প্রথমেই বলে নেই।এটি আমার লিখা নয়।খুব বেশিই ভালো লাগলো বলে শেয়ার করলাম।
#
যে মেয়েটিকে আমি পছন্দ করি, তার পছন্দের কোন রং নেই। মেয়েটিকে রং ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সে দ্বিধায় পড়ে যায়। তাই, ঘর থেকে বেরোনোর সময় আমি প্রিয়জনের পছন্দের রঙের শার্টটি পড়ে বেরোতে পারি না।
এ নিয়ে আমার তিলমাত্র দুঃখটি নেই।
.
#
মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় প্রায় ছ'বছর আগে।
ছ'বছর আগে তার বাবা একজন সরকারী চাকুরে ছিলেন, ভদ্রলোক আমার বাবাকে স্যার বলে ডাকতেন।
দাওয়াতে আমি সচরাচর যেতে চাই না, "সপরিবারে দাওয়াত" ব্যাপারটা আমি পুরোপুরি এড়িয়ে চলি।
সেই ভদ্রলোক একবার আমাদের বাসায় এলেন কার্ড হাতে.... মেয়ের বিয়ের কার্ড।
যাবার আগেও তিনি আরেকবার মিনতি করে গেলেন আমার মায়ের কাছে। কাছে পেয়ে আমাকেও একপ্রকার জোর করেই বললেন, "তুমি না এলে কিন্তু আমি মেয়ের বিয়েই দিবো না! "
.
মেয়েটিকে আমি প্রথম দেখি তার বড়বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের বাইরে এক কোণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি মেয়েটার গান শুনছিলাম।
"মুক্তোমালার ছাতি মাথায় বর্ষা এল রে,
সারা গাঁয়ে গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিল রে" —এইরকম একটি গান। তার গানের গলা ভালো।
সেদিন বৃষ্টির তেজ বেশি ছিলো না, তবে আমি চুবাচুবা হয়ে ভিজে গেলাম।
.
যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি তার দৃষ্টিশক্তি নেই।
চোখে দেখতে পায় না মেয়েটা।
তার চোখও বিশেষ মোহনীয় নয়। ছেলেবেলায় কিছু একটা রোগে সম্ভবত মেয়েটার চোখের জ্যোতি হারিয়ে যায়। আমি কিছু একটা রোগের খোঁজ করার চেষ্টা করিনি।
মেয়েটার প্রতি বিতৃষ্ণা আসার বদলে আমি আগের চেয়েও জোরালোভাবে আকর্ষিত হতে থাকলাম। অনেকেই ভাবতেন তখন, আর আজও ভাবেন আমি দয়াবশে আকর্ষিত হয়েছিলাম।
ব্যাপারটা মিথ্যে।
তার বেণী করা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল... আমি প্রেমে পড়েছিলাম মেয়েটার টোল না পড়া হাসির। আর গানের।
মেয়েটা অসাধারণ গাইতে পারতো, এখনও পারে।
.
মেয়েটা কখনো বাইরে বেরোতো না বলে ওর দেখা পাওয়া হতো কম। রোজরোজ তো তার বাসায় যেতে পারি না আমি!
তবুও, কখনো কখনো সত্যিই চলে যেতাম। এমনি যেতে যেতে একদিন হুট করে গান শুনতে চাইলাম।
মেয়ে লাজুক হলেও বড্ড মিশুক, হয়তো কখনো কোন বন্ধু ছিলোনা বলেই এমন!
আমি কাপের পর কাপ চা শেষ করে দিতাম, ওর মায়ের দেয়া পিরিচের পর পিরিচ চানাচুর খেয়ে নিতাম....
