দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে! একি স্বপনের ঘোড় নাকি সত্যি সত্যি কেউ ডাকছে বুঝতে খুব বেশী সময় লাগেনি হপুর! কান পাততেই শুনে মার গলা!
হপু ! এই হপু!!
কে?
দরজাটা খোলতো বাবা!
আজান পরছে মসজিদে!
সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ী এলে এই এক যন্ত্রণা! (তওবা তওবা!!) কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরটা আদায় না করা পর্যন্ত ডাকাডাকি চলবেই!
"বেহায়ার মত না ঘুমিয়ে নামাজটা আদায় করে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ" ভেবে আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে পড়ে সে!
দরজা খুলে পুকুর পাড় গিয়ে দুইটা বুকডন আর লিচু গাছে কয়েকবার উল্টা ডিগ দিয়ে তাড়াতাড়ি ওযুটা সেরে নিল!
ঘড়ে ফিরতেই দেখে নামাজের পাটিতে মা বসে তাসবিহ গুনছে!
কোনরকম দুই দুই চার রাকাত শেষ করেই শরীরটাকে এলিয়ে দিল পাশের খাটে! চোখদুটু ঠিকমত এখনো বুঝে আসেনি! এমন সময় মাথায় কারো হাত বুলিয়ে বিলি করার স্পর্শে বুঝছে মা শিয়রে বসে আছে!
মা কিছু কইবা?
নাহ! থাক! ঘুমা!
তুমি তো সাধারণত তোমার ঘড়েই নামাজ পড়! আজ আমার ঘড়ে নামাজ পরলা! কিছু কইতে চাচ্ছ মনে হচ্ছে! কইয়া-লাও!
১৩ বছর বয়সে তোর দাদা আমারে এই বাড়ীতে নিয়া আসার পর থেইকা আইজ পর্যন্ত বলতে গেলে তেমন কোন নিস্তার নাই! আমারও বয়স হৈছে! ওইদিকে তোর বাবা তো আইজ ৫ বছর যাবত ঘড়ে থাইকা ও না থাকার মত!
অল্প বয়সেই তোদের উপর পারিবারিক অনেক চাপ পড়ছে! বলতে গেলে তোদের অভিভাবক তোরা নিজেরাই! নিজেগো ভবিষ্যতের চিন্তা তোগো নিজেদেরই করতে অইবু!
যা চিন্তা করার তাতো নিজেরাই করতাছি! নতুন কইরা আর কি চিন্তা করতে কইতাছো একটু খোলাসা কইরা কও?
আরে বুদ্দু কোথাকার! বয়েস তো হৈছে ২৮ এর ঘরে! চাকরিও মাশাল্লা করছ একটা! বলছিলাম কি? একটা বউ নিয়া আইলে ভালৈতো না? আমি আর তোর বউ মিল্লা ভাংগাচোরা (পরিবারটারে) ঘড়টা আবার সাজাইয়া দিতাম!! বাচুম আর কয়দিন? সংসারটার দায়িত্বডা ঠিকঠাকমত বুঝাইয়া দিতে পারতাম!
অ---! এই কথা কওনের লিগা তুমি এই কাকডাকা ভোরে এত্ত আয়োজন করছ?
শুনো, ছোট দুই ভাই আর একমাত্র্র বইনেরে পড়ালেখার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়া শাদীর কোন চিন্তা ভাবনা নাই! সেই হিসেবে আরো নিদেন পক্ষে বছর ৫ এক ধরতে পার এসব চিন্তা মাথায় আনার চাপ্টার খুলুম ই না!!
এইবার যাও! ঘুমামু! ইট্টু শান্তিমত ঘুমাইতে দাও! ৮টার আগ পর্যন্ত কেউ ডাকেনা যেন! পুরান বাড়ীর মতি কাকায় আইলে পুকুরের দক্ষিনঝোপটা পরিস্কার করতে বইল!
সন্ধা ৭টা! বাসের লাস্ট ট্রিপতো ৮টায়! কালকে অফিস আছে! তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ব্যাগটা কাধে ফেলে বের হচ্ছে হুপু! বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের কাছে এসে সালাম জানিয়ে বের হল ঠিকই! শুধু মায়ের মুখে নেই সেই মিস্টি হাসি ! নিত্যাভ্যাসের সেই চুলে আচর কেটে দোআ দরুদ মাখা ফু আজ জুটেনি কপোলে! শত ব্যাস্ততা থাকলেও যিনি সদরদরজায় দাড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে খাকতেন যতদুর দেখা যায় ছেলের মুখ, আজ চালকাড়া ছেড়ে ওয়ালাইকুম ছাড়া আর কোন কথাই নেই কোন এক বিষন্নতায়!
.
.
