কিভাবে মারা গেলাম তা আমার কাছেও খুব একটা পরিষ্কার না। রাতে সবার সাথে বসে ভাত খেলাম। ভালো মানুষ। রাতজাগা অনেকদিনের অভ্যাস। অনেকরাত পর্যন্ত জেগে থাকি। জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে এতোরাত জেগে কি করি (সরি; কি করতাম হবে)। কি করতাম না সেটা বলেন। দেশের অবস্থা নিয়ে চিন্তা থেকে শুরু করে পেন্সিল চোখা করা- সবই করতাম। এখন রাত জাগতে পারি না বলে ভীষন কষ্ট লাগে। সারাক্ষনই জেগে থাকি; রাত জাগার সময় কোথায়? কি জানি বলছিলাম? ।ওও.....রাত তিনটার দিকে ঘুমাতে গেলাম। একটা স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করা যায়। অনেকদিন কোন স্বপ্ন দেখি না। কোন স্বপ্নটা দেখব- ঠিক করতে করতেই ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল একটু তাড়াতাড়িই। ঘুম থেকে উঠে দেখি মারা গেছি। আজব!! এরকম হঠাৎ করে মানুষ মরে নাকি?!
ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলাম। ঢুকেই মনে হল আরে আমিতো মরে গেছি, ফ্রেশ হব কেন? ব্রাশও করলাম না। মৃত ব্যক্তির মুখে গন্ধ থাকলেই কি; আর না থাকলেই কি। অনেক ফালতু কাজ করতে হবে না ভেবে খুশি খুশিও লাগছিল। যদিও এই খুশি ছাপিয়ে গিয়েছিল হঠাৎ মারা যাবার বিষন্নতা।
এতদিন জানতাম মরে যাবার পর দেয়াল ভেদ করে চলে যাওয়া যায়। আমিও দরজা ভেদ করে বেরোতে গেলাম। মাথা ঠুকে গেল। ভাগ্যিস মারা গিয়াছিলাম। নাহলে মাথায় ঠিকই একটা আলু গজিয়ে যেত। অতঃপর দরজা খুলেই বের হতে হল। মার কাছে গেলাম। বললাম, 'মা, মারা গিয়েছি আমি'। মা অবাক হল হয়ত। 'কিভাবে মরলি? কখন মরলি?' সদুত্তর দিতে পারিনি। জানলেই না জানাবো। আমিইতো ঠিকমতো জানিনা কিভাবে মরলাম। কবেইবা মরলাম। হয়ত কাল রাতেই মারা গেছি। হয়ত তুচ্ছ কোন কারনে মারা গেছি।
কোন কবি যেন বলেছিলেন-
"আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।"
ভেবেছিলাম মা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠবে। কিন্তু মা শান্তই ছিল। তার চোখদুটি অবশ্য দুঃখী ছিল। বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।
বাসে ভীষন ভীড়। পা রাখারও জায়গা নেই। মোট সংরক্ষিত সিট বারটা- মহিলাদের জন্য নয়টা আর মৃতদের জন্য তিনটা। তিনটা সিটেই মৃত প্যাসেঞ্জাররা বসে ছিল উদাস উদাস চোখ মেলে। তিনজনের মধ্যে একজনকে আমার পুরোপুরি মৃত মনে হল না।
ভার্সিটি গেলাম। কুইজ ছিল একটা। কম্পিউটার আর্কিটেকচার। কিছুই পড়িনি অবশ্য। জাস্ট দেয়ার জন্যই দেয়া। আর যদি কারোরটা দেখার সুযোগ মিলে তাহলেতো পাঙ্খা। ক্লাসের সবার মুখে একই কথা। 'কখন মারা গেলি?','কিভাবে মারা গেলি?' এক ফ্রেন্ড আফসোস করল। আমি মারা গেছি সেজন্য না। নিজে এখনও বেঁচে আছে বলে। বেঁচে থাকা মানেই- ক্লাস, ল্যাব,কুইজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও চিন্তা করে দেখলাম কথা মিথ্যা না। মরে গেছি ভেবে নিজেকে কিছুটা হালকাও মনে হল। ক্লাসে স্যার আসলেন। খাতা দিচ্ছিলেন একজন একজন করে। আমি খাতা নেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। স্যার বললেন,'তুমি কবে মারা গেছ?'
সঠিক উত্তর জানা নেই। বললাম,'গতকাল রাতে।'
স্যার বললেন তাহলে আমার কুইজ দেয়ার দরকার নাই। বাসায় যেয়ে রেস্ট নিতে। আমি বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় দেখি আফসোস করা ফ্রেন্ডটার চেহারা কান্না কান্না হয়ে গেছে। বেচারা হয়ত কেঁদেই ফেলবে।
বিকেলে গেলাম ফারিয়ার সাথে দেখা করতে। ও রেগে ছিল।
'তোমার ফোনে রিং হয়। রিসিভ করো নাই কেন?'
'আমিতো মারা গেছি। রিসিভ করবো কিভাবে?'
'আজিব! মারা গেলে ফোন রিসিভ করা যায় না নাকি?'
আমি চুপ করে গেলাম। কথা বলা মানেই ফারিয়াকে আরো রাগানো। ও চোখ তুলে আমাকে ভালোভাবে দেখল।
'সত্যিই মারা গেছ তুমি? কবে?'
'কাল রাতে'
'তাহলেতো আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তাই না?'
'হু তাই'
ফারিয়াকে দুঃখী বা বিষ্মিত কিছুই মনে হয় হল না। যেন আমি মারা গেছি- এটা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। পাঁচ বছরের রিলেশনের ইতিও কোন আহামরি ব্যাপার না। আমি আবার মারা যেতে চাইলাম। রাত হয়েছে। বাসায় ফিরতে হবে।
রাস্তায় হাঁটছি। আমার মৃত্যতে কারো কোন দুঃখ নেই। দুঃখতো পরের কথা; বিষ্ময়ও নেই। বেঁচে থাকলে মনটা বেশ খারাপ হত। মৃত মানুষের মনই নেই; খারাপ হবে কি। এখন একটা সিগারেট টানতে পারলে মন্দ হত না। বুক ভরে নিতাম নষ্ট নিকোটিনে। একটা টঙের দিকে এগোলাম। সিগারেট কিনব।
দোকানদার সরুচোখে তাকিয়ে আছে। 'আপনে কি মারা গেছেন?'
'হু। কাল রাতে।'
'তাইলে আপনে সিগারেট দিয়া কি করবেন? মারা গেলেতো বিড়ি খাওয়া যায় না।'
'কিছু করব না। ফালাইয়া দিব'
'সিগারেট বেচুম না। মরা মাইনষের কাছে সিগারেট বেচি না।'
সারাদিন বেশ ভাব ধরে ছিলাম। ভাব ধরে ছিলাম- মরে গেছি তাতে কি। কিন্তু টঙের ব্যাপারটায় নতুনকরে উপলব্ধি হল- আমি মারা গেছি। আসলেই মারা গেছি। ভরা পূর্নিমার ফিনকি দিয়ে পড়া জ্যোৎস্না আমি দেখব; কিন্তু জ্যোৎস্নারা আমাকে ছুঁবে না। অকৃতজ্ঞের মতো আমাকে উপেক্ষা করে মাটিতে পড়বে। তারা ভুলে যাবে তাদের জন্য লেখা আমার কবিতার ঋন।
মৃতরা কাঁদে না; কাঁদতে পারে না। চোখ দিয়ে অশ্রু না গড়ালেও যে কেউ দেখলে বুঝত আমি কাঁদছি। একজন মৃত মানুষ কাঁদছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৯:১৭