মেয়েটা অসাধারণ গাইতো। না, ভালোবাসি বলে বাড়িয়ে বলছি না একটুও।
তারপর একদিন মেয়েটাকে অনেক বোঝানোর পরেও বোঝাতে পারিনি যে, আমি সত্যিই দয়া দেখাচ্ছি না। অতবড় মাপের মহাপুরুষ হবার সাধ্য আমার নেই। আমি কেবল, মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি।
মায়ায় জড়িয়েছি মেয়েটার ভ্রুর উপর দেয়া লাল টিপের।
মায়ায় জড়িয়েছি বামদিক করে সামনে নিয়ে আসা বেণীর।
মায়ায় জড়িয়েছি ওর মায়ের বানানো চানাচুরের। বোম্বে সুইটসের চানাচুর ছিল, ওর মা পেয়াজ টমেটো সরিষা তেল দিয়ে মাখিয়ে দিতেন।মারাত্মক রকমের বেহেশতি খাবার ওসব!
.
আমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসি, গোলাপ তার খুব প্রিয়। তবে সে গোলাপের রং জানেনা। আমি মেয়েটাকে লাল রং বোঝানোর চেষ্টা করি, সে বোঝে না।
— ' আচ্ছা লাল কেমন? '
- ' এইই, রক্তের মত! '
— ' রক্ত কেমন?? '
- ' লাল! '
— ' লাল কেমন? '
- ' রুহ আফজার মত! '
মেয়েটা খিলখিল করে হাসে। ও জানে, আমাকে দিয়ে এসব হবে না।
.
বন্ধুসমাজে আমাকে নিয়ে টিপ্পনীর মাত্রাটা যেদিন খুব বেড়ে গেলো, আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির মুখে গ্লাসভর্তি কোক ছুঁড়ে হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম।
আমি সবকিছু মেনে নিতে পারি, সবকিছু "জাস্ট ফান" বলে উড়িয়ে দিতে পারি। আমি সত্যিই রসিকতা বেশ পছন্দ করি যদিনা তা মেয়েটি সম্পর্কিত হতো।
একটা সময় দেখা গেলো আমার বন্ধুবিশেষ অবশিষ্ট নেই। "চান্সে খাইয়া ছাইড়া দে " এবং "কানার জামাই" ততদিনে বাড়াবাড়ি রকমের জনপ্রিয়তা পেয়েছে ক্যাম্পাসজুড়ে।
আমি হতাশ হয়ে পড়লাম।যদিও, মেয়েটিকে কিছু বলিনি।
একদিন সে নিজ থেকেই জানতে চায়,
- 'তোমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে তোমাকে ক্ষেপায় অনেক, তাই না? '
— ' কই নাতো'
- ' আমি চোখে দেখতে পাইনা সত্যি, তবে জানো, আমি মন পড়তে পারি। আমি তোমার মন পড়তে পারি। '
— '.......... '
- ' আমার কারণে বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করোনা, কেমন? '
— ' কিন্তু..! '
- ' সত্যিই তো আমি অন্ধ। আমার দৃষ্টি নেই। কেউ কটু কথা বললে সে নিশ্চই মিথ্যাবাদী নয়। দোষটা বরং আমার। নিজ দোষেই আমি চোখে দেখতে পাই না।'
— 'চুপ করো! '
- ' বন্ধুর অভাব আমি বুঝি। তুমি চাইলেই আমায় ছেড়ে যেতে পারো। '
আমি ভাবলাম মেয়েটা বুঝি এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়বে।
হলো না।
আমি উল্টো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। মেয়েটা আমার চোখ মুছে দিতে গিয়ে নাক চোখ মুখ সবকিছু একসাথে ঘষতে শুরু করে। এত মায়া দেখে আমি দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে থাকলাম।
.
আমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসি তার সাথে আমার রাতজেগে চ্যাট হতোনা। রাতজেগে ফোনে কথা হতোনা। আমি শুনেছিলাম মেয়েটার স্কুলে যাওয়া হয়নি বেশিদিন।
বাবার অার্থিক অবস্থা মেয়েটিকে স্পেশাল স্কুলে যাবার সুযোগ দেয়নি।
এক দুপুরে আমি ওকে নিয়ে অরণীর কাছে গেলাম।
অরণী আমার বন্ধু।
কলেজ লেভেল থেকে।
অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটার পিছনে পুরো ইন্টারমিডিয়েট লাইফটা ঘুরেছি, পাত্তা পাইনি।
এখন স্বামীর লেক্সাসে চড়ে আগোরায় চাল ডাল কিনতে যায়।
অরণী কিছু একটা অর্গানাইজেশনের সদস্য, মেয়েটার ব্যাপারে শোনার পর আমায় বলেছিলো দেখা করতে।তাই নিয়ে এসে দুচারটে ফর্ম ফিলআপ করে দিলাম।
.
এক রাতে আননোন নাম্বারের কল সিরিভ করে আমি অজ্ঞান হয়ে যাবার মত করে অবাক হলাম। ফোনের ওপাশে মেয়েটা ছিল!
জানালো, কিপ্যাড চেপে চেপে আমার নাম্বার ডায়াল করেছে। অরণীর কাছ থেকে শিখে এসে মায়ের ফোন থেকে কল করেছে।
আমি সত্যিই এতোটা খুশি কখনোই হইনি... না মানে, পরে হয়েছিলাম। বলছি সেই কথা।
.
এমন না যে, মেয়ের মা বুঝতে পারেননি। তবুও, ঘটা করে, অনেকদিনের সাধনার শেষে বলে ফেললাম,
' খালা আমি সারাজীবন আপনার হাতের চানাচুর খাইতে চাই। আমি আপনার ছোট মেয়েকে বিবাহ করিতে চাই'।
আমি প্যান্ট গুটিয়ে রেখেছিলাম খিচ্চা দৌড় দেবার জন্য। মহিলার কান্না দেখে ইমোশনাল হয়ে আর দৌড় দিতে পারিনি।
আমি এবার আরো বড় ঝামেলায় পড়লাম। পুরো পরিবারকেই বোঝাতে গিয়ে বোঝাতে পারছিলাম না যে, আমি কোন প্রকারের মহাপুরুষ নই।
আমার পিতৃদেবকে বোঝানো অগ্নিপরীক্ষা ছিল। তাঁকে আমি ক্রোসোসোম এক্স ওয়াই দিয়ে গ্রাফ এঁকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যদিও, যে মা অন্ধ হলে যে বাচ্চা অন্ধ হবে, তা পুরোপুরি বাজে কথা।
তাও পিতৃদেব, তার অনাগত নাতি নাতনীদের দৃষ্টিশক্তির কথা ভেবে বিচলিত হচ্ছিলেন।
আমার মায়ের কথাবার্তা আরো ভয়ানক ছিলো।
' বাপ, এই মেয়ে বিয়ে করলে যদি তুই অন্ধ হয়ে যাস? আমার একটা মাত্র বড়ছেলে! '
.
আমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসি, সে আকাশের রং জানেনা। আমি তাকে সাদা রং বোঝানোর চেষ্টা করি।
-' আকাশ কেমন? '
— ' একটু সাদা, একটু নীল'
- 'সাদা কেমন? নীল দেখতে কেমন? '
— ' সাদা হলো বকের কালার। নীল ধরো, আর্জেন্টিনার পতাকার নীলটা আরকি'
তারপর আমরা দুজনে হাসি। আমার হাসি বড্ড বাজে, দাঁতের সাথে মাড়িও বেড়িয়ে যায়।
আমি মেয়েটাকে নিয়ে রাতে আকাশ দেখি। ও কালো রংটা চেনে। আমি চাইনি, রঙের ব্যাপারটা ঝাপসা রেখে ও আকাশ দেখুক। তাই ও যে রং চেনে, আমি সেই আকাশ চেনাবো ওকে।
' আকাশটা সত্যিই এত কালো? আমি যেমন দেখি? '
' নাহ, চাঁন তারা আছে তো!! '
' ওসব কেমন দেখতে? '
আমি ওর হাত আঁকড়ে ধরি। আঙুল ধরে ওর আঙুল দিয়ে মেঝেতে চাঁদ একে বোঝাই। তারা একে বোঝাই।
এরপর ও আমায় গান শোনায়। আমি শুধু প্রার্থনা করে যেতাম, হাজার বছরেও যেন এ রাত শেষ না হয়!
.
