ইঞ্জিনীয়ারদের জন্য দেশে কাজের পরিবেশ খারাপ। খারাপ বললে আসলে যথাযথ বলা হয় না। গায়ের চামড়া যথেষ্ট মোটা না হলে কারো পক্ষে দেশে চাকুরি করা সম্ভব না। বেসরকারি চাকুরিক্ষেত্রে মালিকপক্ষের যথেচ্চারিতা, নিম্নবেতন, দৈনিক দীর্ঘ সময় কাজ করা, বাজে ব্যবহার, অনৈতিক কাজকর্ম- সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি মোটেই অনূকুল না। আর সরকারি চাকুরির অবস্থা আরো খারাপ। সরকারি জবে ক্যারিয়ার ডেভেলপের কোন সুযোগ নাই। সিনিয়রদের তেল মেরে চলতে হয়, ঘুষ খাওয়া সরকারি ইঞ্জিনীয়ারদের জন্য এক রকম বাধ্যতামূলক কেননা নইলে হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। যদি কেউ নাও খায়, তাকে অন্যদের খাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন এত লোকের দুর্নীতি খুজে বের করল, কিন্তু সেখানে ইঞ্জিনীয়ারদের সংখ্যা খুব কম। এখানে সবাই টাকার ভাগ পায়। কেউ টাকার ভাগ না নিতে পারে সেটা তার ইচ্ছা, কিন্তু অন্যদের অবৈধ টাকা উপার্জনে বাধা দিলে তার জীবন দুর্বিষহ করে দেয়া হয়।
এই আমিই ত বাংলাদেশের সরকারি আর বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই চাকুরি করে ফেললাম। যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে দুই সেক্টরেই চাকুরির পরিবেশ খুব খারাপ। পাশ করার পর আমার বারবার মনে হয়েছে, চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে টিউশনী করে জীবন চালাই।
বুয়েট থেকে পাস করে আসলাম। যখন আমার বন্ধুরা একে এক বাইরে চলে যাচ্ছিল, আমি বলেছিলাম, তোমার যেখানে সাধ চলে যাও আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাব।
বুয়েটের একজন অতি প্রিয় শিক্ষকের কাছে গিয়েছিলাম ক্লিয়ারেন্সে সই নেবার জন্য। তখন সদ্য পাস করেছি। উনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার রেজাল্ট কি? রেজাল্ট শোনার পর, স্যার আমাকে বার বার বলেছিলেন, দেশ ছেড়ে চলে যাও...ভাগো এখান থেকে। আমি স্যার এর কথা শুনি নাই। দেশে রয়ে গিয়েছিলাম।
যখন আমার একটা সরকারি চাকুরি হয়েছিল, আমি নিজের ঘরের কম্পিউটার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিলাম। আমার যুক্তি ছিল, অফিসের কাজকর্মে সুবিধা হবে। সরকারি অফিসে দক্ষ লোকের বড় অভাব, তাই অফিসের বহু রিপোর্ট আমি স্বেচ্ছায় করে দিয়েছি, চিঠি লিখেছি, টাইপ করেছি। সেই আমিই দশমাস পরে ট্রান্সফার হয়ে অন্য অফিসে এসে প্রথম যে কথাটা বলেছিলাম তা হল, আমি বাংলা টাইপ পারি না।
পাস করার মাত্র দুই বছরের মাথায় আমি এখন জুনিয়রদের বুদ্ধি দেই , খবরদার দেশে থাকবে না। পাস করো আর প্রথম সুযোগেই বাইরে চলে যাও।
যে স্বপ্ন নিয়ে দেশে থেকেছিলাম তা আজ বড় বিবর্ন। চোখের সামনে বহু অন্যায় দেখলাম, বড় কষ্ট লাগে আমার দেশের ইঞ্জিনীয়ারদের দেখে। একটা খুব ছোট উদাহরন দেই। আইলার পরের সপ্তাহের ঘটনা। চারিদিকে আইলার ক্ষতি নিয়ে আলোচনা, ক্ষয়ক্ষতির বিবরন জানিয়ে রিপোর্ট পাঠাচ্ছি। একদিন দেখি আমার অফিসে দুইজন অফিসার খুশিতে ডগমগ। আইলার শেষে অনেক টাকার বরাদ্দ আসছে। এই আইলাই আমার কয়েকজন কলিগকে লাখপতি করে দিয়েছে। আর্ত মানুষের কষ্টকে পুজি করেও এরা টাকা কামাতে দ্বিধা করে না। আমার চোখের সামনেই ত সব ঘটল। আমি বাধা দিতে পারি নাই। অসহায় হয়ে বসে বসে এদের কাজকর্ম দেখলাম। নিজের ক্ষুদ্রতায় রাগ হয়েছে, বার বার মনে হয়েছে, আমার পাপের ভান্ড কি ভর্তি হচ্ছে না?
