সারাদিন অসহ্য গরম গিয়েছে,এখন একটু
বাতাস ছেড়েছে।গরম কমেছে,আকাশে
মেঘের আনা ঘোনা।কে যানে হয়তোবা বৃষ্টিও
নামবে।অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছেনা,এখন হওয়া উচিৎ।
.
রাত ৮টা বাজে।
.
আমি বসে আছি ময়মন সিংহ রেল ষ্টেশনে।
ঢাকার ট্রেন ধরবো।ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে
রাত ১১টায়।অপেক্ষা ছাড়া বর্তমানে আমার
আর কিছু করার নেই।
.
বসন্ত তার আগমনের সুসংবাদ দিচ্ছে।শীত
কাল এখনো পুরোপুরি তার বিদায় ঘন্টা
বাজায়নি।তাই রাত বাড়ার সাথে সাথে শীত
কিছুটা আকড়ে ধরতে শুরু করলো আমাকে।
.
ভাগ্য ভাল,বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আম্মু
এক রকম জোর করেই আমার স্যুটকেসে একটা
সোয়েটার পুরে দিয়েছিল।আম্মু কি আগে থেকেই
জানতো যে আমাকে রেল ষ্টেশনে এসে ট্রেনের
জন্য রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?
.
হয়তো জানতো!!না হলে এভাবে জোর করে
আমার ব্যাগে সুয়েটার ডুকিয়ে দিবে কেন?
শুনেছি..সন্তান যখন কোন বিপদে পড়ে সবার
আগে খবর পায় মা।আগে যেহেতু খবর পায়
তাহলে পরে বিপদে পড়লেও পাবে এটাইতো
স্বাভাবিক।সত্যিই মায়ের কোন তুলনা হয়না।
.
সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে সময় কাটানোর জন্য
একটু অদূরে একটা চায়ের দোকানে আশ্রয়
গ্রহন করলাম।মশাদের জন্য রেল ষ্টেশনের চেয়ে
উত্তম আর কোন জায়গা হতে পারেনা।আমাকে
পেয়ে মশা সেটাই সুদে আসলে উসূল করার
চেষ্টা করতে লাগলো।কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে
পারলাম আর কিছুক্ষন এখানে বসে থাকলে
আমার আর সুস্থ শরীরে ঢাকায় যাওয়া হবেনা।
.
তাই যথা সম্ভব দ্রুত এক কাপ চাঁ খেয়ে আর
মশা থেকে বাচাঁর জন্য একটা কয়েল কিনে
সেখান থেকে কেটে পড়লাম।রেল ষ্টেশনের
ওয়েটিং রুমে এসে কয়েলটা জালিয়ে অপেক্ষা
করতে লাগলাম ট্রেনের জন্য।ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় ১০টা বাজে। তার
মানে ট্রেন আসতে আর মাত্র ১ঘন্টা বাকি।
'
.
কাটায় কাটায় ১১টা বাজার ঠিক ২ মিনিট আগে
একটা ট্রেন এসে থামলো ময়মন সিংহ রেল ষ্টেশনে।
আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওয়ানা দিলাম ট্রেনের
দিকে।
.
এমন এক জায়গায় সিট যেখানে মানুষের কোন
নাম গন্ধও নেই।হয়তো রাত বলেই কোন মানুষ
নেই।যাক আমার জন্য ভালই হইছে,মনের সুখে
নিরবে বসে রাতের নির্মল প্রকৃতি আর হুমায়ূন
স্যার এর কয়েকটা বই গ্রো গ্রাসে শেষ করতে
পারবো।
.
আমার ধারনাটা ভুল প্রমাণীত করে কিছুক্ষনের
মধ্যে বেশ-কজন লোক এসে বসলো আমার
আশ-পাশে।তারাও হয়তো ঢাকায় যাবে।কিন্তু
আমার এসব ভাবার সময় এখন নেই।আমি
জানালার পাশে বসে হুমায়ূন আহমেদের বাদল
দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল বইটা বের করে পড়া
শুরু করলাম।
.
