জানালা দিয়ে নরম রোদ এসে মেঝেতে পড়ছে। আর ওপাশ থেকে মিষ্টি সুরে ডাকছে কোকিল। জানালায় দাঁড়িয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তরু। এরপর পেছন ফিরে এক নজরে দেখে নিলো পুরো রুমটা। একেবারে শান্ত একটা ছোট্ট রুমে টেবিলে বসে বইয়ের ভেতর যেন ডুবে আছে কতগুলো উৎসুক চোখ। নিজের ইচ্ছেটা যখন পূরণ হয়, তখন ঠিক কেমন লাগে তাই উপলব্ধি করছিলো তরু। এই ইচ্ছে পূরণের জন্য কম ঝুট ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাকে! এই তো গত বছরেরই কথা, যখন সে তাঁর গ্রামে এরকমই একটা লাইব্রেরি করার স্বপ্ন দেখেছিলো। এরকম একটা অজো-পাড়া গ্রামে যেখানে মানুষ দু-তিন বেলা পেট ভরে খেয়ে বাঁচতে পারাকেই যথেষ্ট মনে করেন, সেখানে এরকম একটা লাইব্রেরি খোলাটা তাঁর জন্য চাট্টিখানি কথা ছিলো না। এই স্বপ্নটা তাঁর মধ্যে হুট করে জন্ম নেয়নি। ছোটবেলা থেকে দাদার কাছে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছে সে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, গরু চড়াতে গিয়ে গাছ তলায় বসে, পাংশী নৌকা করে ফুপুর বাড়ি যাওয়ার পথে, আরও কত কত সময়ে যে সেই গল্পগুলো শুনেছে সে!
দাদার মুখে গল্পগুলো শুনতে শুনতে সে যেন হারিয়ে যেতো সেসব গল্পের মাঝে। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠতো সব ছবি, শিউরে উঠতো পুরো শরীর। তখন সে নিজেকে কল্পনা করতো ওই সময়েরই একজন হিসেবে। মনে মনে চিন্তা করতো যে, ওই সময়টাতে সে থাকলে ঠিক কী করতো? সেও কি পারতো এতোটা সাহসী হতে, সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে? দাদার সেই সব গল্পগুলোই সে সযত্নে আগলে রেখেছে মনেপ্রাণে। আর সেই গল্পগুলো হলো বাংলাদেশের জন্মকথা নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। নিজের পাঠ্যবই ছাড়া তেমন কোন বই তরুর পড়া হতো না। হাতে গোনা যে কয়টা পড়েছে তাও আবার পাশের বাড়ির শিল্পীর বড় বোন, মালা আপার কাছ থেকে নিয়ে। মালা আপা ঢাকায় পড়াশুনা করেন বিধায় সেখানকার বিভিন্ন লাইব্রেরির নানান রকম বই তাঁর সংগ্রহে থাকে। মালা আপার কাছ থেকে তরু বেশ কয়েকবার গল্প শুনেছে যে, সেখানে বিভিন্ন ধরনের লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপ্রেমীরা কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই নিয়ে বসে থাকে। এমনকি মালা আপার টাচ্ স্ক্রিন ফোনে কতগুলো ছবি ছিলো লাইব্রেরির। সেগুলো দেখে তো তরুর চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার অবস্থা হতো। তখন থেকেই মাথায় ঘুরছিলো তাঁর গ্রামেও এমন একটা ব্যবস্থা করার। যেখানে থাকবে শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সব বই।
তরুর খুব খারাপ লাগতো যখন গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। ওদের দোষ দিয়েও অবশ্য কোন লাভ ছিলো না। কারণ বড়রাও যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু জানতো তাও তো না! এরকম করে চলতে দেয়াটা তরু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না। কীসের তাড়নায় যেন হন্যে হয়ে ছুটছিলো ওর স্বপ্নের লাইব্রেরিটা গড়ে তোলার জন্য। তরুদের তিন রুমের বাসার একটি রুম খালিই পড়ে থাকে। আগে সেটা বড় ভাইজানের রুম ছিলো। পরে গঞ্জে কাজের কারণে পরিবারসহ চলে যাওয়ায় রুমটা পড়েই থাকে। রাতের বেলা আব্বা মাছের আড়ত থেকে মাছ বিক্রি করে আসার পর আম্মা-আব্বা দুজনকে খুব করে ধরেছিলো তরু। বড় ভাইজানের রুমটাতেই সে বানাতে চায় তাঁর সেই স্বপ্নের লাইব্রেরি। আম্মা-আব্বা কোনমতেই তাঁর সাথে একমত হতে চাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে তরুর আব্বা। তাঁর কথা হলো, এতো কষ্ট করে মাছ বিক্রি করে সংসার চালিয়ে দু বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড় করে বহু কষ্টে তিনি ছেলেমেয়ের পড়াশুনা চালিয়েছেন। তরুর কাজ হলো ভালো ভালোয় পড়াশুনার পাট চুকিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসা। তাই তাঁর কাছে তরুর এই ইচ্ছেটা পনেরো বছরের একটি বাচ্চা মেয়ের নিছক ছেলেমানুষি বৈ আর কিছুই মনে হচ্ছিলো না। তবুও তরুর একগুঁয়ে জেদের কারণেই অনিচ্ছা স্বত্বেও তরুর আব্বা-আম্মা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ব্যস, তরুকে তখন আর কে পায়! বড় ভাইজানকে ফোন করে অনুমতি নিয়ে আর মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে সে নেমে পড়লো তাঁর স্বপ্ন পূরণের কাজে।
রুমের জিনিসপত্র সরাতে আম্মা-আব্বাও তাকে সাহায্য করেছিলেন। বই রাখার জন্য সেলফ্ আর চেয়ার টেবিল কীভাবে বানাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো তরু। নদীর ওই পাড়ে রহমত চাচার কাঠের কাজ করেন বহু বছর ধরে। চাচার সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে তরু নিজের ঘরের কাপড় রাখার আলনা দিয়ে বইয়ের সেলফ্ বানানোর কজটা সেরে ফেললো। চেয়ার টেবিল কেনার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই। তবে তাই বলে কি আর তরু থেমে ছিলো? মাদুর বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা আর বই রেখে পড়ার জন্য কয়েকটা ছোট ছোট পিঁড়ি কিনেছিলো সে। আর বাকি টাকা দিয়ে মালা আপাকে ঢাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি বই আনতে দিয়েছিলো। এক এক করে সব গুছিয়ে নিলো তরু। আর লাইব্রেরিটার নাম দিলো প্রদীপ। তাঁর দাদার নামে, যিনি তরুকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প। এরপর পুরো গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা জানায় সে। লাইব্রেরি শুরুর দিন সকালে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো কখন সবাই আসবে তাঁর লাইব্রেরিতে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গিয়েছিলো। তবুও কেউ আসেনি। শুধু কাজে যাওয়ার আগে আব্বা একবার এসে উঁকি দিয়ে গিয়েছিলেন, তবে ভেতরে ঢুকেননি।
আম্মাও এসেছিলেন। তিনি অবশ্য ভেতরে ঢুকে একটু ঘুরে দেখেছেন। তবে চোখেমুখে নিরাশার রেখা নিয়ে! আর সেখানে বসে বই পড়া তো অনেক দূরের কথা! যদিও তাঁরা দুজনের একজনও পড়তে জানেন না। তাতে কী হয়েছে? তরু তো সেই ব্যবস্থাও রেখেছে। এক কোনায় মাদুর বিছিয়ে রেখেছে যেখানে সে মাঝে বসবে আর তাকে ঘিরে বসে থাকা সবাইকে সে গল্প শোনাবে। প্রতিদিন পাক্কা এক ঘণ্টা সে বরাদ্দ রেখেছে বই পড়ে শোনানোর জন্য। তাই যারা পড়তে পারে না তাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। তাঁর মতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, কথা আর গল্পগুলো তবুও সবাই জানবেই জানবে! মাকে সব বললো তরু। মা বললো যে, কয়েকজন আগে আসুক তারপর নাহয় গল্প শুনতে বসা যাবে। মা অন্ততপক্ষে রাজি হলেন, তাতেই বেজায় খুশি তরু। হঠাৎ চার থেকে পাঁচটা বাচ্চা আসলো। খুব আশ্চর্য চোখ নিয়ে দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। তরু ইশারা করে তাদের কাছে ডাকলো। সবাইকে বললো পছন্দমতো একটা বই নিয়ে আসতে। বইগুলো দেখে বাচ্চারা কিছু না বুঝলেও, আগ্রহ যে পাচ্ছিলো তা ঠিকই তরুর নজরে পড়েছে। সবাই মিলে তরুর কাছে একটি বই এনে দিলে তরু পড়ে শোনাতে লাগলো আর খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সবাই। এরপর দিন গড়াতে থাকলো আর এক এক করে সবার পদচারনায় জ্বলে উঠলো তরুর প্রদীপ। আর ছড়িয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস, গল্প ও কথা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১২:৫৫