.মঙ্গলবার! হুপু, নিত্যদিনের মতই আজও সারাদিনের কর্মব্যাস্ততাকে সময়ের নৌকায় পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিল ইট কাঠের ঝোপে গড়ে উঠা বছর তিনের পরিচিত চারকোনা এক ভাড়া করা কুঠুরিতে! রাত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে!! শুধু চোখ দুটুতে নেই ঘুম! এপাশ ওপাশ করতে করতে ক্রমেই ভাবনার জগতে ডুবে গেল এক সময়! চারপাখা ফ্যানের ঘুর্ণনে দেয়ালে ভেসে উঠা মার সেই আপন চেহারাটা ভেসে উঠে ম্রিয়মান! বলে চলে আনমনে::-
মা! মাগো!
তুমি হয়ত ভাবছ! তোমার এই বান্দর পোলাডা সারাজীবন একরোখাই থেকে যাবে! তোমার কস্ট নদীর কূলে ভীরবেনা কোনদিন প্রশান্তির নাবিক হয়ে!
বয়সের ভারে ন্যুব্জ তোমার ক্ষয়মান দেহে কায়িক শ্রমের ধকল আরও কটা বছর চলতেই থাকবে! বৃদ্ধ পেরালাইজড বাবাকে নিয়ে বটবৃক্ষের মত একহাতে আগলে রেখেছো পুরো পরিবারটাকে! এখন চাইছ একটা আশ্রয়! তোমার কাছে আমি হয়ত চিরদিন বান্দর এর উদাসীনই থেকে যাব!
কিন্তু আমিও চাই! তুমি একটা চুড়ান্ত আশ্রয় খুজে পাও নির্ভারতার হাতে!
তোমার সারল্যতার স্পর্শে, নিরহংকারী উপমার ছোয়া পেয়ে একজন সত্যিকারের পজিটিভ মানষিকতার কান্ডারী হয়ে প্রতিবেশীজনদের কাছে তোমার মতই একজন প্রিয়জন সজ্জন হয়ে তৈরী করে নিক নিজের অবস্থান!
কিন্তু ভেবেছ কি কখনও! এখনকার দিনের মেয়ে গুলো (০) কত আত্মস্বার্থচিন্তায় বিভোর? সামাজিক কালচার আর পারিবারিক ভোগবাদীতায় বেড়ে উঠা মেয়ে আত্মঅহমকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে তোমার মনে কস্ট দিয়ে বসবেনা তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? আমি না হয় বিবাহিত বন্ধুদের উদাহরন চিন্তা করে মনে মনে শান্তনা খুজব! তোমার মনে গেছে যাওয়া কস্ট লাঘব করার প্রতিষেধক তো আর কোন ওষূধ কোম্পানী এখনও বাজারজাত করেছে বলে জানিনা!
আর এককভাবে মেয়েটাকেই বা দোষ দেব কেন? সে তো তার কাজিন, কলেজ ইউনির বান্ধবীদের জীবনযাপনের প্রাসঙ্গিক তুলনাই নিজের ক্ষেত্রে পেতে চাইবে! কোন মেয়েই বা আর নিজের সুখটা ইনশিউর করতে না চায়!
তখনকার নিত্যদিনের ছেলের বউয়ের অহমবোধ আর মানসিক পীড়ন যন্ত্রনার চেয়ে এখনকার কায়িক শ্রম আর অনাবিল প্রশান্তি টাই অনেক অনেক শ্রেয়তর না?
আমিও চাই এভাবেই কাটিয়ে দেই আরো কয়েকটা বছর! ছোট ভাই বোন গুলো একাডেমিক পড়াশোনা শড়াশোনা শেষ করে নিজেদের বেইজমেন্টটা গড়ে নিক নির্ভেজাল মন্ত্রনে!.......মা! তোমায় আরও বেশী কস্ট দিতে চাই না বলেই তো....
এইসব হাবিজাবি ভাবতেনা ভাবতেই একদিকে মশার কামড় আর অন্যদিকে ঘামের স্রোতে ভিজতে ভিজতে হুপু লক্ষ করল কখন যেন ইলেক্ট্রিসিটি ফেইল মারছে তার ক্ষেয়ালই নাই!
ভাল থেক মা ! ভাল থেক নিরন্তর !
আমি নিশ্চিত, আগামি শনিবার এই বান্দরের পোড়ামুখটা দেখেই তুমি ভুলে যাবা ক্ষনিকের অভিমান! আর এই রমজানের প্রতিটা তারাবিহ শেষে দুহাত তুলে দোআ করো তোমার এই বান্দরটা যেন এমনি ভাবে স্বাধীন বান্দরই থাকতে পারে আরো কয়েকটা বছর!!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ১০:৪৯