আশ-পাশের হকারদের বেসামরিক নির্যাতনে
আমার পড়ার মোডের ১৩টা বেজে গেল।কেউ
চানাচুর কেউ ঝাল মুড়ি নিয়ে কানের কাছে এত
ঘ্যাণর ঘ্যাণর করলে বিরক্ত না হয়ে উপায় আছে?
পাঁচ টাকার চানাচুর না কেনা পর্যন্ত শান্তি নেই।
এক পিচ্চি হকারের কাছ থেকে পাঁচ টাকার
চানাচুর কিনে না খেয়ে হাতে ঠুঙা নিয়ে বসে রইলাম
যাতে আর কেউ বিরক্ত করতে না পারে।এদের
হাত থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়।
'
.
-এই যে ভাই উঠেন!!এইটা মনে হয় আমার সিট।
এমন একটা মেয়েলী কন্ঠ শুনে আমার পড়ার মধ্যে
কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলো।আমি মেয়েটার দিকে লক্ষ
করলাম।একজন ভদ্র লোক মনে হয় মেয়েটার
সিটে বসেছে তাই মেয়েটা লোকটাকে উঠে যেতে
বলতেছে।
.
মেয়েটার কথা শুনে লোকটা যেন ঘুম থেকে চোঁখ
খুলে তাকালো।মেয়েটাকে দেখে মনে হয় কোন
পাত্তাই দিলোনা।আবার চোঁখ বন্ধ করে আরামসে
ঘুমের অতল সাগরে হারিয়ে গেল।মেয়েটা কি
বলবে ভেবে পেলোনা,আবার চিৎকার দিতে যাবে
আমি তার আগেই বললাম'আপনি এই সিটটায়
বসতে পারেন।
.
মেয়েটা আমার দিকে ঘুরে তাকালো।আমার মত
আতেল আতেল ভাবের একটা ছেলে,চোঁখে মোটা
কাল রীমের চশমা,হাতে মোটা বই দেখে নিশ্চই
মেয়েটা কিছু বিরক্ত হল।আমি মেয়ের চেহারা দেখে
এটাই নিশ্চিত হলাম।
.
আমার ঠিক অপর পাশে সামনের সিটটা খালি।
ব্যাগটা মেঝোতে রেখে ওই সিটটাতেই বসলো
মেয়েটা।তারপর আমার দিকে একটু ঝুকে বললো,
'
আপনি তো মহা সুবিধা বাদী মানুষ!মেয়ে মানুষ
দেখেই নিজের উল্টো পাশে বসানোর জন্য পাগল
হয়ে গেলেন?সত্যিকারের পুরুষ যদি হতে চান
তাহলে আমার সিটটা আমাকে দেওয়ার ব্যাবস্থা
করে দেন দেখি!!
.
আমি চুপচাপ মেয়েটাকে এক নজর দেখলাম।
তারপর কিরন মালার রাক্ষসী রাণী কটকটির
জামাই বিটকেলের মত একটা আতেল মার্কা
হাসি দিয়ে আবার ডুবে গেলাম পড়ার জগতে।
মেয়েটার কথার কোন জবাবই দিলামনা।
.
এত বড় কথার পরেও কোন ছেলে যে শান্ত ভাবে
বসে বই পড়তে পারে সেটা যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা
মেয়েটার।মেয়েটা কিছু রেগে গিয়ে বললো আমি
এখানে বসবোনা।আমি তাতেও কোন জবাব
দিলামনা।মেয়েটার এবার একটু মন খারাপ হল।
একটু অভিমানও বোধহয় জন্ম নিয়েছে আমার প্রতি।
.
মেয়েটাকে দেখে মনে হল কারো অবহেলা ওর সহ্য
হয়না।চুপ করে জানালা দিয়ে তাই দৃষ্টি বাড়িয়ে
বসে রইলো।কিন্তু মেয়েটার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে
এভাবে চুপ করে বসে থাকার মত সে নয়।পুরো
ট্রেনের ভিতর আমাকে একটু মনে হয় সুবিধার
মনে হয়েছিল মেয়েটার।কিন্তু আমি তো বইয়ের
ভিতর ডুবে আছি!!তাই মন খারাপ করে একটু
একটু করে ঘুমের সাগরে উড়াল দিতে শুরু করলো
মেয়েটা।
.