গত সপ্তাহে IELTS দিয়ে আসলাম। বাইরে চলে যাবার কাগজপত্র তৈরী শুরু করব। সত্য কথা বলি, আমার দেশে থাকতে বড় ইচ্ছে করে। দেশে থাকতে ইচ্ছে করে যখন দিন শেষে ছোটবোন দুইটাকে দেখি । শুক্রবার দুপুরে বাসার সবাইকে নিয়ে যখন এক সাথে খেতে বসি, তখন মনে হয়, এক জীবনে মানুষ আর কতটুকু পায়? আমি ত দেশেই ভালোভাবেই বেচে থাকতে পারি। বৃষ্টির দিনে অফিস কামাই করে ঘরে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবি, এই বেশ ভালো আছি। কিন্তু এই সবই ক্ষনিকের জন্য। জীবনের অনিশ্চয়তা, দেশের কিছু মানূষের নীতি এবং কান্ডজ্ঞানহীন আচরনে বড় ভয় পাই।
পাস করার পর চাকুরি নিয়ে আমার যে হতাশা তার বিবরন লিখতে হলে পনের বিশ পর্বের একটা সিরিজ লিখতে হবে। সব কথা না বলি।
বাংলাদেশ একটা গরিব দেশ। গরিব হবার পরও অনেক টাকা খরচ করে আমাকে ইঞ্জিনীয়ার বানিয়েছে। দেশের প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে। এই সবই আমি জানি। তবুও কত দুঃখে যে আমার দেশ ছাড়তে ইচ্ছে করে সেটা আমার মত বুয়েট থেকে যারা পাস করে এসেছে তারাই বুঝবে। আমি জানি যদি আমি বাইরে যাই, আমি চোরের মত মাথা নিচু করে দেশ ছাড়ব। আমার বুকে কি আর দেশ ছাড়ার কষ্ট থাকবে না? কিন্তু কত হতাশা আর বেদনাকে আমি সঙ্গী করে নিয়ে যাব, তা শুধু আমিই জানি।
কত শুনলাম, বুয়েটের ছাত্র-ছাত্রীরা বড় বদমাশ। পড়াশুনা শেষ করেই দেশ থেকে উড়াল মারে। আমাদের ত আর কম গালি দেয়া হয় না। কিন্তু কেন যে উড়াল মারে, কেন নিজের চেনা জগতটা ছেড়ে অজানা দেশে পাড়ি জমায়-সেটা ত কেউ জানতে চায় না।
============================
বিপ্লব৯৮৪২ বলেছেন: ধন্যবাদ ।
চালিয়ে যান । আরো পড়তে চাই ।
খবরদার বিদেশে বাঙ্গালী মালিকানা এবং বাঙ্গালি কলিগ আছে এমন জায়গায় কাজ নিবেন না ।ডিগ্রি শ্রেনিতে আগে বংকিমচন্দ্রের “তৈল” নামে এক প্রবন্ধ ছিল ।সরকারি অফিস আদালতে কিভাবে তার ব্যবহার হয় তা পড়ে শিক্ষাথীরা চাকুরীতে কাজে লাগাতে পারত।এখন শিক্ষাথীরা বইতে পড়ছে দুর্নিতিবিরোধি প্রবন্ধ , চাকুরি ক্ষেত্রে এসে দেখছে দুর্নিতিবান্ধব পরিবেশ ।দুই বৈপরিত্যে ক্ষেই হারিয়ে ফেলছে সবাই ।আমি শিক্ষাকমিটিকে অনুরোধ করব , সেই “তৈল” এবং দুর্নিতিবিরোধি প্রবন্ধ এর পরিবর্তে “ঘুষ খাও টিকে থাক” জাতীয় নতুন প্রবন্ধ চালু করতে ।যেন একজন মানুষ সরকারী চাকুরীতে ঢুকে নিজেকে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে ।
