somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ জন্মবার্ষিকী হে প্রেমের কবি!

২৫ শে মে, ২০১৬ রাত ৩:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে, সংসারবিষবৃক্ষের দুটো সুমিষ্ট ফল-
কাব্যপাঠ ও সজ্জনের সঙ্গলাভ।

গভীর রাতে সজ্জনের সঙ্গলাভ অসম্ভব। চেনাজানা সজ্জনদের দরজায় এখন কড়া নাড়লে চোর ভেবে আগে পিটিয়ে নেবেন, তারপর চেহারা দেখবেন। তাদের বাড়ীতে যাবার পথেও আরেকশ্রেণীর সজ্জনের হাতে 'আপ্যায়িত' হবার সম্ভাবনা আছে। ঢাকা সম্ভাবনার শহর, বাংলাদেশ সম্ভাবনার দেশ, এখানে কোন সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিতে নেই।

সুতরাং কাব্যপাঠ চালিয়ে যাই। রবি থেকে নজরুল। ক'দিন আগে নজরুল নিয়ে লিখবার ফরমায়েশ পেয়েছি, কিন্তু সে সাধ্য আমার কোথায়? যিনি লিখে গেছেন প্রবল শক্তিতে-

'মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এ হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোন মন্দির কাবা নাই।'

কিতাবখোর ধর্মশাস্ত্রবিদের হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে স্বল্পজ্ঞানের বাঙালীর পক্ষে এমন চিন্তা ভীতিকর হতে পারে, সেকথা ভেবেই বোধহয় নজরুল ফের লিখলেন-

'শিহরি উঠো না, শাস্ত্রবিদেরে ক'রো না ক' বীর, ভয়,
তাহারা খোদার খোদ 'প্রাইভেট সেক্রেটারী ত নয়!'

'OMG' কিংবা 'পিকে' সিনেমার মূল বার্তা বহু আগেই নজরুল দিয়ে গেছেন। ধর্মজীবীদের দৌরাত্মের বিরুদ্ধে এমন স্পষ্টভাষণ সে যুগে অচিন্তনীয় ছিল। সব ধর্মের সারকথা যে মানবতা, সেটাকে সম্মান করার সৌজন্যতাও তিনি দেখিয়েছেন, ধর্মগুরুদের অনুভব করেছেন রক্তপ্রবাহে-

'আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহীম মুহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর- বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এরা পিতা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরই রক্ত কম-বেশি ক'রে প্রতি ধমনীতে রাজে।'

আজকের পৃথিবীতে গরীবের হক মেরে যারা ধনী হয়েছে, তাদের ধর্মকর্ম করার উৎসাহ অন্যদের চেয়ে বেশি। এদের হয়তো মনে পড়ে না, প্রায় সব ধর্ম প্রচারকই দরিদ্রবেশে জীবন কাটিয়েছেন। এই দারিদ্র্যকে ধনীরা বরণ করেনি, বরং মৃত্যুর পর স্বর্গের লোভে এদের ধার্মিকতার জন্ম। গরীব এদের চোখে উপেক্ষিত, কিন্তু নজরুলের চোখে-

'চাষা বলে করো ঘৃণা!
দেখো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী, যা আছে রবে চিরকাল।'

ফতোয়াবাজেরা সেই অমর বাণীর অপব্যাবহারে দক্ষ, কে পাপী, কে চাপাতির যোগ্য- এসব নির্ধারণ করার লোকের অভাব নেই। স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া কে এর বিচারের ক্ষমতা রাখে? এদের সাবধান করে নজরুল বলেন-

'এ দুনিয়া পাপশালা,
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা
হেথা সবে সম পাপী,
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি!'

একই কথা রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক সরকার নিজ কুকর্ম ঢাকতে গিয়ে আগের সরকারের অপকর্মের দোহাই দেয়। 'নিজের পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপা'র কী সুন্দর দৃষ্টান্ত! শুধু কী রাজনীতিক? তাদের দোসর আমলাশ্রেণীর লুটপাটে ও দাম্ভিকতায় রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হবার পথে, ব্রিটিশ আমল থেকে যাদের সেভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। শতবর্ষ আগে সেই আমলাতন্ত্র নিয়ে নজরুল যা লিখে গেছেন তা অষ্টম পে-স্কেল ঘোষিত হবার পর অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যরা নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন-

'মোদেরই বেতন-ভোগী চাকরেরে সালাম করিব মোরা,
ওরে, 'পাবলিক সার্ভেন্ট'দেরে আয় দেখে যাবি তোরা!
কালের চরকা ঘোর,
দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে চড়ে দেড়শত চোর।'

সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার নজরুলের আসল শক্তিটি হচ্ছে মানবতার আরাধনায়। সমাজের উঁচু স্তরের সাহিত্যবিশারদেরা যা নিয়ে ভাবেননি, রুটির দোকানে আধপেটা নজরুল সেই অবহেলিত অচ্ছুতদের কখনো ভোলেননি। বঞ্চিতের কথা বারবার তার লেখায় ফিরে আসে। একবার এক চিকিৎসক বন্ধু এক পিতৃপরিচয়হীন শিশুর গল্প বলেছিলেন, শিশুটিও যেন অপরাধীর সাজা পেয়ে বড় হতে থাকে। জন্মদাতা ও দাত্রীর দায় কেন অবলা শিশুর? ভেবে পাইনি। নিষ্ঠুর এ সমাজের প্রতি নজরুল লিখে গিয়েছেন-

'মুনি হল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা-শিশু,
বিস্ময়কর জন্ম যাঁহার- মহাপ্রেমিক সে যীশু!
কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল, কেহ সে ঘৃণ্য নহে,
ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা- কালিয়-দহে।
শোনো মানুষের বাণী,
জনমের পর মানব জাতির থাকে না ক' কোন গ্লানি!'

মানুষকে যিনি এভাবে ভালোবেসে জীবনটা কাটিয়ে গিয়েছেন, সেই নজরুলের কাব্যপাঠে রাত কেটে যাবে, বেলা অনুদয়ের মিষ্টি প্রহরে জীবনকে আরও শুদ্ধ করবার প্রেরনা মিলবে, ভালোবাসোতে ইচ্ছে হবে সকল প্রাণকে, বজ্রমুঠিতে আঘাত হানতে ইচ্ছে হবে নির্দয় সমাজের ইস্পাত-কঠিন বক্ষে। কবিতা নিয়ে দু'কলম হয়তো লেখা চলে, কিন্তু নজরুলকে আঁকবার মতো স্পর্ধা আমার নেই। নিজের অক্ষমতা বরণ করে নিই হাসিমুখে, এও যে নজরুলের শিক্ষা! ইত্তেহাদ পত্রিকার অফিসে বসে প্রিয় এক সহকর্মীকে বলেছিলেন, স্ত্রীর অসুস্থতা না সারলে তিনিও শয্যা নেবেন, ব্যাপারটা অনেকটা খাদের পাশে দাঁড়িয়ে কাউকে তুলতে তুলতে নিজেরই পড়ে যাওয়ার মতো।

শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল, কবি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে জীবনের শেষভাগ কাটিয়েছেন।

জরাকে ভালোবেসে আহ্বান করেছিলেন যিনি, তিনি শুধু বিদ্রোহী কবি নন, প্রেমের কবিও বটে- কবির ১১৭তম জন্মবার্ষিকীর প্রথম প্রহরে একথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি করা হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ রাত ৩:২২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×