মেয়েটার জন্য এবার সত্যিই আমার মন কিছুটা
খারাপ হল।তাই মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম
বই পড়বেন?মেয়েটা চোঁখ মেলে তাকালো,অবাক
হয়ে একটু ভাবলো....আমাকে বললো নাকি?
আমি বললাম আমার কাছে কাছে কিছু থ্রিলার
বই আছে,পড়তে খারাপ লাগবেনা।পড়বেন?
.
মেয়েটা ছোট্র করে জবাব দিল'নাহ।তারপর আবার
চোঁখ বন্ধ করলো,প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা
আর কি!!আমি আবার চুপ করে বই পড়তে
শুরু করলাম।মেয়েটার ঘুম ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে।
শুধু যে ভেঙে গেছে তা নয়,কোন এক অচিন
রাজ্যে পালিয়েও গেছে মনে হয়।তাই উঠে বসলো
আবার।বললো আপনি কি লেখক-টেখক নাকি?
.
আমি মৃদু হেসে বললাম,নাহ আমি লেখক নই।
তবে অনেক বড় পাঠক।
.
তাহলে এত পড়ে কি লাভ??প্রশ্ন করে উত্তরের
জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো মেয়েটা।
.
হুমায়ূন স্যারের বই পড়ার সময় লাভ খুজতে নেই।
একটু হেসে জবাব দিলাম আমি।আমার উত্তর
শুনে মেয়েটা হাসতে হাসতে গড়াগড়ির মত অবস্থা।
.
এই প্রথম মেয়েটার দিকে ভাল করে লক্ষ করলাম।
যখন হাসছিল খুবই সুন্দর লাগছিল মেয়েটাকে।
হাসার সময় মেয়েটার দু গালে টোল পড়ে।তার
কারনে হাসিটা আরো বেশি নির্মল এবং সুন্দর
দেখায়।এই হাসি দেখে আমি নিশ্চিত যে কোন
ছেলেই তার প্রেমে পড়ে যাবে।আমিই বা তাদের
থেকে ব্যাতিক্রম হতে যাবো কেন?
.
মেয়েটার হাসি দেখে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম।
আশ-পাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,এখানে
হাসির কি হল?কখনো কি হুমায়ূন স্যারের বই
পড়েননি?
.
হাসির দমক থামিয়ে মেয়েটা কোন রকম ভাবে
জবাব দিল'পড়েছি।কিন্তু পাহাড়ের মাঝে একে
বেকে যাওয়া রেল পথ,লোহার ব্রীজ আর দু পাশের
ঘন সবুজকে ফেলে রেখে কেউ হুমায়ূন পড়ে
প্রকৃতি খুজতে পারে সেটা আমার মাথায় আসেনি।
.
মেয়েটার উত্তর শুনে আমার মুখের হাসি মুছে
গেল।সেটা মেয়েটার চোঁখ এড়ালোনা,বললো
মন খারাপ করলেন নাকি?হুমায়ূন হিমু হতে
শেখায়,হিমু হতে গিয়ে অন্ধ হতে শেখায় নাহ।
বুঝলেন মশাই?
.
আমি ছোট্র করে মাথা নাড়লাম,যেন সব বুঝতে
পেরেছি।মেয়েটা এখানেও আমাকে রেহাই দিলনা।
বললো আপনি কি সব সময় যে যা বলে তাই মেনে নেন?
.
আমি এবার ভাবতে শুরু করলাম,এ কোন নতুন
ফাঁদ না তো??ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন?
আপনিতো কোন ভুল বলেননি,মেনে নিতে সমস্যা
কোথায়?
.
মেয়েটা কিছুক্ষন হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো
আমার দিকে।মেয়েটার দুষ্টোমি মার্কা হাসি দেখে
আমার মনের ভিতর যা ছিল সব আউলা ঝাউলা
হয়ে গেল।
.
