somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পবন তাঁতীঃ চা শ্রমিকের আলোর দিশারী, একাত্তরে শহীদ

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ৫ ডিসেম্বর চা শ্রমিক সমাজের জন্য শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে চা শ্রমিক সমাজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট, পূর্ব বাংলার লাধিক চা শ্রমিকের আলোর দিশারী, চা শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক, অসহযোগ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল সংগঠক পবন কুমার তাঁতীকে পাক-হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় সিক্ত চা শ্রমিকরা আজোও তার স্মৃতিসৌধে পুষ্প অর্পণ ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে থাকেন। পবন কুমার তাঁতী মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানে ১৯৪১ সালের ১লা জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। রাজঘাট চা বাগান স্কুল থেকে তার শিক্ষা জীবন শুরু। মেট্রিক পাস করে সিলেট এমসি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বাড়ি ফিরেন।

কর্মজীবন শুরু করেন ভানুগাছ থানার আদমপুর তেতইগাঁও হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে। তখন অশিক্ষা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার মধ্য থেকেও অকান্ত পরিশ্রম করে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। শিক্ষকতার সাথে সাথে সিটি কলেজ থেকে মাষ্টার্স কমপ্লিট করে বাগানে ফিরে এসে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত চা শ্রমিকদের কল্যাণে। তিনি ইচ্ছে করলেই আরাম আয়াসে জীবনযাপন করতে পারলেও, নিজের কথা চিন্তা না করে নিজেকে উৎসর্গ করেন চা শ্রমিকদের সংঘটিত করার কাজে। ছাত্রজীবন শেষেই মানবিক বিপ্লবী সত্ত্বা তাকে নিয়ে গেছে চাষের জীবনে। সে সময় চা-শ্রমিক সমাজের উপস্থিতিতে সংগ্রামশীল করে তুলতে একটি বড় আয়োজনে তিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন আরেক জাদরেল কমিউনিষ্ট নেতা মফিজ আলীর সাথে।

ইতিহাস স্বাক্ষী দেবে ১৯৬৪ সালের ৫ই এপ্রিল শমসেরনগরে চা-শ্রমিকদের সমাবেশ। সেখান থেকে চা-শ্রমিকদের শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সাহসীভাবে লড়াই করার জন্য গঠন করা হয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তান চা-শ্রমিক সংঘ। পরবর্তীতে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক নামে যা পরিচিত। এই সংঘের নেতৃত্বে তরুণতর সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন পবন কুমার তাঁতী। যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চা-শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করা প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন (নং-১২৫২)। তখন সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের দুর্দান্ত প্রতাপের শাসনামলে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে চা-শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনে পবন কুমার তাঁতীর ভূমিকা স্মরণযোগ্য এক ইতিহাস। তার একনিষ্ঠ কর্মদতা আর দরদী সাংঘঠনিক মতার জোড়ে অল্পদিনের মধ্যই চা-শ্রমিক সংঘ চা-বাগান সমূহে নব জাগরণের সৃষ্টি করেছিলো। তিনি নিজের পথ চলার একমাত্র বাহন বাইসাইকেলটি ইউনিয়নের খরচ যোগানের জন্য বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এক নিদারুণ প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চা-শ্রমিক সংঘকে চা-শ্রমিকদের আস্তায় স্থান করে নিয়েছিলেন।

১৯৬৮/৬৯ সালে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক সোলেমান বিরোধী আন্দোলনেরও প্রথম শুরু করেন পবন কুমার তাঁতী। সোলেমান হঠাও আন্দোলনে সিন্ধুরখান চা বাগান, রাজঘাট চা বাগানসহ বিভিন্ন বাগানে সভা সমাবেশ করে চা-শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমিক ঐক্য গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার ছিল অনন্য ভূমিকা। মুক্তিশ্রমিক নেতা হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীতে। যুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাস প্রতিটি মুহুর্ত চিন্তা করেছেন কিভাবে দেশে স্বাধীনতা আসবে। চা-শ্রমিকদের দেশ প্রেমে উৎসাহিত এবং যুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য তাদের সংঘঠিত করতে নিরলসভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রতিটি বাগানে। তার উৎসাহেই সেদিন চা-শ্রমিকরা মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেছিলো। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাক হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিলো পরাজয় তাদের সুনিশ্চিত, তখন গোটা বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য শুরু হলো বুদ্ধিজীবি হত্যা। সেই নিষ্পেসিত কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি পবন কুমার তাঁতী।

চা-শ্রমিক সমাজের অগ্রনায়ক, নিপিড়ীত-নির্যাতীত চা শ্রমিকদের জাগ্রত করায় যার ছিলো অগ্রণী ভূমিকা, আপোষকামী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন বিদ্রোহী বীর সেই পবন কুমার তাঁতীকে কালিঘাট চা-বাগানের শিববাড়ী বস্তির দাসীবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। ৪ দিন বন্দি রেখে তার উপর অমানসিক নির্যাতন চালিয়ে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে নির্মমভাবে হত্যা করে শ্রীমঙ্গল শহরের ওয়াপদা অফিসের (বর্তমান পল্লীবিদুৎ) নিকটে একটি ছড়ার মধ্যে পবনের লাশ ফেলে রেখে শহর ত্যাগ করেছিলো পাক বাহিনী। তার স্মৃতি রক্ষার্থে চা-শ্রমিকরা রাজঘাট চা বাগানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করলেও আজোও ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি শহীদ পবন কুমার তাঁতী। সেই থেকে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর অবনত মস্তকে চা-শ্রমিকদের জাগ্রত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাওয়া পবনের স্মৃতিসৌধে হাজির হন চা সমাজের অসংখ্য মানুষ।

তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে উঠে ওই শহীদের আত্মা। শোসনের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার স্বপ্নে ত্রিশ বছর বয়সেই শহীদ হওয়া পবন কুমার তাঁতীর অনেক উদ্যোম, স্বপ্ন আর আকাঙ্খাকে অপুর্ন রেখেছে। আজোও চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ইতিহাসের অবসান হয়নি। তাই চা-শ্রমিকরা অত্যাচার, অবিচার, শাসন ও শোষনের জাঁতাকল থেকে মুক্ত হয়ে একটি মানবিক মর্যাদাশীল সমাজ গড়ে উঠলেই তা পূর্ণ হবে। আজ শহীদ দিবসে এটিই আমাদের ভাবনা।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে এদেশের আপামর জনতার সাথে চা-শ্রমিক সমাজের হয়েও পবন কুমার তাঁতী যে বীরত্বের ও প্রত্যয়ের দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের সবার মাঝে। পবন কুমার তাঁতীর ৩৪ তম শহীদ দিবসে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×