আমি জীবনে ক্লাসনোট ছাড়া কিছুই লিখিনি , আমি তোমার জণ্য একটা চিঠি লিখে ফেললাম । লিখলাম , ছিঁড়লাম । লিখলাম , ছিঁড়লাম । আবারও লিখলাম । যতবার পড়ি , মনে হয় সস্তা বাংলা নাটক , আবারও ছিঁড়ি । কিছুতেই বোঝাতে পারিনা যা বলতে চাই ।

আমার এত দুঃসাহস ছিলোনা আমি তোমার মা কে গিয়ে বলবো অন্য ছেলেদের মত 'আন্টি, বাজারটা করে দিই' , অথবা তোমাদের দারোয়ানের কাছে তোমার অজানা তথ্য উদ্ধার করে নিয়ে আসব । আমি কিছুই জানতামনা তোমার । তোমার প্রিয় মুভিস্টার কে , তোমার প্রিয় রং , প্রিয় গান , কিছুইনা ... শুধু পাড়ার ছেলেদের কাছে জেনেছিলাম তিনটি শ্রেষ্ঠ অক্ষর ..

লাবণ্য । তোমার নাম ।

এরচেয়ে সুন্দর , এরচেয়ে প্রিয় কোন নাম থাকতে পারে পৃথিবীতে , আমার জানা ছিল না । খাতায় কোনদিন কিছু লিখিনি । কি দারূন আগহে লিখে ফেলেছিলাম তোমার নাম হাজারবার । আবার লজ্জা পেতাম নিজেই সেসব দেখে ।

তোমাদের লাল রংয়ের গাড়িটা , তোমাদের সাদা রেলিং দেয়া বারান্দা , তোমার জানালার পাশে নীল রংকরা টবটা - আমার এত প্রিয় কোন জিনিস পৃথিবীতে ছিল না আর । আমি ভালোবাসতাম তোমাকে দেখতে । তোমার ক্লান্ত চোখজোড়া ..... যেন দু'ফোটা বর্ষা ।


আমি কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিলাম । বাসায় আমাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হল । আমি কি গাঁজা ধরেছি ? আমি কি পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে আছি ? আমি কি পরীক্ষায় ফেল করেছি ?

আমি জানতাম না এসব প্রশ্নের উত্তরে । আমার মন আবিষ্ট হয়ে থাকত দেয়ালের ঘড়িটার দিকে । কখন তিনটা বাজবে ? তুমি আসবে ... ভাগ্য ভালো হলে বারান্দায় দু'মিনিট ।

এক দুটি মিনিটই আমার চাওয়া ।

আমি জানি আমি মোঃ মুহিন ইসলাম , আমি সেকেন্ডহ্যান্ড শার্ট পরি , নেভী সিগারেট খাই আর বখাটে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাই , আমার বাবা অসুস্থ , পকেটে সাইত্রিশ টাকা আছে আমাকে মাস চালাতে হবে , আমি দেখতেও মোটেই সুপুরুষ না ; আমার কখনোই এ দুঃসাহস হবে না তোমার সামনে গিয়ে তোমাকে বলব তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জলপ্রপাত , বলব আমার ভালোলাগে যখন তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ খুঁজে বেড়াও ... আমাকে একটু মেঘ এনে দেবে ?


আমার দিনগুলি কেটে যেতে থাকল স্বপ্নের মত .. কেমন যেন এক ঘোরে আমি হাঁটতে থাকলাম মাইলের পর মাইল । যে বৃষ্টিকে কখনোই বিরক্তি ছাড়া কিছু মনে হয়নি , তাকে প্রিয় লাগতে থাকল হঠাৎ , প্রিয় লাগতে লাগল গান , পাখি আর ভাঙ্গা জানালায় রোদের উৎসব ।

আর সেদিন .. সেই দিনটি ....... যা আমি কখনোই ভুলব না । আমার জীবনের স্মরণীয়তম দিন , লাবণ্য ।


আমি দেখছিলাম তুমি কলেজ থেকে আসলে রোজকার মত । হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে নামলে , যা কখনোই করো না । সারা বিশ্বব্রম্মান্ড ছেড়ে সোজা আমার দিকে আসতে থাকলে .... ।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম ।

"আপনাম নাম মুহিন ?"

আমার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না । এই সেই একজোড়া চোখ যার প্রার্থনার আমি সমর্পিত , এই সেই চোথ । আমার সামনে , আমার এত কাছে ?

"জ্বি" , নিজের গলা নিজেই ঠিকমত শুনতে পেলাম না , গলা শুকিয়ে কাঠ ।

"এটা আপনি লিখেছেন ?" .. তোমার হাতে আমার সেই চিঠি ।

আমি বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলাম । আমি জানিনা সেই চিঠি কিভাবে আসল তোমার হাতে ।হয়তো কোন বন্ধু পেয়েছিল খাতার মাঝে , পাঠিয়ে দিয়েছিল তোমার ঠিকানায় মজা দেখার জন্য । আমার মনে হল কেউ আমাকে বিবস্ত্র করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তোমার সামনে ।

" কথা বলছেন না কেন , এটা আপনার লেখা ?"

আমি কি বলব ? আমার দু চোখ ভরে জল । আমি কি বলব তোমাকে লাবণ্য ? কি বলব ?

"জি..জ্বি"

তুমি রেগে গিয়েছিলে । তোমার নাক ঘামছিল বৈশাখের গরমে । আমি দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট , তোমার চোখে রাগ ।

চোখের সামনে ছিঁড়ে ফেললে তুমি আমার ভালোবাসাকে ।ছড়িয়ে দিলে রাস্তায় ।

নাহয় আমি সুন্দর করে লিখতে পারিনি , নাহয় আমার হাতের লেখা ভালো না , অজস্র বানান ভুল । নাহয় আমার বহিঃপ্রকাশ নাটকের ডায়ালগের চেয়েও সস্তা ; তবুও তুমি বল ... কাজটা কি ঠিক ছিল ?

কালো পিচের রাস্তায় শিউলিফুলের মত পড়ে রইল আমার চিঠি , আমার প্রথম চিঠি ।

"ছোটলোক"

কি সুন্দর করেই না উপসংহার দিয়ে গেলে তুমি । যেন একটিমাত্র শব্দে জানিয়ে গেলে , আমি কত সামান্য , কত ছোট তোমার তুলনায় । আমার জন্য স্বপ্ন দেখা অন্যায় , জানিয়ে গেলে তুমি । কেন লাবণ্য ? আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম ? খুব বেশি কিছু ?? কেন এমন করেছিলে সেদিন তুমি ?



আমি জনৈক মুহিন , বাংলা কলেজের বখে যাওয়া বেকার ছাত্র , যার জীবনে একবার ভালোবাসা এসেছিল ।


এই আমার ভালোবাসা , আমার একমাত্র , একমাত্র অসমাপ্ত গল্প ।





৪৭টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×