================
জুমানজি১১ বলেছেন: আমি ২০০৭ এ পাশ করার সময় চিন্তা করেছিলাম...আর যাই হোক দেশে ছেড়ে যাবো না। ১২/১৫ হাজার বেতনের চাকুরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম। ২ জায়গায় ইন্টেরভিউ ও দিলাম। সব ই ঠিক ছিল, যেই আমার রেসাল্ট দেখল, বল্লো তুমি ত এখানে থাকবে না। আমি শত যুক্তি দিয়ে বোঝালাম, লাভ হলো না।
শেষে ২ বছর বাইরে থেকে এম এস করে আসলাম। এবার ও নিওত ছিল দেশে কিছু করার। কিন্তু এখন অবস্থা আরো শোচনীয়, একবার বিদেশী সিল পরাতে এখন কেউ দাকেও না . বেশ কয়েক মাস ট্রাই দেয়ার পর এখন আবার চলে যাচ্ছি পি এইচ ডি করতে।
মাঝে মাঝে মনে হয় বুয়েটে পড়ে কি কোনো পাপ করলাম...কিংবা রেসাল্ট টা এক্টু উপরের দিকে না হলেই বোধ হয় ভালো হত। আবার মনে হয়, মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম, অখানে পড়লে দেশে এট লিস্ট কিছু করার ওয়ে থাকত। বুয়েটে পড়াকালীন যে ভালোলাগাটা কাজ করত, সেটা এখন আর নেই, এখন শুধুই আক্ষেপ আর দূরে ঠেলে দেবার যন্ত্রনা। (এটা অবশ্য তাদের জন্য যারা দেশে থাকতে চায়)
==============
নুভান বলেছেন: যখন আমি লেভেল-৪ এর ছাত্র, তখন থেকেই পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজন সবাই বলতে লাগলো, এই পাশ করেই তো উড়াল দিচ্ছো। গর্বে মাটিতে আমার পা পরেনা, নিজ দেশেই নিজেকে প্রবাসী মনে হতে লাগলো। কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছে ছিলো দেশে কিছু একটা করি। আবার ভয়ও ছিলো। কারন আমার এক আত্মীয় খুলনা বি আই টি(বর্তমান খুয়েট) থেকে পাশ করে পানিসম্পদ প্রকৌশলে চাকুরী নিলেন। আয়ারল্যান্ড থেকে মাস্টার্সও করে এলেন। সৎ মানুষ ছিলেন তিনি। তীস্তা ব্যারেজের কাজের সময় টেন্ডারবাজরা তাকে পিস্তল ধরে সামনে ২ লক্ষ টাকার বান্ডিল ফেলে দিয়ে বলে, হয় টাকা নিয়ে টেন্ডার দিবি নাইলে গুলি খেয়ে মরবি! অতঃপর চাকুরী ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশে পিএইচডি করে এখন শিক্ষকতা করছেন।
আমি বেসরকারী চাকুরীর দিকে ঝুকলাম, সারাজীবন ঢাকায় থেকে গেলাম চিটাগাং-এ। শিফটিং ডিউটি, বেতন - নাই বা বললাম। তবুও স্বান্তনা ছিলো যে একটা দেশীয় প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছি। কিন্তু যখন দেখি আমার বন্ধু যে কিনা পড়াশুনায় অনেক পেছনে ছিলো আজ চটকদার একটা প্রতিষ্ঠানে কাস্টমার কেয়ারের জব করে আমার