তারপর মেয়েটা বললো,এটুকু তো কাউন্টার যুক্তি
দিতেই পারতেন যে---পাহাড়ের মাঝ দিয়ে একে
বেকে যাওয়া রেল পথ-লোহার ব্রীজ আর দু
পাশের ঘন সবুজ দেখার জন্য দিনের আলো চাই,
রাতের বেলায় দেখবো কিভাবে?
.
এবার আমি নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।বোকার
মত হেসে বললাম ঠিকই আছে,যান-আজ আর
কোন বই-ই পড়বোনা।বুঝতে পারছি যতক্ষণ বই
পড়বো ততক্ষণ আপনি আমাকে বোকা বানাতেই
থাকবেন।
.
মেয়েটা এটাও মানতে নারাজ-বললো,আপনাকে
বোকা বানানোর কি এমন ঠেকা পড়েছে?আপনি
তো এমনিতেই বোকা।
.
ঠিক আছে কিছু বুদ্ধি ধার দেন তো দেখি!!
.
মেয়েটা বললো,হুমম দেখি দেওয়া যায় কি-না!
.
মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে হারিয়ে
গিয়েছিলাম অন্য এক স্বপ্নের জগতে।কখন যে
রাত ২টা বেজে গেছে টেরই পায়নি।কমলাপুর রেল
ষ্টেসনে এসে প্লাটফর্ম দেখে বুঝতে পারলাম আমরা
ঢাকায় চলে এসেছি।আরেকটু লেট করে আসলে
কিই-বা ক্ষতি হয়ে যেত তাদের?
.
তারপর দুজন এক সাথেই স্টেশন থেকে বের
হয়ে আসলাম।তারপর বায় বলে দুজনে হাটা
দিলাম নিজেদের গন্তব্য দুই মেরুর দিকে।
'
.
৩ বছর পর....
.
কমলাপুর রেল ষ্টেশনে ট্রেনের ভিতর বসে হুমায়ূন
স্যারের বই পড়ছি।পাশে বসে আছে মেয়েটা।একটা
সময় ট্রেনটা তার চিরচারিত নিয়ম অনুযায়ী ঝন
ঝন শব্দে চলতে শুরু করলো সবুজ অরণ্যের
মাঝ দিয়ে।হঠাত করে মেয়েটা আমার হাত থেকে
বইটা ছিনিয়ে নিল।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে
বুঝলাম সুন্দর অভয়ারণ্য না দেখে বই পড়ার
কারনে আমার উপর বেশ বিরক্ত।তাই কিছু না
বলে দুজনে দুজনের হাত ধরে হারিয়ে যেতে
লাগলাম সবুজ প্রকৃতির মাঝে।
.
গল্পের শেষটা যদি এমন হত-তাহলে হয়তো
আমার চেয়ে আনন্দিত আর কেউ হতনা।
কিন্তু না-আমার মত আতেল ছেলেদের ভাগ্যে
এত ভাল মেয়ে জুটেনা।
.
সেদিন ষ্টেশন থেকে বিদায় নেওয়ার পর আর
কখনোই মেয়েটার দেখা পাইনি আমি।
আজও যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য কমলাপুর রেলে
যার্নি করি,ট্রেনের ভিতর বসে হুমায়ূন স্যারের
একটা বই নিয়ে হাতে পড়তে থাকি,হয়তো এক
সময় মেয়েটা এসে বলবে তুমি তো দেখছি আগের
মতই বোকা রয়ে গেছ!!এত সুন্দর সবুজের
সমাহার না দেখে কেউ বসে বসে বই পড়ে?
.
আচ্ছা,বহু দূরে থাকা মেয়েটার কি এখনো আমার
কথা মনে পড়ে?কখনো কি অন্য কারো হাতে
হাত রেখে ভাবে ছেলেটা কি আজও ট্রেনের ভিতর
বসে সবুজের বুকে বাক নেওয়া অসংখ্য সবুজ
দৃশ্য উপভোগ না করে হুমায়ূন আহমেদের বাদল
দিনের দ্বিতীয় কদম ফুলের মত কোন বই
পড়ে!!