আমি যে মেয়েটিকে জীবনসঙ্গী করেছি, সে আমায় কোনদিন দেখেনি। শত পাওয়ার মাঝেও তার একটা বড় না পাওয়া। আমি ওকে বলেছি না দেখতে পেয়ে বড্ড ভালো হয়েছে। দেখতে পারলে কব্বে ছেড়ে চলে যেত!
মেয়েটা রেগে যায়। রেগে গিয়ে চুপ করে কাঁদে।
- 'আমার ভালোবাসা কি এতই মিথ্যে? তোমায় দেখতে পেলে আমি ছেড়ে চলে যেতাম? '
— 'আহা, আমি তো মজা করসি! '
- 'সবসময় তুমি এমন করো'
মেয়ের কন্ঠে অভিমানী সুর। আমি দুহাতে ওর গাল ছুঁয়ে দিই।
— ' জানো, তুমি কানলে তোমার গাল লাল হয়ে যায়। '
-' লাল কেমন? '
— ' এই মনে করো, গোলাপের মতন! '
- 'গোলাপ কেমন? '
— 'রুহ আফজার মত.. তোমাকে রুহ আফজার মত লাগতেসে! '
মান অভিমান কাটিয়ে আমি ওরে আমার চেহারার শেইপ বুঝাই। ও হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মনের ভেতর আমার ছবি আঁকে।
আমি ওকে মোবাইলে মেসেজ পাঠাতে পারিনা। বরং, আমার আঙুলকে কালিছাড়া কলম ভেবে ওর হাতের তালুতে বারবার 'ভালোবাসি' লিখি। মেয়েটা লজ্জায় একেবারে গুটিশুটি মেরে যায়।
.
বিয়ের পর ওর প্রথম জন্মদিনে একটা গিফট দেখে আমি বসে পড়লাম, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাইনি আমি।
আমার খুব কাছের কেউ একজন হয়তো, ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। তাই, নাম না লিখেই রঙিন কাগজে মুড়িয়ে একটি ছড়ি উপহার দিয়েছে।
আমি সেই ছড়ি সেই রাতে টুকরো টুকরো করে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিয়েছি আর গিফট হারাবার দুঃখে কি না জানিনা, মেয়েটা বেশ কেঁদেছিলো।
বুকে আছড়ে পড়ে কেঁদেছে।
আমি আরও একটি ওয়াদা করে ফেললাম তৎক্ষণাত।
আমি ঘরের একরুম থেকে অন্যরুমে ওকে কোলে করে নিয়ে যেতে শুরু করি। ব্যাপারটায় অবশ্য ওর আপত্তি ছিল না বেশি।
হুহ, থাকলেও মানে কে?!
আমি শপিংয়ে রাস্তায় খাবার দোকানে, আর বিয়ে কিংবা ঘরোয়া পার্টিতেও ওর হাত ধরে হাঁটতাম। আমি আজও জানিনি কে সেই ছড়িটি উপহার দিয়েছিলেন, তবে সেই ব্যক্তি ভেতরে ভেতরে পুড়ে গিয়েছিলেন বহুবার, আমাকে জীবন্ত ছড়ি রূপে দেখে।
.
আমার মা হেসে হেসে তার নাতনীদের সঙ্গে এসব বলেন, ' তোদের বাপ তো হিন্দী ছবির নায়কের থেকে কম না'।
আমার দুটো জমজ কন্যাসন্তান আছে। এদের নিয়ে আমি বাবার সামনে গিয়ে বগলে হাত দিয়ে অদ্ভূত শব্দ করতে করতে নাচতে চাই, সাহসে কুলোয় না বলে করা হয়নি।
মেয়েদুটো মায়ের হাসি পেলেও, মায়ের অক্ষমতা পায়নি।
.
এত সুখ পাবার জন্যে অন্তত আমার সৃষ্টি হয়নি।
মাঝে মাঝে সুখের ঠেলায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়। আবার ভাবি, মরে গেলে এই তিন মেয়েকে কে দেখবে!
আমার বাঁচাটা খুব বেশি দরকার। কারো বাঁকা টিপ সোজা করবার জন্যে, কাউকে আবার কাঁধে করে ঘোড়ায় চড়াবার জন্যে!
.
Writer Bahauddin Maruf
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৬ সকাল ১০:৫৩