দ্বিগুন কামাচ্ছে, তখন ঈর্ষাণ্বিত হইনি ঠিকই-শুধু মনে প্রশ্ন জাগলো, গাধার মত কেন এতগুলো বছর খাটলাম। সেটাও মানা গেল, মেজাজ চরমে পৌছালো আমাদের সবার (সেবার আমরা ৬ জন বুয়েট থেকে পাশ করে সে প্রতিষ্ঠানে জয়েন করেছিলাম) যখন দেখি অন্ডার মেট্রিক ভারতীয় অপারেটর আমাদের সাথে মাতবরী ফলাবার চেষ্টা করে। অভিযোগ করেও লাভ নেই জিএম, ডিজিএম নিশ্চুপ। যেহেতু তারা বিদেশী তাহলে তারা অবশ্যই বেশী জানে আমাদের থেকে ! ৬ মাস পর আমাদের বেতন বৃদ্ধির কথা ছিলো, বেতন বৃদ্ধি করল। কত জানেন? ১ হাজার টাকা মাত্র ! রাগে দুঃখে ৬ জন একসাথে রিজাইন দিয়ে চলে এলাম। এদের মধ্যে আমরা ৫ জন-ই এখন দেশের বাইরে ও ১ জন ইস্টার্ন রিফাইনারীতে জয়েন করেছে।
এখন বলুন, বিদেশে যেতে চাওয়া বা সেটেল্ড হবার ইচ্ছেটা কি অন্যায়? চেষ্টাতো কম করিনি দেশে থাকার জন্য, কিন্তু দেশ যে আমাদের চায় না।
============================
মুহম্মদ জায়েদুল আলম বলেছেন: এবার তাইলে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি বুয়েটের না। শাহজালাল থেকে পাশ করা। ৪/২ এর পরীক্ষা শেষ হবার আগেই চাকরী পেয়ে গেলাম। র্যাংসটেল এ। দেশী কোম্পানী। জিপি,বাংলালিংক দেশের সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে। আমাদের দেশের র্যাংকসটেল হবে ভারতের রিলায়েন্সের মতো দেশী কোম্পানী। একদিন জিপি, বাংলালিংক কেও আমরা কিনে নেবো। সবে মাত্র পাশ করে চাকরীতে ঢুকেছি। সুতরাং একটা কিছু করে সবাইকে চমকে দেবার জন্য মুখিয়ে আছি। আর দেশ দেশ করে প্রায় সবার মাথা খারাপ করে ফেলছি। সাথের বন্ধু বান্ধব দেশ ছাড়ছে। আমি ছাড়বো না। নিজেদের একটা বিলিং সলিউশন বানাবো। র্যাংকসটেলে ছিলেন জাকারিয়া স্বপন স্যার। তিনি সাহস করে নিজেদের একটা বিলিং সলিউশন দিয়ে র্যাংসটেল শুরু করেছিলেন। সেই সিস্টেমকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। দিন রাত কাজ করতাম। দারুন একটা বি,আই মডিউল করলাম। যেটা এখনকার ভালো ভালো সলিউশনের ও নাই। অথচ লাভ কি হলো? কিছুই না। দেখলাম কাজ না করে যারা কেবল উপরের মহলে তদবীর করে চলে, তারাই উঠি গেলো উপরে। দেশের প্রতি কাজের ইচ্ছে ততদিনে ধুলোয় মিশে গেছে।
এখন একটা ইন্টারনেশনাল বিলিং সলিউশনে কাজ করি। কিন্তু তারপরও বারবারই মনে হয়, আমরা বানিয়েছিলাম এমনই একটা সলিউশন যেটা কয়েকশ কোটি টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪৯